হরনাথ চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
তাঁর বয়স যে বেড়েছে মানতে রাজি নন। বিশ্বাস করেন, শুটিং ফ্লোরে এখনও তিনি ‘তরুণ’। সময়ের সঙ্গে নিজেকে নিরন্তর বদলানোর চেষ্টাও করেন। পাশাপাশি বাংলা ইন্ডাস্ট্রির পরিস্থিতি তাঁকে ভাবায়। সম্প্রতি, এক বিকালে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে আড্ডা দিলেন পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী। চেষ্টা করলেন অতীত হাতড়ে আধুনিক টলিপাড়ার বৈপরীত্য জরিপ করতে।
প্রশ্ন: যত দূর জানি, আপনার বয়স ষাট অতিক্রম করেছে। অবসর নিতে ইচ্ছে করে না?
হরনাথ: (হেসে) ১৯৮৯ সালে আমার প্রথম ছবি ‘মঙ্গলদীপ’ করার সময় যতটা সিরিয়াস ছিলাম, এখনও ততটাই থাকি। ‘ওহ্ লাভলি’ বা ‘ঘোষ বাবুর রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান’-এর মতো ওয়েব সিরিজ় পরিচালনার সময়েও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কারণ জানি, একটা ছবি হিট করলে পরের ছবিটা পাব। আজও আমি স্ট্রাগ্ল করছি।
প্রশ্ন: সে কী!
হরনাথ: একদমই তাই। ছবির তৈরির সংগ্রাম। যত দিন আমি কাজ করে যাব, তত দিন আমার কোনও রিটায়ারমেন্ট নেই। ওয়েব সিরিজ় করার সময় এখনও আমি টানা ১৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে শুটিং করেছি। নতুনদের অনেকের মধ্যেই এই এনার্জি দেখি না। মানসিক ভাবে যে দিন বুঝব যে, আর পারছি না, সে দিন অবসর নেব।
প্রশ্ন: একই মাসে ছবি এবং ওয়েব সিরিজ় মুক্তি পাচ্ছে। নিশ্চয়ই অন্য রকম অভিজ্ঞতা।
হরনাথ: অন্য রকম তো বটেই। এক দিকে হলে দর্শক ছবিটা দেখবেন, অন্য দিকে ওটিটিতে আমার প্রথম কাজ। দেখা যাক তাঁরা কী বলেন।
প্রশ্ন: এই ছবিতে রাজনন্দিনী পাল এই প্রজন্মের অভিনেত্রী। ঋক নতুন মুখ। আপনি কতটা আশাবাদী?
হরনাথ: জোর গলায় বলছি, তরুণ মজুমদারের পর বাংলায় নতুন অভিনেতাদের আমি তৈরি করেছিলাম। পেরেছি কি না জানি না। তবে চেষ্টা করেছি। আজও নতুনদের নিয়ে কাজ করতে পারলে আমি খুশি হই।
প্রশ্ন: তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আপনি ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছেন। কখনও কি মনে হয় যে নতুন পরিচালকদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছেন?
হরনাথ: আমি বিশ্বাস করি, পরিচালক হিসাবে কেউ কখনও পিছিয়ে পড়ে না। ছবি দর্শকের পছন্দ হচ্ছে কি না এবং প্রযোজক টাকা ফেরত পাচ্ছেন কি না— সেটাই বড় কথা। আমার নতুন ছবিটা হিট করলে আমি কি এগিয়ে যাব না কি পিছিয়ে যাব? ঋত্বিক ঘটক তো তাঁর কেরিয়ারে অনেক কম ছবি করেছেন। তার মানে কি তিনি পিছিয়ে রয়েছেন?
প্রশ্ন: বক্স অফিসে আপনার আগের ছবি ‘ডাল বাটি চুরমা’-র ফলাফল নিয়ে আপনি কি খুশি?
হরনাথ: ছবিটা যে খুব খারাপ হয়েছে সে রকম কারও কাছে শুনিনি। কিন্তু ছবির প্রচারে খামতি ছিল। পরে মনে হয়েছিল, ছবির নামের সঙ্গেও হয়তো দর্শক আত্মস্থ হতে পারেননি। না হলে ছবিটার থেকে আমার আরও বেশি প্রত্যাশা ছিল।
প্রশ্ন: নতুন পরিচালকদের নিয়ে আপনার মত কী?
হরনাথ: আমি তাঁদের সাধুবাদ জানাই। কারণ আমরা তো এক দিন থাকব না। ইন্ডাস্ট্রিকে তাঁরাই তো এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আজকে প্রভাত রায়, স্বপন সাহার মতো অনেকেই তো অবসর নিয়েছেন।
প্রশ্ন: আপনার ক্ষেত্রে রহস্যটা কী?
হরনাথ: আমি সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলেছি। তাই এই বয়সেও ওয়েব সিরিজ় পরিচালনা করলাম। আমার ছেলে হিন্দোল প্রয়োজনে আমাকে সাহায্য করে।
প্রশ্ন: নতুনদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আপনাকে কি তাদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে না কি উল্টোটা?
হরনাথ: তরুণ প্রজন্ম আজকের মতো ভাবছে। আর আমি পুরনো দিনের শিক্ষাকে আজকের প্রেক্ষাপটে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আজকের আর পাঁচজন পরিচালকের থেকে আমার কাজের ধরন একদমই আলাদা। ক্যালেন্ডারে শুরু থেকে শেষটা দাগ দেওয়া থাকে। এখন তো দেখি কারও সময় নেই। প্রযোজককে জানিয়ে দেওয়া হল শুটিং শেষ। ঝটপট সম্পাদনা হল। তার পর ডাবিং।
প্রশ্ন: তার মানে কি টলিপাড়ায় শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর আত্মীয়তা এখন কমে গিয়েছে বলতে চান?
হরনাথ: অনেক কমে গিয়েছে! শুটিং ফ্লোরে ইউনিটের একটা অংশ গল্পে মশগুল। তাদের থামাতে অন্যদের ব্যস্ত থাকতে হয়। আমি একটু সিনিয়র। তাই আমাকেই বলে থামাতে হয়। কিছু ক্ষণ পর আবার আগের অবস্থা। একাধিক ফ্লোরে গেলেই এখন যেন মনে হয় বাজার বসে গিয়েছে!
প্রশ্ন: আগে ফ্লোরের পরিবেশ কি একদমই অন্য রকম ছিল?
হরনাথ: গুরুগম্ভীর। এনটি ওয়ান স্টুডিয়োতে তপন সিন্হা হেঁটে আসছেন। আমরা, কোনও সহকারী হয়তো কোনও শিল্পীকে ডাকতে যাচ্ছি। সত্যি বলছি, পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে যেতে হত। উনি পেরিয়ে গেলে তার পর আমরা যাব। আরও একটা ঘটনা মনে পড়ছে। এনটি ওয়ান স্টুডিয়োতে লাগোয়া ঘরে এডিট চলছে। তরুণ মজুমদার, তপন সিন্হা এবং অঞ্জন চৌধুরীর ছবি। এ দিকে বাথরুম একটাই। তনুবাবু আর তপনবাবু দু’জনে সামনে হাঁটছেন। আমি আর ভয়ে বাথরুমে যেতে পারছি না— এটা কিন্তু শুধু ভয় নয়। বরং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা থেকে এই ভীতির জন্ম। এখন কোথায় সে সব! ভাবলেও খারাপ লাগে।
প্রশ্ন: বছর ছয়েক আগে স্বপন সাহা পুজোয় ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ ছবি নিয়ে আসেন। তা নিয়ে বিস্তর হাসাঠাট্টাও হয়েছিল। কী মনে হয়, ইন্ডাস্ট্রির বয়োজ্যেষ্ঠ পরিচালকদের এখন যোগ্য সম্মান দেওয়া হয় না?
হরনাথ: অধিংকাশ ক্ষেত্রেই দেওয়া হয় না। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির কঠিন সময়ে স্বপন সাহা যে ভাবে কম বাজেটে ছবি করে প্রযোজকদের টাকা ফিরিয়ে দিতেন, তা অকল্পনীয়। এবং সেটা আজকের অনেকের কাছেই শিক্ষণীয়। তিনি একটি নির্দিষ্ট মানসিকতা থেকে ছবি তৈরি করেন। তাঁর ছবি সফল। সুতরাং তাঁকে সম্মান করা উচিত। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখন বাঙালিদের মধ্যে এই মানসিকতা কমে যাচ্ছে। আসলে দর্শককেও তো দোষ দিয়ে লাভ নেই।
প্রশ্ন: কেন?
হরনাথ: আসলে, আমরা তো সেই সম্মান পাইনি। কারণ, আমরা বাণিজ্যিক ছবি করে বড় হয়েছি। এ দিকে বাণিজ্যিক ছবি তো এখন ‘অচ্ছুত’! এখন একটি মাত্র অন্য ধারার ছবি করে ইন্ডাস্ট্রির সিংহাসনে বসা যায়। তার পর তিনি কিছু করলেন কি না, তাতে কারও কিছু আসে-যায় না। কিন্তু আমাদের সময় ইচ্ছে হলেও সেটা করতে পারিনি। কারণ জানতাম, একটা ছবি সফল না হলে পরের কাজটা পাব না। দুঃখের বিষয়, এত বছর ধরে লড়েও আমরা সিংহাসন পাই না। প্রথম চেয়ারটা আমাদের জন্য রাখা থাকে না, আমাদের জায়গা দেওয়া হয় চতুর্থ বা পঞ্চম চেয়ারে।
প্রশ্ন: এখন আপনার ছবির ঘোষণা বা মুক্তির দিনে ইন্ডাস্ট্রির অন্য পরিচালক বা প্রযোজকদের তরফে ফোন বা মেসেজ আসে?
হরনাথ: (কিছু ক্ষণ চুপ থাকার পর) দেখুন, যাঁরা এক সময় আমার থেকে উপকৃত হয়েছেন, তাঁরা কেউ আমাকে ডাকেন না। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। তা না হলে কাজ করছি কী করে। আমার স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত। মাসে ওষুধের খরচ ৭২ হাজার টাকা! আমার সেই উপার্জন নেই। মুখ্যমন্ত্রীর মেডিক্লেম না থাকলে কোথায় যেতাম। ওই কঠিন সময়ে বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়), দেব, জিৎ প্রত্যেকেই এককথায় আমার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন। রানের (প্রযোজক নিসপাল সিংহ রানে) মতো প্রযোজকেরা ছবিতে সুযোগ না দিলে কী ভাবে খরচ টানব?
প্রশ্ন: আপনার ঝুলিতে ‘মঙ্গলদীপ’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘সাথী’-র মতো ব্লকবাস্টার। বাংলা বাণিজ্যিক ছবি নাকি হারিয়ে যাচ্ছে। খারাপ লাগে?
হরনাথ: প্রচণ্ড। কারণ আমরা হঠাৎ করেই কোন ছবি চলবে না আর কোনটা চলবে, সেটা ঠিক করে নিয়েছি। বলা হচ্ছে গ্রামের মানুষ আর দেখবেন না। কিন্তু কেন দেখবেন না, সেটা কেউ ভেবে দেখেনি। মফস্সলের দর্শকের বাড়িতে টিভি আছে। তাঁরা চাষ করতে করতে ফোনে সিনেমা দেখছেন। এ দিকে বলা হচ্ছে, দেখবেন না। তাই ভাবতে হবে।
প্রশ্ন: ছবি চলবে কি চলবে না, সেটা ইন্ডাস্ট্রিতে কারা ঠিক করেন বলে মনে হয়?
হরনাথ: আমি কারও নাম নিতে চাই না। আর সেটা বলাও কঠিন। ‘অর্ধাঙ্গিনী’, ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ বা ‘প্রজাপতি’-র ক্ষেত্রে কি দর্শককে কেউ সিনেমা হলে না যাওয়া থেকে আটকে রাখতে পরেছেন? কনটেন্টই শেষ কথা বলে।
প্রশ্ন: সমস্যা কি মিটবে বলে মনে হয়?
হরনাথ: অনেক ভাবনা এবং পরিবর্তন দরকার। আগে কয়েক কিলোমিটার যাত্রা করে এক জন গ্রামের মানুষ সিনেমা হলে ছবি দেখতে আসতেন। আজকে বাড়ি বসে দেখতে পাচ্ছেন। তাই জায়গা ধরে ধরে সিনেমা হল তৈরি করতে হবে। সরকারকেও পদক্ষেপ করতে হবে। তাঁদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়কে জানতে হবে। শুধুই ছবি তৈরি করলে হবে না। শুধু সিরিয়াল কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে পারবে না। আগে চলত এক-দু’বছর ধরে। এখন অধিকাংশ সিরিয়ালের আয়ু ছ’মাস। মানে দর্শক মুখ ফেরাচ্ছেন। ভাবতে হবে। দুঃখের বিষয়, আজকে ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কেউ কিন্তু ভাবছেন না। যাঁরা কাছের মানুষ, তাঁরা কী করছেন জানি না। জানি না, সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে কি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy