ললিতা। ছবি: সুদীপ্ত চন্দ
বহু বছর পর অরিন্দম শীলের ‘আসছে আবার শবর’-এর দৌলতে পরদায় দেখা গেল ষাটের দশকের অভিনেত্রী ললিতা চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁর প্রথম ছবি উত্তমকুমারের বিপরীতে ‘বিভাস’। ‘বিভাস’-এর আগে অবশ্য দশ বছর বয়সে কানন দেবীর প্রযোজনায় ‘অনন্যা’ ছবিতে এক শিশুশিল্পীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। অভিনয়ে আসার আগে ললিতা সাউথ পয়েন্ট স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। উত্তমকুমারের বিগ ফ্যান ললিতা একদিন কৌতূহলবশত দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় নায়কের ছবির শুটিং। ওখানেই উত্তমকুমার অভিনয়ের অফার দিয়েছিলেন ললিতাকে। মহানায়ক যেচে এসে সিনেমার অফার দিচ্ছেন, এটা কল্পনাতীত ছিল ললিতার কাছে! সে সময় তিনি বিবাহিতা এবং সন্তানের জননীও। শ্বশুরবাড়ির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও অভিনেত্রী হলেন তিনি। ‘বিভাস’-এর পর ‘মনের আলো’, ‘জয়জয়ন্তী’,‘মেমসাব’, ‘হার মানা হার’...
দীর্ঘ বিরতির পর আবার সিলভার স্ক্রিনে! স্রেফ ইচ্ছে না কি অন্য কোনও কারণ? ‘‘পাঁচ বছর আগে গৌতম ঘোষের একটি ছবি করেছিলাম। তার পর অরিন্দমের শবর। ছবির অফার পাচ্ছি, তার চেয়েও বড় কথা চরিত্রগুলো ভাল লাগছে, তাই করছি। আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তর ‘জোনাকি’, সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়ের ‘স্পর্শ’ এবং অরিন্দম শীলের ‘ভূমিকন্যা’র শুটিং শেষ হয়ে গিয়েছে। ‘জোনাকি’-র ওয়র্ল্ড প্রিমিয়ার হল রটারডামে। আমি যাইনি ওখানে। তবে শুনলাম বেশ ভাল ফিডব্যাক পেয়েছে ছবিটি।’’
‘জোনাকি’র অধিকাংশ শুটিং হয়েছিল কার্শিয়াংয়ে। প্রায় পুরোটাই আউটডোর। এই বয়সেও এত হেকটিক শেডিউল, অসুবিধে হয়নি? একটু হেসে ললিতা বললেন, ‘‘ক’দিন আগে অসুস্থও হয়েছিলাম। এখন অনেকটা ভাল আছি। কিন্তু এটাও ঠিক, আমি বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলাম, সে রকম তো তখন পাইনি। এই ছবিগুলোর মাধ্যমে সেই ইচ্ছেপূরণ হচ্ছে এখন। তাই হয়তো পরিশ্রম করতে পারছি এই ভাল লাগা থেকে। আমার মতে, বাংলা ছবির ইতিহাসে ‘জোনাকি’ ল্যান্ডমার্ক ছবি হতে চলেছে। ছবিতে আমিই জোনাকি। বৃদ্ধা জোনাকি কোমায় শুয়ে ভাবছে তার যৌবনের কথা। এই জন্য, জোনাকি ছাড়া বাকি চরিত্রগুলো সব তার যৌবনের। সকলে ইয়ং। যেমন জিম সর্ভ আমার বয়ফ্রেন্ডের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বেশ কিছু দৃশ্যে আমাকে বেশ বোল্ড অভিনয় করতে হয়েছে! শুধু ‘জোনাকি’ নয়, ‘স্পর্শ’ ছবিটিও অন্য রকম। দুই অসমবয়সি মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গল্প। এখানেও বেশ কয়েকটি বোল্ড দৃশ্যে আমাকে দেখা যাবে।’’
বোল্ড দৃশ্য, রিভিলিং পোশাকের জন্য আপনাকে তো বরাবরই অনেক রকম প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে... ‘‘আমার যা ভাল লাগত তাই পরতাম, এখনও তাই। এমন অনেক সময় হয়েছে যে, আমার স্বামী আমাকে বলেছেন, পোশাক বদল না করলে পার্টিতে নিয়ে যাবেন না। আমিও জেদ ধরে থাকতাম। যে পোশাক পরেছি, তাতেই যাব। তবে অনেক ধরনের ওয়েস্টার্ন আউটফিট পরলেও আমার সবচেয়ে পছন্দ শাড়ি।’’একটু থেমে, একটা মুচকি হাসি দিয়ে ললিতা বললেন, ‘‘কেন, বেণুও (সুপ্রিয়া দেবী) কি কম রিভিলিং পোশাক পরত? আমাদের নিয়ে সে সময় চর্চা হতো। তবে নিন্দে করেনি কেউ।’’
কিন্তু উত্তমকুমারের নায়িকা হয়েও খলনায়িকার তকমা পড়ে গেল কেন? ‘‘সেই সময় লম্বা- ফরসা মেয়ে, ইংরেজি বলতে জানলে খলনায়িকার চরিত্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। আমারও দশা তাই হল। এখন মনে হয়, বারবার খল চরিত্রে অভিনয় করা উচিত হয়নি। শিক্ষকতা নিয়ে থাকলেই ভাল করতাম। কিন্তু সে সময় আমার ব্যক্তিগত জীবন টালমাটাল, আর্থিক অবস্থা শক্ত করার দায়। অনেক সময় উত্তমকুমার নিজে ছবির অফার দিয়েছেন বলে ‘না’ বলতে পারিনি। ওই সময় খলচরিত্র করলে নায়িকার চরিত্রে সুযোগ পাওয়া যেত না! বম্বেতেও একই পরিস্থিতি ছিল। ১০ বছর হিন্দি ছবিতে কাজ করলাম। অধিকাংশ ছবিতে ফিরোজ খানের নায়িকা হতাম বলে আমাকে বি-গ্রেড ছবির নায়িকা বলা হতো। সুযোগ পেলাম না ভাল ছবিতে। বরং মনের মতো চরিত্র পেয়েছি যাত্রায়।’’ লন্ডনে পড়াশোনা করতে করতে দেশে চলে আসা, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে পড়াশোনা, ভাল রেজাল্ট, বনেদি পরিবারের ফ্যাশনিস্তা ললিতা কী ভাবে যাত্রার আবহের সঙ্গে মানিয়ে নিলেন? ‘‘অবাক হচ্ছেন তো! হওয়ারই কথা। যাত্রায় আসার আগে জানতামই না ‘যাত্রা’ কী! কিন্তু তখন স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। দুই ছেলের দায়িত্ব আমার কাঁধে। উপায় ছিল না। যাত্রা করতে গিয়ে কিন্তু অন্য অভিজ্ঞতা হল। ‘হ্যামলেট’, ‘ভারতজননী ইন্দিরা গান্ধী’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘তিন পয়সার পালা’... পাঁচ বছর টানা করেছিলাম। খুব হিট হয়েছিল।’’ যাত্রা করতে গিয়েই ললিতার সঙ্গে আলাপ যাত্রা পরিচালক পাহাড়ি ভট্টাচার্যের। দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন পাহাড়িকে। কিন্তু সে সম্পর্কও দীর্ঘ হল না। একটা সময় অভিনয় থেকে সরে এসে বাড়িতেই শেখাতেন স্পোকেন ইংলিশ।
বয়স হলেও তাঁর ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েননি ললিতা। এখনও তাঁর মধ্যে ভাল চরিত্রে অভিনয়ের উদ্যম যোলো আনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy