Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Debabrata Biswas

দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতেই প্রথম ‘অবাক পৃথিবী’ শুনেছিলেন হেমন্ত

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মের ১০০ বছরে তাঁর গাওয়া অবিস্মরণীয় কয়েকটি গানের কথা-সুর-গায়ন-গল্পের অন্তরঙ্গ আলাপন। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য। আজ তৃতীয় পর্ব। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মের ১০০ বছরে তাঁর গাওয়া অবিস্মরণীয় কয়েকটি গানের কথা-সুর-গায়ন-গল্পের অন্তরঙ্গ আলাপন। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য। আজ তৃতীয় পর্ব।

দেবব্রতর প্রশ্রয়েই ‘অবাক পৃথিবী’ রেকর্ড করেছিলেন হেমন্ত। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে

দেবব্রতর প্রশ্রয়েই ‘অবাক পৃথিবী’ রেকর্ড করেছিলেন হেমন্ত। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে

অংশুমান ভৌমিক
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২০ ১৯:০১
Share: Save:

অবাক পৃথিবী (১৯৫০)

কথা: সুকান্ত ভট্টাচার্য। সুর: সলিল চৌধুরী

অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি

জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি

অবাক পৃথিবী আমরা যে পরাধীন...

গণনাট্য সঙ্ঘের আসরে গাইবার জন্যই সুকান্তের এই কবিতায় সুর করেছিলেন সলিল চৌধুরী। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। কবিতার নাম ‘অনুভব’। কিন্তু ‘অনুভব’ থেকে ‘অবাক পৃথিবী’র যাত্রাপথ বেশ রোমাঞ্চকর। এক লহমায় কবিতা থেকে মিছিলে আসেনি গানটা। একক কণ্ঠের গানে কর্ড প্রোগ্রেসন, হারমনির মতো পশ্চিমী সঙ্গীতের তুক কাজে লাগানোর সুযোগ কম বলে অসুবিধাই হয়েছিল তাঁর। হাল ছাড়েননি। ‘অবাক পৃথিবী’র এত বড় একটা ক্যানভাসকে কী করে রাঙানো যায়, কী ভাবে জাগিয়ে রাখা যায় বিস্ময়বর্তিকা, তার রাস্তা বার করার জন্য কড়া মেহনত করতে হয়েছিল সলিলকে। এর নীল নকশা বোঝার জন্য অন্তত একশো বার আবৃত্তি করেছিলেন কবিতাখানা। কেন? অনেক পরে গণসঙ্গীতের এক কর্মশালায় এসে সলিল বলেছিলেন, ‘আমার প্রচেষ্টা ছিল আবৃত্তির যা সুর এবং গানের যা সুর তার মাঝখানে যে মার্জিন অফ বর্ডার লাইন সেটা কত পাতলা হতে পারে অর্থাৎ আবৃত্তির সুর থেকে গানের সুরে যে মাইগ্রেশন সেটা কত জার্ক ছাড়া হতে পারে, সেটার কতটা হ্রাস করা যেতে পারে।’ তাই মেজর কর্ড-মাইনর কর্ডের দোলাচলে গাঁথতে হয়েছিল ‘অবাক পৃথিবী’কে। ‘এত বিদ্রোহ কখনও দেখেনি কেউ, / দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ’ সুরে ঢালতে গিয়ে মূল কবিতার স্ক্যানশন থেকে সরে আসতে হয়েছিল। ‘প্রত্যহ যারা ঘৃণিত আর পদানত’কে ফেলতে হয়েছিল কয়্যারের ধাঁচে। কিন্তু সুরের খাঁচাটা ছিল দেশি মেজাজের। গানের শুরুতেই ভৈরবীর সুর বেজেছিল। ‘বিদ্রোহ আজ’-এর মার্চিং টিউন এসে না-পড়া অবধি ওই মেঠো গন্ধ মিলায়নি।

গণসঙ্গীত হিসেবেই এ গান তৈরি। গণনাট্যের আসর জমিয়ে এ গান গাইতেন দেবব্রত বিশ্বাস আর প্রীতি সরকার। দেবব্রতর বাড়িতেই হেমন্ত এই গানখানা শুনেছিলেন। কিন্তু ১৯৫০-এ দেবব্রতর পক্ষে এ গান গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ড করা সম্ভব নয়। অথচ গানটা রেকর্ড না হলে ছড়াবে না। কোম্পানির নয়নের মণি হেমন্তকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন দেবব্রত। তাঁরই প্রশ্রয়ে ‘অবাক পৃথিবী’ রেকর্ড করেছিলেন হেমন্ত। ৫ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের রেকর্ড। আড়বাঁশির আদর বুলিয়ে বুলিয়ে রয়েসয়ে গাওয়া। গণনাট্যের আসরের তাপউত্তাপ তাতে ঢিমে আঁচে জ্বলছে। কলম্বিয়ার লেবেল সাঁটা ৭৮ আরপিএম স্পিডের রেকর্ডের দু’পিঠ জুড়ে বেরিয়েছিল গানটা। এক পিঠে ‘সেলাম, তোমাকে সেলাম!’ বলে ক্ষণিক বিরতি। অন্য পিঠে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এর তুখোড় কাউন্টারপয়েন্ট – ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে’। মনে রাখতে হবে যে কমিউনিস্ট পার্টি এ গানের প্রচারে ও প্রসারে তখন তৎপর, যারা ‘ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়, ভুলো মাৎ ভুলো মাৎ’ নাড়া তুলে নয়া সরকারের বিরাগভাজন হয়েছে, তাদের সঙ্গে রেকর্ড ব্যবসার জাহাজের ব্যাপারীদের কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ ওই সময়ের কাছে এই গানখানার এমনই আবেদন ছিল যে এ গান বাজারে পড়তেই উড়ে গিয়েছিল। মধ্যবিত্ত বাঙালির বুকে ছাই চাপা আগুনের মতো বুনে দিয়েছিল বিদ্রোহের স্পৃহাকে।

আর ওই ওরই কাছাকাছি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে ‘অবাক পৃথিবী’ গাইবার ‘অপরাধে’ সঙ্গীতজগৎ থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন দেবব্রতর আর এক স্নেহভাজন— কলিম শরাফী। সে এক অন্য গল্প।

অন্য বিষয়গুলি:

Debabrata Biswas Hemanta Mukherjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE