অঞ্জন চৌধুরীকে নিয়ে অকপট হরনাথ চক্রবর্তী।
অঞ্জন চৌধুরী ‘ছায়া’ হলে আমি তাঁর ‘কায়া’ ছিলাম। উঠতে বসতে, খেতে শুতে সারা ক্ষণ এক সঙ্গে। আমরা যেন হরিহর আত্মা। কাজের সুবাদে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম টলিউডের মুকুটহীন সম্রাটকে। মুকুটহীন বললাম ইচ্ছে করেই। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পরে বাংলা ছবির অন্ধকার যুগ। সেই সময় হাল ধরেছিলেন অঞ্জন চৌধুরী। তাঁর একের পর এক ছবি টলিউডের মরা গাঙে জনপ্রিয়তার জোয়ার বইয়ে দিয়েছিল। টানা একাধিক সপ্তাহ ধরে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে ‘হাউজফুল বোর্ড’ ঝুলত এই পরিচালকের কল্যাণে। টালিগঞ্জ ফের দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদধন্য। লোকের মুখে মুখে ফিরত তাঁর ছবির সংলাপ। তার পরেও অঞ্জন চৌধুরী টলিপাড়ার গণ্যমান্যদের সমাজে অপাংক্তেয়!
কেন? তিনি নাকি মোটা দাগের ছবি বানান। যাতে শুধুই বিনোদনের মশলা ঠাসা। যা দেখতে মাথা খাটাতে হয় না!আশ্চর্য!
এমনও অনেকে বলতেন, অঞ্জন মানেই তো ‘বউমা সিরিজ’! বড়, মেজ, সেজ, ছোট--- একের পর এক বউমা তাঁর ছবি জুড়ে। দাদার কানেও কথাগুলো পৌঁছোত। দাদা মিটিমিটি হাসতেন। আর বলতেন, ‘‘যা-ই বল আর তা-ই বল, বউমা সিরিজ-ই বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। শ্মশান হয়ে যেতে দেয়নি। অভিনেতারা কাজ করছেন। ছবি হিট হচ্ছে। প্রযোজকের ঘরে পয়সা আসছে। আমি সাধারণের জন্য ছবি বানাই। এর থেকে বেশি আর কী চাই?’’
আজ সেই পরিচালকের জন্মদিন। আফশোস, বাংলা ছবির দুনিয়া মানুষটাকে ভুলেই গেল! আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমি বলব, এই পরিচালকের বউমা সিরিজের ফর্মুলা ভাঙিয়েই তো ছোট পর্দা, টেলিপাড়া করেকম্মে খাচ্ছে! ধারাবাহিকগুলো দেখুন। শাশুড়ি-বউমার দ্বন্দ্ব, পরকীয়া, কাজের লোকের বাড়ির বউ হয়ে ওঠা--- এগুলোই দেখাচ্ছে আধুনিকতার মোড়কে মুড়ে। হাঁটছে তো সেই অঞ্জনদার দেখানো পথেই। একুশ শতকের দর্শকেরা সে সবই গিলছেন হাসিমুখে। ঠিক যে ভাবে অঞ্জনদার ‘শত্রু’, ‘গুরুদক্ষিণা’, ‘বড় বৌ’, ‘মহাজন’, ‘নবাব’, ছবি দর্শক গো-গ্রাসে গিলতেন। নকলনবিশী করতে গিয়ে অবশ্য দেখা যাচ্ছে বিস্তর ফাঁক। অঞ্জনদার ছবিতে বাড়ির রাঁধুনি রাঁধুনির মতোই। বাড়ির বউ যেমন হওয়া উচিত তেমনই। আজকের ধারাবাহিকে সাজের ধাক্কায় বোঝা দায়, কে রাঁধুনি কে বউমা! ঘুম ভেঙে ওঠার পরেও সবার চুল, সাজ, পোশাক, গয়না, পরিপাটি! অঞ্জনদা কি এর থেকেও খারাপ মানের ছবি বানাতেন?
একই ভাবে দাদা বলে বলে তারকা বানিয়েছেন। রঞ্জিত মল্লিক, জয় বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর হাতে তৈরি। অভিষেক চট্টোপাধ্যায় দাদার ছত্রছায়ায় লালিত। একই ভাবে নিজের মেয়ে চুমকি, রীণাও তাঁর জাদুকাঠির জোরে তারকা! তাঁদের অভিনীত ছবিগুলোও বাম্পার হিট। কখনও কাউকে জোর গলায় কথা বলতেন না। বকতেন না। সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন। আড্ডা দিতে দিতে ছবি বানিয়ে ফেলতেন একের পর এক। তাঁর তৈরি ‘শত্রু’ সেই সময়ের প্রশাসনের কাছে ‘উদাহরণ’ হয়ে উঠেছিল। তবু অঞ্জন চৌধুরী পিছনের সারির পরিচালক। ঘটা করে তাঁর জন্মদিন পালন হয় না।
এ তো গেল তাঁর কাজ নিয়ে সিনেবোদ্ধাদের বিশ্লেষণ। খ্যাতনামী হওয়ায় ‘মানুষ’ অঞ্জন চৌধুরীকেও কম হেনস্থা ভোগ করতে হয়নি। যিনি বহু জনের মুখে অন্ন জুগিয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ, তিনি নাকি মহুয়া রায়চৌধুরীকে মেরে ফেলেছেন! এই প্রজন্ম জানে না, একই বাড়ির এক তলায় থাকতেন বাংলা ছবির জনপ্রিয় নায়িকা। দোতলায় সপরিবারে অঞ্জনদা। দুই পরিবারের মধ্যে নিত্য যাওয়া আসা ছিল। পরিচালকের ‘ঘরের মেয়ে’ ছিলেন অভিনেত্রী। আমি নিজে মহুয়ার বাড়ির পরিচারিকা খুঁজে দিয়েছি। অঞ্জনদা মহুয়ার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবেন আর সেটা কেউ টের পাবেন না! ওঁর মেয়েরা, স্ত্রী, বাড়ির পরিচারিকা--- কেউ না? আসলে কাজের ক্ষেত্রে তো সেই সময় কেউ রুখতে পারেননি অঞ্জন চৌধুরীকে। অগত্যা বদনামই সই! মিথ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে যদি থামিয়ে দেওয়া যায় তাঁকে, তাঁর কাজকে। হাসতে হাসতে এই বলেই দাদা নিজে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন আমাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy