জন্মশতবর্ষে উজ্জ্বল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাবার একশো বছরের জন্মদিন। চারপাশের হুল্লোড় দেখে তিনি হতবাক। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই বললেন, ‘‘বাবা বেঁচে থাকতে জন্মদিনে এত হইচই দেখিনি। আজ যা দেখছি। আমার কাছে বাবার জন্মদিন মানে ইলিশ মাছ আর পায়েস। ব্যস! বাবার শেষ ১০বছর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার, রবি ঘোষ— সকলে বাড়িতে আসতেন। সে-ও ওই পোলাও মাংস আর ইলিশেই শেষ হত।’’
বাবার জন্মদিনের একশো বছর গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে হাজির করেছে বাবা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে, অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নয়।
আনন্দবাজার ডিজিটালকে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ইলিশ মাছ পেলে বাবা কিচ্ছু চাইত না। ভাজা ইলিশ হলে ভাতের ওপর মাছটা রাখত। কিছুক্ষণ বাদে সেখান থেকে সরিয়ে তার তলার তেল-ভাতটা খেত। আবার ও পাশ থেকে সরিয়ে এ পাশে ভাতের ওপর নিয়ে আসত মাছটা। এমনি করে... আর ভালবাসত কই, ট্যাংরা। রবিবার হলে পাঁঠার মাংস চাই-ই।’’
আরও পড়ুন: বিধি মেনে মেট্রো-লোকাল ট্রেন চালু হলে আপত্তি নেই, ঘোষণা মমতার
জন্মদিন বলেই বাবার খাওয়ার কথা মনে পড়ছে তাঁর। আর ভাদ্রের ভেজা শহরে ছোটবেলা জমা হচ্ছে মনের জানলায়।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ভানু।
‘‘সকলের কাছে হাসির প্রতীক হয়ে আছেন আমার বাবা। কিন্তু ছোটবেলায় আমরা দুই ভাই, বোন বাবাকে বেশ সমঝে চলতাম। বাড়িতে বাবা গম্ভীর।’’ কথা প্রসঙ্গে গৌতমবাবু স্মৃতি থেকে জানালেন, তাঁর বাবা সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে বেশ কড়া ছিলেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় চাননি, তাঁর মেয়ে লিপস্টিক পরুক। মেক আপ করে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে বাড়ি থেকে বেরোক।এমনকি মেয়ে অভিনয় জগতে আসুক সেটাতেও বাবার তীব্র আপত্তি ছিল।
কিন্তু বেশ ভিতুও ছিলেন।কারও শরীর খারাপ। বাবা ডাক্তার তো ডাকবেই না। যখন বাড়িতে ডাক্তার, বাবা বাড়ির বাইরে টেনশন করছেন।কত লোক থাকত আমাদের সেই ৬৯এ, চারু অ্যাভিনিউয়ের ভাড়াবাড়িতে। একটা বড় ঘর আর গ্যারাজ ঘরের উপরে খুপরি একটা ঘর। বড়টায় দাদু, ঠাকুমা, আমি, আমার ভাই। সঙ্গে বাবার এক মামা, তিনি আবার বদ্ধ উন্মাদ। মাটিতে ঢালাও বিছানা করে শুয়ে পড়তাম। দাদু শুধু খাটে। বাবা, মা আর বোন শুতো খুপরি ঘরে।’’
‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে রবি ঘোষের সঙ্গে ভানু।
বাবা মানে ছিল গল্প বলা! গৌতমের মনে আছে... ‘‘বাবার গল্প ছিল মাঝি-মাল্লাদের সঙ্গে। আর ঢাকাইয়া টাঙাওয়ালাদের সঙ্গে। বাবা বলতেন, জোকস জানতে গেলে ওঁদের সঙ্গে গল্প করতেই হবে। যদিও গল্পের ছলে তিনি জেনে নিতেন নানা খবরাখবর। যে ‘খবর’কাজে লাগত বিপ্লবীদের। শুনেছি, বাবা টিফিনবক্সে শুধু নানা পত্রিকা, কাগজপত্রই নয়, রিভলভার পাচারের কাজেও হাত লাগিয়েছিলেন। পুলিশি নজরে পড়ায়, বাংলাদেশের পাট চুকিয়ে চলে আসতে বাধ্য হন কলকাতায়। প্রথমে ওঠেন চারু অ্যাভিনিউয়ের এক দেড় কামরার ভাড়া বাড়িতে।’’
জন্মদিন নিয়ে যে তাঁর বাবা কোনওকালেই বাড়াবাড়ি করেননি, ১০০বছর পরে তার কারণ খুঁজতে গিয়ে তাঁর পুত্র গৌতম বললেন, ‘‘আসলে সিনেমা ছাড়া বাবা কিছুই জানতেন না। বাড়িতে তো থাকতেন না। বেশির ভাগ সময় স্টুডিয়োপাড়ায়। আর বাড়ি থাকলেই উত্তমকুমার, রবি ঘোষ, অনুপকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ রায়ের অভিনয় নিয়ে গল্প। কে কোন ছবিতে কী ভাবে অভিনয় করলেন? কেমন করে সংলাপ বললেন। অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন ছবি বিশ্বাস আর তুলসী লাহিড়িকে। গৌতমের মনে আসছে আশ্চর্য সব ঘটনা, ‘‘বিকাশ রায় বাবাকে এত শ্রদ্ধা করতেন যে পাশে বসতেন না, বসতেন পায়ের কাছে, মাটিতে। আর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় তো বাড়ির লোক। বাবাই তো ফ্রক পরা সাবুপিসিকে রাস্তায় দেখে পছন্দ করে ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে আনেন। সেই কোন ফ্রক পরা সাবুপিসিকে রাস্তায় দেখে পছন্দ করে ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে অভিনয় করাবে বলে বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল। পরে জানা যায়, সাবুপিসিরা সম্পর্কে আমাদের আত্মীয়। আসতেন মাধবীপিসিও (মুখোপাধ্যায়)।’’
এক বিরল মুহূর্ত। উত্তমকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবি— আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
এমন টান ছিল অভিনয় জগতের যে গৌতমবাবু তাঁর মা নীলিমা দেবীর কাছে দ্বিরাগমনের গল্প শুনেছেন। তিনি জানালেন, তাঁর বাবা বিয়ের পরে দ্বিরাগমনে গিয়ে বউকে কোনওমতে বাপের বাড়িতে রেখেই স্টুডিয়োপাড়ায় চলে যান। সারা দিন, রাত নতুন জামাই ঘরে ফেরার নাম নেই। কী ব্যাপার? শ্বশুরমশাই নতুন জামাইকে খুঁজতে গিয়ে দেখেন, গায়ে কালিঝুলি মাখা। ছেঁড়া চট চাদরের মতো জড়ানো এক লোকে পরিণত হয়েছে তাঁর জামাই।
ছবির শুটে ব্যস্ত। ফেরার সময় জানা নেই।মেয়ের বাবা তো খাপ্পা! নীলিমা দেবীও উপায়ান্তর না দেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখেছিলেন তাঁর মা জামাইকে আদর করে খাওয়াচ্ছেন।সে-ছবির নাম ছিল ‘জাগরণ’। নির্দেশক বিভূতি চক্রবর্তী।
ভানুর স্ত্রী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন নামী গায়িকা ছিলেন। গৌতমবাবু বললেন,“মা তো বাবার আগেই বেশ নাম করেছিলেন গানের জগতে। মা ১৯৪৫ সালে প্রথম রেকর্ড করেছিলেন। ফিল্মেও প্লে ব্যাক করেন, ‘কবি চন্দ্রাবতী’, ‘বনের ময়ূর’, ‘সর্বহারা’, ‘কাঞ্চন মূল্য’, ‘বৌ ঠাকুরানির হাট’ প্রভৃতি ছবিতে।’’
সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় আসল নাম হলেও, অভিনয় জগতে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁর বাবাকে, মনে করেন গৌতম।
‘‘পাশের বাড়ি’, ‘বসু পরিবার’ রিলিজ করল। তার পরে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর পর তো বাবা শিখরে চলে গেলেন। বছরে ১৭-১৮টা করে ছবি করছিলেন। আমার জন্মের পর প্রথম দশ বছর পরে আমরা ১৯৫৭ সালে জুবিলি পার্কের বাড়ি চলে এলাম। কিন্তু ওখানে বাবার মন টিকলনা। তখন ১৯৬০ সালে আবার এই এখনকার চারু অ্যাভিনিউয়ের দোতলা বাড়িতে এলাম। অন্য একটা বাড়ি। এই বাড়িটা ছিল দেববালা দেবী নামে এক পুরনো আর্টিস্টের বাড়ি। লিজে ভাড়া বাড়ি, কিন্তু পুরোটাই আমাদের। পরে বাড়িটার লিজ শেষ হলে মায়ের তাগাদায় এই বাড়িটাই বাবা কিনে নেন”, বলছেন গৌতম।
তাঁর কাজের ক্ষেত্রে আছে অজস্র মজার ঘটনা।
সেই বিখ্যাত জুটি। ‘হাসি শুধু হাসি নয়’ ছবিতে জহর রায় ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
গৌতম বললেন, ‘‘ছবির নাম ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’। নির্দেশক সাধন সরকার প্রথমে চেয়েছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে। সাবুপিসিরাজি হননি। বাবা ধরে নিয়েছিল, তা হলে ছবি বোধহয় আর হলই না। হঠাৎ শুটিংয়ে ডাক পেয়ে ফ্লোরে গিয়ে দেখে, তৃপ্তি মিত্র!বাবা বেশ ঘাবড়েই যায়। কিন্তু শটে অদ্ভুত কাণ্ড! ক্লোজ শট। তৃপ্তি মিত্রও নির্ঘাত টেনশন করছিলেন। ক্যামেরা চালু হতে ভয়ে খামচে ধরেছিলেন বাবার হাত।’’
তবে শুধু সিনেমাই নয়, খেলার প্রতি ছিল অদম্য ভালবাসা! পছন্দের শিল্পী শচীন দেববর্মণের সঙ্গে খেলার মাঠে গিয়ে ইস্টবেঙ্গলের বিপক্ষে ঝগড়া করতেও ছাড়েননি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজেও গান করেছিলেন ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’-এ, যে ছবি উত্তমকুমার করবেন বলেও দৃশ্য অপছন্দ হওয়ায় চলে আসেন।
তবে সকলকে হাসিয়ে ফেরা এই মানুষের জীবনেও কঠিন সময় সামনে আসে ষাটের দশকের শেষে। ‘অভিনেতৃ সংঘ’-য় ভাঙন। ‘‘উত্তমকাকু, অনিলকাকুদের (চট্টোপাধ্যায়) বেরিয়ে যাওয়া। পাল্টা সমিতি ‘শিল্পী সংসদ’ তৈরি। খুব কষ্ট পেয়েছিল বাবা। বাবার প্রথম হার্ট অ্যাটাকটা তখনই। তবু মাথা নোয়ায়নি। ফলে ব্ল্যাক লিস্টেড। যে জন্য বহু দিন কাজ পেত না। এ দিকে সংসার চালাতে হবে যে! তখন যাত্রা একমাত্র সম্বল। কোথায় না কোথায় গিয়েছে তখন যাত্রার জন্য! যে লোকটা নরম বিছানা ছা়ড়া ঘুমোতে পারত না, সে কিনা মাটিতে চাটাই পেতে রাত কাটিয়েছে। ভাঙা বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিয়েছে।বুকের উপর পাখা ভেঙে পড়েছে। তবু শক্ত চোয়াল আলগা হতে দেয়নি। ’৭৯ থেকে বাবার শরীরটা খুব ভাঙছিল। বড্ড রোগা হয়ে যাচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ করল।’’ থামলেন গৌতম। বাবার লড়াইয়ের রক্তিম পথের এতটুকুও ভোলেননি তিনি।
আরও পড়ুন: ‘আমার কোনও আফসোস নেই’, আকাঙ্ক্ষা খুনে যাবজ্জীবনের সাজা শুনে নির্লিপ্ত উদয়ন
’৮৩-র ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। রয়ে গেলেন চিরকালের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালির সংস্কৃতি চর্চায় প্রবহমান তাঁর একশো বছর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy