আপনি নিজে রিভিউ করলে কত নম্বর দিতেন ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’কে ?
আমি রিভিউ করলে?
হ্যাঁ।
(হাসি) আমি রিভিউ করলে ওই পাঁচ কি সাড়ে পাঁচ দিতাম।
লোকে বলে অঞ্জন দত্তর যেমন দার্জিলিং, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের তেমন উত্তর কলকাতা...
(একটু অন্যমনস্ক হয়ে) এটা ঠিকই। আমি আজও পুরোপুরি উত্তর কলকাতার। কাজের সুবাদে আমি আর আমার বউ মধুজা লেক গার্ডেন্সে থাকি ঠিকই। এখানে থাকলে আমার কাজেরও সুবিধা হয় কিন্তু মন আমার উত্তর কলকাতাতেই পড়ে থাকে।
এখনও নাকি শুক্রবার করে আপনি উত্তর কলকাতায় ফিরে যান...
একদমই তাই। শুক্রবার হলেই আমি পুরনো পাড়ায়। আজকে তো আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা হয় না। কিন্তু আমার বন্ধুবান্ধব এখনও ওখানেই। বাড়িতেই আড্ডা মারি। চপ-ফুলুরি খাওয়া চলে।
কয়েকটা উল্টো প্রশ্ন করি তা হলে...
কী রকম?
তিনটে এমন জিনিস বলুন উত্তর কলকাতার যা দেখে আপনার বিরক্তিকর লাগে...
এটা ইন্টারেস্টিং।
প্রথমেই যেটা খারাপ লাগে, সেটা হল, উত্তর কলকাতাতে কোনও গলিতে আর গাড়ি ঢোকানো যায় না। কারণ সব রাস্তাই প্রায় খোঁড়া।
দ্বিতীয় জিনিসটা আগে আমাদের দারুণ লাগত, কিন্তু আজকে বিরক্তিকর লাগে। উত্তর কলকাতায় আজকেও ব্যাঙেরা কী একটা করলেও জল জমে যায়।
আর তৃতীয়?
তৃতীয়, উত্তর কলকাতায় মানুষ আজও এত অলস, কেউ ময়লা ময়লার বালতিতে ফেলে না। শুধু জানলা দিয়ে ছুড়ে ছুড়ে ফেলে। এবং ফেলে পুরো পাড়াটা নোংরা করে দেয়। এটুকু বলতে পারি, মোদীর ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ উত্তর কলকাতায় কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। এ ছাড়া নর্থে কোনও ভাল রেস্তোরাঁ নেই। কেন যে নেই কে জানে!
আর একটা জিনিস আছে, বিরক্তিকর নয়, কিন্তু খুব দুঃখের। সেটা বলতে পারি কি...
নিশ্চয়ই...
আজও উত্তর কলকাতায় যে রকম সুন্দর সুন্দর বাড়ি আছে তা দক্ষিণ কলকাতায় নেই। কিন্তু দুঃখ হয় যখন দেখি ভাইয়ে ভাইয়ে নানা শরিকি ঝামেলায় বাড়িগুলো আলাদা হয়ে গিয়ে বাড়ির দুটো দিক আলাদা আলাদা রং করে ফেলা হয়েছে।
একটা বাড়ি গোলাপি তো আর একটা ফ্যাকাশে থেকে গিয়েছে। এই ভিশ্যুয়াল পলিউশন দেখে বড্ড খারাপ লাগে।
এ বার একটু ‘ওপেন টি...’ নিয়ে কথা বলি...
শিওর...
ছবি হিট। কাল পঞ্চাশ দিন। চারিদিকে প্রশংসা। ব্লাড প্রেশার কি তা হলে এ বার স্বাভাবিক হল?
(হেসে) মনে হচ্ছে এ বার নরমাল হল। অনেকটা টেনশন কেটেছে । আমার প্রযোজক (সুজিত সরকার) অবশ্য কোনও দিন আমার উপর কোনও প্রেশার দেয়নি। প্রথম দিন থেকেই বলেছিল ছবি না চললে অসুবিধা নেই, শুধু ভাল ছবি বানালেই ও খুশি।
আপনার কুষ্ঠীটা সামলে রাখুন। এ রকম প্রযোজক তো ভাগ্য করে পাওয়া যায়।
(হাসি) কিন্তু জানেন, আমার মনের ভিতরে এটা ছিল, ছবি একটা বানালাম, কিন্তু কেউ দেখলই না শুধু প্রশংসাই করে গেল, ওটা যেন না হয়।
আজ যখন দেখছি মানুষ ছবিটা দেখছে, ভাল লাগছে। আর সত্যি বলতে, এত লোক যে দেখবে ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’, রিলিজের দিন আমি ভাবিনি।
এই সাফল্যটা দেখে সবচেয়ে কী ভাল লাগছে?
সবচেয়ে ভাল লাগছে. আবার করে বহু মানুষ পুরনো বন্ধুদের ফোন করছে ছবিটা দেখে। শুধু তাই নয়, রিইউনিয়ন করে সবাই ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ দেখতে যাচ্ছে।
আর ভাল লাগছে এই ছবিতে এমন কিছু মানুষকে আমি দেখিয়েছি যাদের সেই অর্থে সাকসেসফুল ইন লাইফ আমরা বলতে পারি না।
এই না-সফল হওয়া মানুষগুলোকে যে দর্শকদের ভাল লাগছে এটা আমার কাছে বিরাট প্রাপ্তি।
এই ছবিটা তো অনেকটাই বায়োগ্রাফিকাল?
বায়োগ্রাফিকাল ঠিক নয়। এই ছবিতে আমি এমন কিছু মানুষের কথা বলেছি যাদের আমি ছোটবেলায় দেখেছি।
অন্যের দরজায় কড়া নেড়ে পালিয়ে যায় এমন মানুষ আমি সত্যি দেখেছি।
রনি (রজতাভ দত্ত) যে কথায় কথায় ‘শুয়ার’ বলে এমন লোককে আমি চিনি। বাকি গল্পটা এই মানুষগুলোকে রেখে বুনেছি।
আপনার উত্তর কলকাতার বন্ধুরা দেখলেন এ ছবি?
হ্যাঁ, ওরা দেখেছে। কিন্তু ছবির থেকেও বেশি ওরা দেখেছে কোন পাড়ায় শ্যুটিং হল সেগুলো।
ওদের দেখা মানে, আরে এটা মসজিদ বাড়ি স্ট্রিট না! আরে এটা ছিদাম মুদি লেন না! (হাসি)
প্রথম ছবিতেই সাফল্য পেলে পরিচালকদের শুনতে হয় ‘বিগিনার্স লাক’য়ের জন্যই ছবি হিট কিন্তু আসল পরীক্ষা হবে দ্বিতীয় ছবিতে। আপনার কানে এসেছে এ জাতীয় কথাবার্তা?
ও সব আমি ভাবি না। এত দিন ধরে গান গাইছি, এ রকম কথা আমি চিরকালই শুনে আসছি। আমি একটা জিনিস বুঝি, জলে যখন নেমেছি সাঁতরাতে হবেই। আর একটু চাপ থাকলে ভাল। চাপে কাজটা ভাল হয়।
আপনার ইন্টারভিউ করতে যাচ্ছি শুনে লোকজন বললেন, ‘ধুর্, অনিন্দ্য বড্ড সেফ। কোনও ধামাকা কোট দেয় না’। কিন্তু আপনি মিডিয়াতে চাকরি করেন, কোনটা হেডলাইন হবে জানেন। তাও এ রকম নন-কন্ট্রোভার্সিয়াল এবং নিরামিষ থাকেন কী করে? রেগেও তো যান না শুনেছি?
আমার বন্ধুবান্ধবরা বলে আমি লোককে যতটা অপমান করতে পারি, তা নাকি আর কেউ করতে পারে না।
আমারও রাগ হয়, কিন্তু সেটা আমার বাড়ির লোক আর বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ জানে না।
আর ‘ওপেন টি...’ বানানোর সময় প্রচুর গালাগালি করেছি। আমাকে সেটে দেখলে আপনি আর আমায় এই প্রশ্ন করতেন না। (হাসি)
আপনি তো ছবির গল্পটা নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে ফেলেছেন। কখনও মনে হয়নি এটা আশির দশকে করলে হত?
না, নব্বই দশকের মাঝামাঝি গল্পটা ধরেছি তার একটা কারণ আছে। ’৯১-’৯২তে গ্লোবালাইজেশন হল মনমোহন সিংহ আর নরসিংহ রাওয়ের হাত ধরে।
সেখান থেকে দেখলে ১৯৯৫ সালটা আমার কাছে একটা চৌকাঠের মতো।
সেই সময় থেকেই সব কিছু পাল্টাতে শুরু করল। মোবাইলে জ্যোতিবাবু আর সুখরাম কথা বললেন, গণেশ দুধ খেল... এই বদলে যাওয়া সময়টাকেই ধরতে চেয়েছিলাম।
রজতাভ দত্ত এবং ঋদ্ধি সেন কি বরাবরই ফার্স্ট চয়েস ছিলেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ... প্রথম দিন থেকেই আমি ওদের দু’জনকেই কাস্ট করতে চেয়েছিলাম।
ঋদ্ধিকে আমি দেখেছিলাম যখন ও ক্লাস সেভেন কী এইটে পড়ে। সেই সময় আরও কিউট ছিল। দেখতেও অন্যরকম ছিল। দেখেই বুঝেছিলাম ভীষণ ভাল অভিনেতা ঋদ্ধি। আর রজতাভ তো আমার ফেভারিট।
শুনেছি পরের ছবি নিয়ে প্ল্যান করছেন। গায়ক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের কী হবে তা হলে?
‘চন্দ্রবিন্দু’র দশ নম্বর অ্যালবাম কিন্তু এই বছর হবে। পুরোদমে কাজ চলছে। এটুকু বলতে পারি, গানটা ফার্স্ট লাভ। ওটা ছাড়া বাঁচতে পারব না। গায়ক অনিন্দ্যকে পরিচালক অনিন্দ্য ওভারশ্যাডো করতে পারবে না।
ছবি সুপারহিট। রাতে তা হলে হিরোইনদের, ‘হাই অনিন্দ্যদা’ মার্কা এসএমএস আসা শুরু হয়ে গিয়েছে?
(হাসি) তারা ‘হাই অনিন্দ্য’ বলছে, না রাতে ‘হাই’ তুলছে, সেটা এখনও জানি না। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির সবাই খুব প্রশংসা করছে ছবিটার। আমার পরের ছবিতে কাজ করতে চেয়েছে নামী অভিনেতা, এগুলো শুনে ভাল লেগেছে। মনে হয়েছে তাঁদেরকে আমি কনফিডেন্স দিতে পেরেছি।
আপনার ইন্টারভিউ তাই ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রসঙ্গ আসবেই। আজকে মিস করছেন ঋতুদাকে?
ভীষণ মিস করছি। ঋতুদা জানত আমি ছবিটা বানচ্ছি। সেই সময় আমি ভেবেছিলাম ছবির নাম দেব, ‘বন্ধু বাইলেন’। ঋতুদা টাইটেল শুনে বলেছিল, ‘এটা বড্ড পোয়েটিক হয়ে যাচ্ছে অনিন্দ্য’। তারপর তো নানা চেঞ্জ হল।
তবে আমার একটাই আক্ষেপ, ছবির স্ক্রিপ্টটা ফাইনালি আর ঋতুদাকে দেখানো হয়নি। তবে দেখালে ব্যাপারটা ঝামেলার হত, প্রচুর কাটছাট করত ঋতুদা।
আজ তো শুক্রবার। রাতে কি সেই উত্তর কলকাতা?
হ্যাঁ, রাতে আবার সেই উত্তর কলকাতা। কাল সকালে আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া। সোমবার সকালে ফেরা। এই ফেরার সময় কিন্তু আজও মনটা খারাপ হয়ে যায়।
সবচেয়ে খারাপ কী লাগে?
সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় আশেপাশে সেই মানুষগুলোর মুখ দেখি যারা আজও নর্থকে আকড়ে ধরে বসে আছে।
সেই মানুষগুলোর আশেপাশে কিন্তু আজকে অন্য সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ এসে গিয়েছে, যাদের অবস্থা এদের থেকে অনেক বেশি সচ্ছল।
সেই সচ্ছল মানুষদের পাশে এদের দেখে খারাপ লাগে। বাবুয়ানি তো এদের আর কিছু নেই, দাপটও শেষ। পুরোটাই অতীতকে ঘিরে বেঁচে থাকে। এই বদলে যাওয়া উত্তর কলকাতায় এই মানুষগুলোকে তখন বড্ড বেচারা মনে হয়। কান্না পায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy