অভিনয় থেকে আচমকা বিরতি, ঋত্বিকের সঙ্গে সংসার,আনন্দবাজার অনলাইনে খোলামেলা আড্ডায় অপরাজিতা ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত।
এক সময় টেলিভিশনের অন্যতম জনপ্রিয় মুখ। দর্শক তাঁকে চেনেন ‘হিয়া’ নামে। যদিও টানা কোনও দিনই কাজ করেননি। বরং কেরিয়ারে বিরতি নিয়ে নিয়ে কাজ করায় বিশ্বাসী। জনপ্রিয়তার শিখরে থাকাকালীনই বিয়ে। তার পরে সংসার, সন্তান। এক লম্বা সময় ক্যামেরার থেকে দূরত্ব। যদিও ছেলে একটু বড় হতে প্রত্যাবর্তন। আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্নের সামনে অভিনেত্রী অপরাজিতা ঘোষ।
প্রশ্ন: কেমন আছেন?
অপরাজিতা: যা গরম পড়েছে! তাতেও বলছি, ভাল আছি। আসলে এই গরমটা আমাকে অবাক করে যে, পৃথিবী কত তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে!
প্রশ্ন: অপরাজিতাকে দর্শক পছন্দ করেন। কিন্তু মাঝেমাঝে তাঁকে দেখা যায়। আবার মাঝেমধ্যেই তিনি উধাও হয়ে যান। কেন?
অপরাজিতা: আমি আমার কেরিয়ারে ভীষণ অন অ্যান্ড অফ কাজ করেছি। সব ধরনের কাজ করেছি এবং সমান গুরুত্ব দিয়ে করেছি। আমি যদি সারা ক্ষণ টেলিভিশন করতাম, তা হলে অন্যগুলো করার সময় পেতাম না। তবে আমি খুবই ভাগ্যবতী যে, সিরিয়াল করতে করতে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজের কাজ করেছি। যেমন ‘এক্কা দোক্কা’ করতে করতে ‘হোম স্টে মার্ডার’-এর কাজ করলাম। তার আগে ‘কুসুমদোলা’ করার সময়েই ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’-র শুটিং করি। আসলে দুটোর ভারসাম্য বজায় রাখতে টানা টেলিভিশন করাটা সিদ্ধান্ত নয়। তবে যে বিরতির কথা বললেন, সেটার প্রয়োজন অনুভব করলাম যখন আমার সন্তান হল। মনে হল, এই বাচ্চাটার আমাকে প্রয়োজন। যদিও কোনও সিদ্ধান্তই ভেবেচিন্তে নেওয়া নয়। তবে কোভিডের সময় সচেতন ভাবেই কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, আমার সেই সামর্থ্য ছিল যে, আমি ঘরে বসে থাকতে পারি। তার জন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: সন্তান জন্মের পর কী পরিবর্তন এল জীবনে?
অপরাজিতা: যেটা সব থেকে বড় পরিবর্তন ছিল আমার জীবনে, সেটা ওজন বৃদ্ধি। এক ধাক্কায় প্রায় ৮২ কিলো হয়ে গিয়েছিলাম। সেই সময় ওজন কমানো একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল।
প্রশ্ন: কবে থেকে ভাবলেন অভিনয়কে পেশা করবেন? প্রথম থেকেই কি শখ ছিল এই পেশায় আসার?
অপরাজিতা: আসলে অভিনয় করব কোনও দিনই ভাবিনি। ভেবেছিলাম বিজ্ঞাপনে কাজ করব অথবা সাংবাদিকতা করব। পড়াশোনাটাও সে ভাবেই করি। ইংরেজিতে স্নাতক। তার পরে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর করি। যখন ‘একদিন প্রতিদিন’ সিরিয়াল করেছি, তখনও দর্শকের তরফে খুব ভাল সাড়া পেয়েছি। তখনও ভাবতাম, সিরিয়ালটা শেষ হলেই চাকরি খুঁজতে বেরোব (হাসি)।
প্রশ্ন: জীবনে কখনও চাকরি করেছেন?
অপরাজিতা: হ্যাঁ। একটা চাকরি করেছিলাম। মাত্র ২৩ দিন। একটা মিডিয়া অফিসে। কিন্তু জায়গাটা খুব সন্দেহজনক ছিল। তাই চাকরিটা ছাড়ি। সেই সময়েই ‘ইতি শ্রীকান্ত’ করার প্রস্তাব পাই। তার পর থেকে ডাক পেতে শুরু করি।
প্রশ্ন: আপনি কি পরে অভিনয়ের কোনও প্রথাগত শিক্ষা নিয়েছিলেন?
অপরাজিতা: আমি জানি না এখন ঠিক কতটা অভিনয় পারি। তবে যখন কাজ শুরু করেছিলাম তখন কিচ্ছু পারতাম না। কোনও ক্যামেরার সেন্স ছিল না। আমি যাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছি, তাঁরা সকলেই ভাল অভিনেতা। যেমন বৈশাখী’দি, রীতা’দি, পরমব্রত। তবে ওঁদের মুখ দেখে বুঝতাম, আমি চরম কিছু ভুল করছি। এ ভাবেই ভুল করতে করতে শিখতে শুরু করলাম। তবে এখন মনে হয় এই জীবনটাই ভাল। আসলে অভিনেতাদের জীবনটাই এত বিচিত্র যে, নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। আমি তো এখন আর ভাবতেই পারি না যে, ৯-৫ টার চাকরি করছি। তবে এটা বলতেই হবে যে, জীবনে যা খুশি তাই করতে পারি বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু অভিনেত্রী হব কখনওই ভাবিনি।
প্রশ্ন: ‘একদিন প্রতিদিন’-এর সাফল্যের পর যখন পরিচিতি পেলেন, তখন থেকেই কি অভিনয়কে অনেক সিরিয়াসলি নিলেন?
অপরাজিতা: আসলে আমাকে মানুষ চেনেন— এই অনুভূতিটা আগে কখনও আমাকে যেমন স্পর্শ করেনি, তেমন এখনও করে না। কোথাও সব কিছুর থেকে দূরত্বের দরকার রয়েছে জীবনে। জীবনে কোনও কিছুই তো চিরস্থায়ী নয়। তাই আমার এমন কোনও কিছুর প্রলোভন নেই জীবনে, যা আমার থেকে যে কোনও সময়ে কেড়ে নেওয়া হতে পারে। পরিচিতি বা অর্থের কারণে কাজ করতে শুরু করি এমনটা নয়। আমি কাজ করতে করতে ভালবেসে ফেলেছিলাম পেশাটাকে। একটাই জিনিস আমাকে ভাবায়— সেটা আমার কাজ। সেটা কি ঠিক করে করতে পারছি?
প্রশ্ন: দর্শক আপনাকে নিশ্চয়ই আরও বেশি করেই দেখতে চান। আপনি মাঝেমধ্যেই উধাও হয়ে যান। কোনও প্রতিক্রিয়া পান তাঁদের তরফে?
অপরাজিতা: আসলে আমি মাঝেমধ্যে ভেবে বিস্মিত হই যে, দর্শক আমাকে কেন ভালবাসেন! যে আন্তরিকতা উষ্ণতা পেয়েছি দর্শকের কাছে, সেটা এই পেশাটা ছাড়া সম্ভব হত না।
প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে ঋষি কৌশিকের জুটি এত জনপ্রিয়। ঋত্বিক চক্রবর্তীকে বিয়ের পর কেমন প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন?
অপরাজিতা: আসলে আমার যখন বিয়ে হচ্ছে ঋত্বিকের সঙ্গে, সেই সময় ইন্ডাস্ট্রিতে আমার ঘনিষ্ঠ লোকেরা ভেবেছিলেন আমি আর ঋষি সম্পর্কে রয়েছি। তবে সব থেকে মজার একটা ঘটনা ঘটে। যখন আমাদের বিয়ের ভিডিয়ো পাই। দেখি, নামের জায়গায় লেখা ‘ঋত্বিক ওয়েডস্ হিয়া’। আসলে ‘হিয়া’ এত মানুষের ভালবাসা পেয়েছে যে বলার নয়। তার জন্য অবশ্য আমার একার কোনও কৃতিত্ব নেই। একটা বড় টিম, যাঁরা লিখেছেন, যিনি ক্যামেরা করেছেন, যিনি ‘বাটার পেপার’ ধরেছেন— এই সিরিয়ালটার সাফল্যের পিছনে এঁদের সকলের অবদান রয়েছে।
প্রশ্ন: ‘হিয়া’ চরিত্রটা যখন এত জনপ্রিয় হল তখন প্রেমের প্রস্তাব আসেনি?
অপরাজিতা: না। আমার কাছে কখনও প্রেমের প্রস্তাব আসত না। আমি পরে শুনেছি, অনেকে নাকি আমাকে দেখতে আসতেন। ইন্ডাস্ট্রিরও নাকি অনেকে আসত আমাকে দেখতে। পরে তারাই বলেছে আমায়। এখন আর নাম করছি না। আসলে একটা জিনিস হত। যাঁরা আমাকে দেখতে আসতেন, তাঁদেরই মেক আপ ছাড়া আমাকে দেখলে শক্ লাগত। তাঁরাই বলতেন, না-না, ওকে টিভিতে দেখতেই খুব ভাল লাগে। আমি আসলে খুব একটা অ্যাপিলিং নই। আমার রসবোধ মারাত্মক। তবে আমাকে দেখতে খুবই বোরিং। মেক আপ নেওয়া আর মেক আপ ছাড়া আমাকে দেখতে একেবারে অন্য রকম।
প্রশ্ন: আপনার প্রায় ২০ বছর হয়ে গেল এই পেশায়। আগেকার সঙ্গে এখনকার কী পরিবর্তন দেখতে পান?
অপরাজিতা: অনেকটাই বদলে গিয়েছে এখন। আসলে জীবনে পরিবর্তন আসবে এটাই সত্যি। এটা খানিকটা ডারউইনের তত্ত্বের মতো।
প্রশ্ন: অনেকেই অনুযোগ করেন, এখন নাকি টেলিভিশনে ভাল কাজের সংখ্যা কমেছে। আপনার কী মত?
অপরাজিতা: তখন ভাল কাজ হত, এখন হয় না, এটা কী ভাবে বলি? আমি মনে করি, কেউ কখনও চায় না কোনও কাজ খারাপ হোক। এখন টার্গেট অডিয়েন্স বদলে গিয়েছে। সিরিয়াল থেকে চ্যানেল— সব কিছুর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। আমি অনুযোগ করি না। তার অন্যতম কারণ, আমি অনেক কিছু পেয়েছি ইন্ডাস্ট্রির থেকে।
প্রশ্ন: এখন নাকি সমাজমাধ্যমে ফলোয়ারের নিরিখে কাজ দেওয়া হয়?
অপরাজিতা: আমি শুনেছি। কিন্তু আমার সঙ্গে সেটা হয়নি। কারণ, আমি ফেসবুকে নেই। এই সিদ্ধান্ত সচেতন ভাবেই নেওয়া। ইনস্টাগ্রামে তিন বারের চেষ্টায় অ্যাকাউন্ট তৈরি করেছি। শুনেছি অনেকেই সমাজমাধ্যমে অনুরাগী সংখ্যার নিরিখে কাজ পান। আমি এই পৃথিবীটা বুঝতে পারি না। আমার মনে হয়, এটা এমন একটা প্রজন্ম যেখানে মনে দুঃখ থাকলেও হাসিমুখে ছবি দিতে হয়। তবে আমি ভাগ্যবতী, যে আমাকে কাজের নিরিখেই বিচার করা হয়।
প্রশ্ন: কোভিড পরবর্তী সময়ে তো বাচ্চাদের ফোন দিতে হয়েছে অভিভাবকদের। আপনারা ছেলেকে ফোন দিয়েছেন?
অপরাজিতা: না। আমার ছেলের বয়স ৯। ওকে ফোন দিইনি আমরা। এই সিদ্ধান্তটাও সচেতন ভাবেই নেওয়া। ওকে আমরা ভাল বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সিনেমা দেখে, বই পড়ে, গান শোনে। তবে সপ্তাহে এক দিনই সিনেমার দেখার অনুমতি রয়েছে। সেটাও ল্যাপটপে।
প্রশ্ন: এই সম্পর্কের ভাঙাগড়া, বিবাহবিচ্ছেদের যুগে কী ভাবে সব কিছু থেকে আপনারা নিজেদের সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রেখেছেন?
অপরাজিতা: আমাদের কোনও কিছু আলাদা করে চেষ্টা করতে হয়নি। আমরা একে অপরের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’। আসলে দুটো হৃদয় একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে।
প্রশ্ন: সুখী দাম্পত্যের কোনও টোটকা আছে?
অপরাজিতা: এটা পুরোটাই ঈশ্বরের হাত। ঠিক ঠিক মানুষের সঙ্গে দেখা না হলেই জীবনটা গন্ডগোলের হয়ে যায়। আমার আর ঋত্বিকের ক্ষেত্রে হয়তো ঠিক মানুষকে খুঁজে পেয়েছি। তবে যে কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন, সেটা হল একে অপরকে সত্যি কথা বলা।
প্রশ্ন: ঋত্বিক চক্রবর্তী ভাল অভিনেতা? ভাল স্বামী? না কি সেরা বাবা?
অপরাজিতা: ও তিনটে চরিত্রেই বেস্ট। ও যেমন ভাল বাবা, তেমনই ভাল স্বামী। আবার তার থেকেও ভাল বন্ধু।
প্রশ্ন: লোকে বলে সংসারের জন্যই নাকি আপনি কাজ করা কমিয়ে দিয়েছেন?
অপরাজিতা: ‘এখানে আকাশ নীল’ শেষ হওয়ার পর বিয়ে করি। যে বছরে বিয়ে হয়, সেই বছরে ‘চেক মেট’ করি। বিয়ের সময় একটা রান্নার শো করতাম। তাই সংসারের জন্য কাজ কমিয়েছি এমনটা নয়। যখন ভাবলাম আমরা সন্তানের জন্ম দেব, তখন কাজ থেকে বিরতি নিয়েছি। আসলে আমরা যে কাজটা করি, তার জন্য নিজেদের মনের পুষ্টির প্রয়োজন। তার জন্যই বিরতিটা দরকার।
প্রশ্ন: এখন তো সকলেই ছুটিতে বিদেশ যান। আপনাদের সে ভাবে বিদেশভ্রমণে দেখা যায় না কেন?
অপরাজিতা: ঠিকই। আমাদের একসঙ্গে বিদেশ যাওয়া হয়নি। আসলে দেশের ভিতরে এত সুন্দর সব জায়গা আছে, আমরা যখন যেখানে ঘুরতে যাই, সেটাই খুব ভাল লেগে যায়।
প্রশ্ন: বিয়ের পর হনিমুনে কোথায় যাওয়া হয়েছিল?
অপরাজিতা: বিয়ের পর আমরা বোলপুরে গিয়েছিলাম। হাতের কাছের এই জায়গাগুলো কাজে এসে যায়। তবে আমাদের দু’জনের পছন্দের জায়গা হল কুমায়ুঁ, মুন্সিয়ারি, বিনসর— উত্তরাখন্ডের এই জায়গাগুলো। যখন বেশি ছুটি থাকে না, তখন অবশ্য ঝাড়খন্ড যেতেও ভাল লাগে।
প্রশ্ন: অপরাজিতা নিজেকে কোন জায়গায় দেখতে চান?
অপরাজিতা: আমার উচ্চাকাঙ্খা খুবই কম। আমি আমার এই জীবন নিয়েই খুশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy