রিপোর্ট স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আলাদা করে নায়ক-নায়িকা নয়, পরিচালক নয়, ছবির বিষয় বা গল্পই আসল রাজা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বাংলা ছবিতে কি মাচো হিরোর দাদাগিরির দিন শেষ? সরু কোমর, টকটকে ফর্সা অপূর্ব সুন্দরী নায়িকাকেও কি প্রত্যাখ্যান করছে বাংলা ছবি? প্রশ্নগুলো তুলে দিল ২০১৮-য় মুক্তি পাওয়া বাংলা ছবির রিপোর্ট কার্ড।কারণ ওই রিপোর্ট স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আলাদা করে নায়ক-নায়িকা নয়, পরিচালক নয়, ছবির বিষয় বা গল্পই আসল রাজা।
প্রায় এক দশক ধরে এই গল্প নির্ভর ছবিই তৈরি করছেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায় জুটি। টানা কয়েক বছর ধরে বাংলা ছবির বাণিজ্যে সাফল্য এনে দিচ্ছে তাঁদের সিনেমা। প্রসঙ্গটা উঠতেই শিবপ্রসাদ বললেন, ‘‘২০০৮ থেকে এই কাজটাই করে আসছি আমরা। ইচ্ছে, মুক্তধারা, অ্যাক্সিডেন্ট,এমনকি হামি—কোথাও সুপারস্টার নিয়ে কাজ করিনি। এ বছরও হামিব্লক বাস্টার। এতদিনে মানুষ কনটেন্টের গুরুত্ব বুঝেছে। শহরের দর্শক, গ্রামের দর্শক— এ ভাবে আর সিনেমা হয় না। সিনেমা দু’প্রকার। হিট এবং ফ্লপ। এমন ছবি আমাকে তৈরি করতে হবে যা রিকশাওয়ালা দেখবেন, আবার একজন অধ্যাপকও দেখবেন।’’
সময়ের কাঁটা এক বছর ঘুরিয়ে দিলেই দেখা যাবে, বাংলা ছবির মুক্তি ছিল মূলত উৎসব নির্ভর। দুর্গা পুজো, বড়দিন, নিদেনপক্ষে গরমের ছুটিতে মুক্তি পেত বাংলা সিনেমা। কিন্তু ২০১৮ সেই ক্যালেন্ডারটাই বদলে দিয়েছে। ‘উমা’, ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’, ‘দৃষ্টিকোণ’ কিন্তু কোনও উৎসবের সময় মুক্তি পায়নি। শুধু তাই নয়, এই ছবিগুলো নিজেদের বিষয়ের জোরেই বাজার করে নিয়েছে। পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘পুজোতে আমার ছবি আর গরমের ছুটিতে শিবুর ছবি আসত। কিন্তু, গত বছর ছুটি বা উৎসব ছাড়াই পরপর যে ছবিগুলো এল, তার বেশিরভাগই তো হয় কনটেন্ট নির্ভর, নয় তো অনসাম্বল কাস্ট!’’
তাহলে কি কনটেন্টের সঙ্গে অনসাম্বল কাস্টের প্রবণতা বাংলা ছবিতে বাড়ছে?
সৃজিতের কথায়, ‘‘দেখুন হামি, উমা, মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, রসগোল্লা—সবটাই অনসাম্বল কাস্ট আর ছবিতে সে অর্থে দেখতে গেলে বিরাট কিছু স্টার নেই। মানুষ গল্পের টানে আসছে। সিঙ্গল স্ক্রিন কমে আশায় নাচ-গান ঘেঁষা ছবির গুরুত্বও কিন্তু কমে যাচ্ছে।’’
আরও পড়ুন: বিকিনি পরা ছবি দেখে মিমিকে সানি লিওনের সঙ্গে তুলনা!
জিৎ-দেব-অঙ্কুশরা কী করবেন তবে?
‘‘যাঁরা সিঙ্গল স্ক্রিনের উপর নির্ভর করে মশলাদার ছবি করেন, তাঁদের কিন্তু ভাববার সময় হয়েছে। দেখুন দেব কত বুদ্ধিমান! সেই কবে ‘বুনোহাঁস’করেছিল, তারপর একটু একটু করে ‘জুলফিকার’, ‘আরশিনগর’,এবার নিজের প্রযোজনাতেও ‘চ্যাম্প’,‘কবীর’-এর মতো ছবি করছে,’’— কনটেন্টের পাল্লা যে ভারী তা সৃজিতের কথাতেই স্পষ্ট।
‘দৃষ্টিকোণ’-এ প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় এবং ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।
বক্স অফিসে আদপেই টিকে থাকতে পারেনি ‘সুলতান দ্য সেভিয়ার’, ‘ভাইজান এল রে’, ‘টোটাল দাদাগিরি’, ‘বাঘ বন্দি খেলা’র মতো ছবি। যেখানে প্রসেনজিৎ থেকে জিৎ, শ্রাবন্তী থেকে মিমি তারকাখচিত কাস্টিং-এর সমাহার ছিল। এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় রয়েছেন মিমি। সেখান থেকে বললেন, ‘‘কনটেন্ট ছাড়া আর কোনও গতি নেই। নেটফ্লিক্সের যুগে এমন ছবি চাই যা দর্শক বাড়ি নিয়ে যাবেন। মশলাদার ছবি হলেও তার একটা গল্প থাকতে হবে।’’ তিনি আশায় আছেন বাংলায় ‘কুইন’বা ‘রাজি’র মতো ছবি হবে।
নায়ক বা নায়িকাদের বাজার দর কী তাহলে নেই?
সাফ জবাব দিলেন জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। বললেন, ‘‘মানুষ গল্প আর অনেকক্ষেত্রে পরিচালকের নাম দেখে ছবি দেখতে যান। বরাবর গল্পের জন্যই কিন্তু আমার ছবি করার ধাঁচটা বার বার ভেঙেছি। সুপারস্টারকে ভেবে চিত্রনাট্য লিখিনি। গল্পের প্রয়োজনে চরিত্র তৈরি হয়েছে।’’
কনটেন্ট যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকে তাহলে ‘দৃষ্টিকোণ’-এ ঋতুপর্ণা-প্রসেনজিতের মতো বিগ স্টার কেন?
প্রশ্নটা করতেই আরও পরিষ্কার হিসাব বুঝিয়ে দিলেন কৌশিক। তাঁর কথায়, ‘‘বিগ স্টার নিলেই ছবি সুপারহিট হয় না। তার প্রমাণ ‘কিশোরকুমার জুনিয়র’।ছবিটা চলেইনি। তার মানে এটা নয় যে, কিশোরকুমারের কনটেন্ট বা অভিনয় খারাপ ছিল। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় গানের ছবি করবে এটা মানুষ নিতে পারেনি। তারা জানে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এমন ছবি করবে যা মানুষকে ভাবাবে। অগত্যা মানুষের ভাবনার ঠেকা নিয়ে বলতে পারি গত বছরের বাংলা ছবি বুঝিয়ে দিয়েছে কনটেন্ট আসল রাজা।’’
‘রেনবো জেলি’ ছবির একটি দৃ্শ্যে শ্রীলেখা মিত্র এবং মহাব্রত।
বরাবর অন্য ভাবনায় গল্প বলেছেন মৈনাক ভৌমিক। তাঁর ‘জেনারেশন আমি’২০১৮-র অন্যতম চর্চিত ছবি। তিনি বললেন, ‘‘৭০-৮০-র দশকেই হলিউডে কনটেন্ট গুরুত্ব পেতে থাকে। আমাদের এখানে আসতে সময় লাগল। দেখুন ‘স্পাইডারম্যান’স্টার, কিন্তু সেটাও গল্পের জন্য। অঞ্জন দত্ত আমাদের এখানে যিশু সেনগুপ্তকে নিয়ে ব্যোমকেশ করলে সেটা লোকে দেখতে যায়। আবার অরিন্দম শীল যখন আবিরকে নিয়ে ব্যোমকেশ করেন, তখন সেটাও দেখতে যায়লোকে। অর্থাৎ ব্যোমকেশ কনটেন্ট হিসেবে সফল। দুই ভিন্ন অভিনেতা করলেও লোকে দেখবে।’’সঙ্গে মৈনাক স্পষ্ট করে নায়ক-নায়িকাদের অবস্থানটাও জানালেন। তাঁর মতে আবির, পরম, যিশু, ঋত্বিক— সকলের নিজস্ব দর্শক আছে। তাঁদের কেউ দেখতে যান না, এমনটা নয়। তাঁর কথায়, ‘‘তবে ভাল গল্প বা কনটেন্টের মধ্যেই প্রিয় অভিনেতাদের খোঁজেন দর্শক।’’
সরু কোমর, টকটকে ফর্সা রং, অপূর্ব সুন্দরী মাত্রই নায়িকা, কনটেন্টের দাপটে সেই সেকেলে ধ্যান ধারণা থেকে সরে আসছে টলিউড? প্রশ্নটা শুনে সুদীপ্তা চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘আমি কৃতজ্ঞ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আর অভিষেক সাহার কাছে ঋণী, তাঁরা ‘উড়নচণ্ডী’তে আমাকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে ভেবেছিলেন। গত বছর ‘পিউপা’, ‘রেনবো জেলি’, ‘জেনারেশন আমি’—যে সব ছবি মানুষের ভাল লেগেছে তাঁর প্রত্যেকটাই কনটেন্ট ড্রিভেন। কিন্তু আমার কাছে এমন কোনও নথি নেই যা দিয়ে আমি বলতে পারি কনটেন্ট ড্রিভেন ছবি বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য এনেছে। ‘পিউপা’র মতো ছবি লোকমুখে ভাল হিসেবে প্রচার পেতে না পেতেই হল থেকে চলে গেছে। কনটেন্ট নির্ভর ছবি অথচ দারুণ সাফল্য এমন ছবি কই?’’
আরও পড়ুন: আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে রিজেক্ট করার সুযোগ অনেক বেশি, কেন বলছেন
‘হামি’ তো হিসেবের খাতায় ব্লক বাস্টার। তাহলে?
‘‘হ্যাঁ। হামিতে স্টারও নেই। কিন্তু হামিমশালা ছবি। অকারণ নাচ-গান নেই। তবুও আমি বলব সরু কোমরের নায়িকার আধিক্য বাংলা ছবিতে আর কত দিন?’’ পাল্টা প্রশ্ন সুদীপ্তার।
এই মুহূর্তে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর প্রযোজনা সংস্থারই রমরমা।এসভিএফ সিনেমার সেই অন্যতম কর্ণধার অধিকর্তা শ্রীকান্ত মোহতা বললেন, ‘‘বাংলা ছবিতে কনটেন্টের জয়? এ প্রশ্ন আর করার প্রয়োজন নেই। ভারডিক্ট বেরিয়ে গেছে। আমি এ বিষয়ে বলার কেউ নই। দর্শক যা বলছে, চাইছে সেটাই শেষ কথা! আগে কনটেন্ট, পরে অভিনেতা। অমুক স্টার থাকবে বলেই ছবি সুপারহিট হবে এমন আর হয় না।’’
‘রসগোল্লা’ ছবির একটি দৃশ্যে উজান এবং অবন্তিকা।
কিন্তু কনটেন্ট নির্ভর অনেক ছবি আছে যা বাজারে বেশিদিন থাকেনি!
শ্রীকান্ত বলছেন, ‘‘ওই যে বললাম দর্শক। আমরা ভাবছি কনটেন্ট ড্রিভেন, দারুণ ছবি! কিন্তু, দর্শকের ভাল লাগছে না। এটা মানতেই হবে।’’তাঁর দাবি, ‘‘প্রযোজকের ঘরে টাকা না এলে সে ছবি গুরুত্বহীন। বিষয়ভিত্তিক ছবিই২০১৮-য় সাফল্য এনেছে।’’
বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরে গেলেন পরিচালক-অভিনেতা অরিন্দম শীল। বললেন, ‘‘শুধু ভাল কনটেন্ট হলেই হবে না। আজকাল দেখি লোকে বলে আমার ছবির এত ভাল কনটেন্ট অথচ হল থেকে তুলে দিল। এটা ভুল। এই ‘সেল্ফ পিটি’ভাবটা বন্ধ হোক। আমরাও লড়াই করে এসছি এতদূর।গল্প থাকলেই হবে না। সাহিত্য থেকে ছবি করলেই হবে না। সেটার প্যাকেজিং না থাকলে লোকে দেখবে না।’’ সঙ্গে তিনি আরও বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন। বললেন, ‘‘২০১৯-এর সকালে এই কথাটা বললে লোকে আমায় মারতে পারে। কিন্তু এখন লোকে গোদার, ফেলিনির ছবি দেখতে চায় না। সিনেমার ইতিহাস পড়ার জন্য হয়তো এঁদের ছবি নিয়ে পড়ে। সময় বদলেছে। কনটেন্টের নামে আঁতলামি করলে দর্শক তা দেখবে না।’’
এ বার খাজাঞ্চির দফতরের হিসেবটা দেখা যাক...
হিসেবের খাতা খুলে দিয়ে সিনেমা বিশেষজ্ঞ পঙ্কজ লাডিয়া জানালেন, স্টার এবং কনটেন্ট উভয়ের সমন্বয়ে বাংলা ছবি ২০১৮-য় ভাল ব্যবসা দিয়েছে। হামির মতো ছবি তিন কোটির কাছাকাছি ব্যবসা দিয়েছে। রেনবো জেলি দিয়েছেচল্লিশ লাখ। তাঁর কথায়, ‘‘দেখুন ছবির প্রমোশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেউ জানতাম আমরা পিউপাছবিটা সম্পর্কে? তাহলে ছবিটা চলবে কী করে? বুম্বাদা উড়নচন্ডীনিয়ে ভাল প্রমোশন করেছিলেন। কিন্তু, ছবিটা দর্শকদের ভাল লাগল না। তবে ওভারঅল কনটেন্ট নির্ভর এবং স্টারকেন্দ্রিক বাংলা ছবি গত বছর লক্ষ্মীর মুখ দেখেছে।’’
২০১৮-য় বাংলা সিনেমার মূল উপাদান গল্প। গল্পই তৈরি করবে অদেখা বা চেনা দৃশ্য...আমরা অপেক্ষায়।
(টলিউডের প্রেম, টলিউডের বক্স অফিস, বাংলা সিরিয়ালের মা-বউমার তরজা -বিনোদনের সব খবরআমাদের বিনোদন বিভাগে। ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy