পরিচালক সন্দীপ রায়।
১/১ বিশপ লেফ্রয় রোড। ব্রিটিশ আমলের পেল্লায় আকাশছোঁয়া বাড়িতে কেউ ঢুকলে ধরেই নেওয়া হয় ভিজিটর অনিবার্য ভাবে বাড়ির আট নম্বর ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছেন।
কী আছে এই আট নম্বর ফ্ল্যাটে? কার্পেট মোড়া চওড়া কাঠের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলায়। পাশাপাশি চলেছে আর একটা সাবেক আমলের লিফট। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁ দিকে সাদা দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাঁ দিকের এই বন্ধ দরজাতেই এক সময় বেজে উঠত কলিং বেল। কলিং বেল নিয়ে একটা মজার গল্প আছে এই বাড়িতে। বেল বাজলে সাদা পাঞ্জাবি আর আলিগড়ি পায়জামা পরা দীর্ঘকায় সুপুরুষ শিস দিতে দিতে দরজা খুলতেন। তিনি— সত্যজিৎ রায়।
সময় বদলেছে।
রাতের দিকে ওই আট তলার ফ্ল্যাটে ঢুকেই ডান দিকের ঘরেদেখা গেল পোস্ট প্রোডাকশন, মিক্সিং সামলে চেয়ার-টেবিলের সামনে বসে আছেন তাঁর পুত্র পরিচালক সন্দীপ রায়।
এই প্রথম শঙ্কু বড় পরদায়...এই প্রথম শুধু ফটোগ্রাফার হিসেবে নয়, পোস্ট প্রোডাকশনের অর্ধেকের বেশি কাজ সামলাচ্ছেন তাঁর পুত্র সৌরদীপ...এই প্রথম নতুন হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের সেই ঘর! যা দেখার বিস্ময় থেকে আজও বিশ্ব নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি।সেই ঘরে দেখা গেল রং বদল। যত্ন সহকারে বাক্সবন্দি হচ্ছে সত্যজিতের রেকর্ডেরলোভনীয়সংগ্রহ। অ্যাসিড প্রিন্ট দিয়ে সংরক্ষিত হয়েছে চিত্রনাট্য। জানলাগুলোও সারাই হয়েছে। সব খবর পাওয়া গেল পুত্রবধূ ললিতা রায়ের কাছে। সৌরদীপ নিজের ঘরে ব্যস্ত।
রায়বাড়ির চিরকালীন রীতি মেনে হাজির বাহারি কাপে চা আর ছানার চপ।
শুরু হল সাক্ষাৎকার।
আপনি কি টেনশন করছেন?
একটু চিন্তা তো আছেই। প্রথম শঙ্কু।
মানুষ তো প্রস্তুত এই ছুটিতে শঙ্কু দেখবে বলে।
হ্যাঁ, প্রমোশন তো চলছে। ফিডব্যাকও খুব ভাল। তবে ওভার পাবলিসিটি হলে মানুষের আশা বাড়তে থাকে। সেটা চিন্তার কারণ।
এত দিন পরে শঙ্কু। আগে কি প্রযোজক পাননি?
দেখুন, আমি কোনও প্রযোজককে বলতে পারব না যে শঙ্কু করুন। আমি জানি, শঙ্কু করা কতটা খরচসাপেক্ষ! আমার আজও মনে আছে। রয়্যাল বেঙ্গল রহস্যের মহরত হচ্ছে। শ্রীকান্ত সেদিনই আমায় বলেছিল, এ বার একটা শঙ্কু করুন। খরচখরচা নিয়ে একদম ভাববেন না। আমি একটু চিন্তায় পড়েছিলাম তখন। সে সময় কলকাতায় সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে প্রযুক্তি আজকের মতো ছিল না যে শঙ্কু বানাব। মুম্বই বা চেন্নাই যেতে হবে।আমি পিছিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এ বার ছবি করার প্রসঙ্গে ওরা বলল, ফেলুদা নয়। শঙ্কু চাই। এখন দেখলাম গ্রাফিক্সের জায়গাটাও বেশ উন্নত। গল্প খুঁজতে আরম্ভ করলাম।
আরও পড়ুন-বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বিচ্ছেদ হয়ে গেল এই বাঙালি অভিনেত্রীর
আপনার তো প্রথমে ‘এক শৃঙ্গ অভিযান’ করার ইচ্ছে ছিল?
ছিল। তবে লজিস্টিক বিচার করে দেখলাম এই গল্পটা বেটার। শঙ্কুর অধিকাংশ গল্প ফিচার লেনথ নয়।আর নকুড়বাবু আমার খুব প্রিয় চরিত্র। মনে হল প্রথম ছবিতে একটা বাঙালি কানেক্ট জরুরি। শঙ্কু গিরিডি থেকে একেবারে বিদেশে চলে যাবে আর সারাক্ষণ ইংরেজি বলবে এটা ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। একজন কেউ থাকুক শঙ্কুর সঙ্গে। আর চাইছিলাম পুরো কাজটা এখানেই হোক। আমরাও যে পারি সেটা দেখানোর সময় হয়ে এসেছে...তাই শঙ্কু এলডোরাডো...
দু’টো ভার্সানে ছবি মুক্তি পাচ্ছে?
হ্যাঁ। শহরে বাংলা আর ইংরেজি। আর শহরতলিতে শুধু বাংলা। শঙ্কুকে ছড়াতেও হবে।
শঙ্কুকে আপনি কবে চিনলেন?
দেখতে গেলে, প্রথম লেখা হয়েছে শঙ্কু। তারপর ফেলুদা। আমার শঙ্কুর সঙ্গে ভালবাসা আগে। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা তো আছেই। ফেলুদাও। কিন্তু শঙ্কুর মতো চরিত্র আর নেই! বিজ্ঞানী। একা মানুষ। বেড়াল নিয়ে থাকে গিরিডিতে। লোভ নেই কোনও। একা একা আশ্চর্য সব কাজ করে।প্রথম গল্পে ছিটগ্রস্ত সায়েন্টিস্ট। ‘হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’যেমন। পরে শঙ্কুও বদলাতে শুরু করল।আসলে পরে বাবা বুঝেছিলেন, শঙ্কুকে বেশিক্ষণ খ্যাপাটে রাখা চলবে না। তাই শঙ্কুর বদল হতে শুরু করল।
১৯১২-তেই প্রকাশিত হয়েছিল আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ । হারানো আদিম পৃথিবী দেখে এসেছিলেন কোনান ডয়েলের প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।
হ্যাঁ। কোনান ডয়েলের অ্যাডভেঞ্চারের প্রভাব শঙ্কুর লেখায় এসেছিল। শঙ্কু কিন্তু শুধুই খ্যাপাটে নয়। সে ক্রমশ সিরিয়াস হতে শুরু করল। ট্রেলর দেখে অনেকে বলেছেন শঙ্কু বড্ড সিরিয়াস। আমি তো বলব, শঙ্কু অবশ্যই সিরিয়াস। সে খ্যাপাটে কখনওই নয়। সেই জায়গাটাই আমি ধরতে চাইছি। আর চরিত্র বইয়ের পাতা থেকে উঠে এলেও হুবহু এক হবে, এটা ভাবাও ঠিক না।
এই শঙ্কু পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। কোথাও ফিরে যাওয়ার কথা বলে...
একেবারেই তাই। আপনি যদি ‘কম্পু’পড়েন দেখবেন শঙ্কু আসলে একটা প্রোফাউন্ড চরিত্র। ঋষিসুলভ!
শঙ্কুর চরিত্রে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়
আপনার কি মনে হয়, শঙ্কু আসলে কে?
শঙ্কু আর কেউ নয়। শঙ্কু সত্যজিৎ রায়! আর কোনও কথা নেই। শঙ্কু ইন্টারন্যাশনাল চরিত্র। ঠিক যেমন বাবা। বাড়িতে পঞ্জাবি- পাজামা।শার্ট প্যান্ট শুট পরেই আবার বিদেশে চলে যাচ্ছেন। ধৃতিদাকে অনেকে বলেছেন আপনি গিরিডিতে আছেন অথচ ইংরেজি বলছেন, কী করে হয়?ধৃতিদা বলেছেন, কেন সত্যজিৎ রায়?উনিই আমার বেঞ্চমার্ক।যেমন ইংরেজি বলেন, লেখেন, তেমনই বাংলাও। শঙ্কুও তাই।
আপনি তো বলেছিলেন ফেলুদাও সত্যজিৎ রায়?
ফেলুদাও সত্যজিৎ, এটাও আমার মনে হয়। তবে মজার ব্যাপার,ফেলুদাকে তিনি সেই সব জায়গায় পাঠিয়েছেন যেখানে তিনি নিজে গিয়েছেন। আর যে সব জায়গায় তিনি যেতে পারেননি অথচ যেতে চাইছেন সেই জায়গায় শঙ্কুকে পাঠিয়েছেন। বাড়িতে কতবার দেখেছি, বাবা ঠিক করলেন শঙ্কুকে হাইডেলবার্গ পাঠাবেন। তখন কিন্তু মোবাইল বা ইন্টারনেট নেই। চিঠি লিখলেন ওখানকার বন্ধুকে।বাবার প্রচুর বিদেশি বন্ধু ছিল। চিঠি আসত, জার্মানি থেকে পোস্টকার্ড... বেশ কিছু দিন পরে। রোডম্যাপ আঁকা, জায়গার ডিটেলস দেওয়া চিঠি। ওঁকে তো ছবিও আঁকতে হত।সেখান থেকে গল্প তৈরি হত। অদ্ভুত সব ইনোভেশন! যা আগে হয়নি। তবে এখন তো আসছে দেখছি খিদে মেটানোর বড়ি। একটা খেলেই খিদে শেষ। তবে ফরচুনেটলি অ্যানাইহিলিন আসেনি!এলে খুব ভাল হত।
আরও পড়ুন-নওয়াজের বাড়িতে শোকের ছায়া, ২৬ বছরেই মারা গেলেন ছোট বোন
শঙ্কু কি শক্ত?
শঙ্কুর বেঞ্চমার্ক নেই। কিন্তু স্ট্রং ফলোয়ার আছে। তাদের এ ছবি কেমন লাগবে জানি না। তবে একটা ছবি সবাইকে খুশি করতে পারে না। কিছুসংখ্যক দর্শক খুশি হলে আবারও শঙ্কু হবে। যদিও আমার মনে হয়,এবার এসভিএফ বলবে ফেলুদা করতে।
গল্প কখনও ফুরিয়ে আসত?
হুমম। বাড়িতে দেখেছি পুজো এগিয়ে এল। আনন্দমেলা থেকে বাবাকে খুব তাড়া দিচ্ছে। নতুন শঙ্কু চাই। কিন্তু ক্রাইম আসছে না। ডিপ্রেশন হত বাবার। শঙ্কু আর ফেলুদার গল্প লেখা নিয়ে। সে সময়ও গিয়েছে!
শঙ্কু আর নকুড়বাবুকে বাছতে অসুবিধে হয়নি?
নাহ্। ধৃতিদার বয়স, চেহারা, পান্ডিত্য— সব কিছু শঙ্কুর সঙ্গে মেলে। শঙ্কুকে বাঙালি হতেই হবে। ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতেই হত। সেটা আমাদের এখানে ধৃতিদা ছাড়া আর কে-ই বা পারত? শুভাশিসকেও ঠিক করাই ছিল। বাবার আঁকার সঙ্গে ওর চেহারা হবহু মিলে যায়।ওখানকার লাইন প্রডিউসার খুব সহযোগিতা করেছেন।বাইরের কাস্টিং ছিল প্রচুর।
শুটিং-এর ফাঁকে
অসুবিধে হয়নি?
পাঁচটার পর জঙ্গলে শুট করা সম্ভব ছিল না। একেবারে ঘড়ি ধরে শুট। জানতাম, প্রত্যেক ঘণ্টায় টাকা বাড়ছে। আগে লোকেশন দেখতেও যাইনি।প্রোডিউসারের খরচের কথা মাথায় রেখে। তবে মানসে শুটের সময় মনে হল, কলকাতাতেই শুট করছি। খুব সহযোগী অভিনেতারা। আরে, শুটের সময় এত খাবার খেয়েছি যে বলে বোঝানো যাবে না। আগে কখনও শুট করতে করতে এত খাইনি। আমার ইউনিটও প্রচুর পরিশ্রম করেছে।
আর সৌরদীপ?
ও না থাকলে শঙ্কু করতে পারতাম না। এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি। পোস্ট প্রোডাকশন ও সামলাচ্ছে। স্পেশ্যাল এফেক্টস্-এর দায়িত্ব ওর ছিল। আর ছবি তো তুলেইছে।ওর মতামত নিয়েছি অনেক। আগ্রহ যখন আছে বুঝে নিক ফিল্মের কাজ। ও সামনে আসতে চায় না।তবে ওর মধ্যে দিয়ে ওর প্রজন্মের চোখ দিয়ে আমি শঙ্কুকে দেখেছি।
ছবি: সৌরদীপ রায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy