সুখের সেদিন। ফ্রেমবন্দি তাপস, চিরঞ্জিত, প্রসেনজিত।
আমি, বুম্বা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়), তাপস একই সময়ে কাজ করেছি। ’৭৯-তে আমার প্রথম ছবি রিলিজ় করেছিল, তাপসের
’৮০-তে। বুম্বা একটু পরে এসেছে। তাপস প্রচণ্ড সফল। প্রচুর হিট ছবি। অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছে। সেটা বুম্বার ক্ষেত্রেও হয়েছে। কিন্তু দেখতে গেলে বুম্বা স্ট্রাগল করেছে অনেক বেশি। তাপস যেমন এসেই সফল হয়েছিল, সেটা ওর ক্ষেত্রে হয়নি। তবে স্লো বাট স্টেডি উইনস দ্য রেস, যেটা বুম্বা সম্পর্কে বলা যায়। ও নিজের কেরিয়ারকে ডিজ়াইন করতে পারত খুব ভাল, যেটা তাপস করতে পারেনি। কারণ ওই স্কিল ওর ছিল না। যেটা হাতে আসত, সেটাই হইহই করে করত। তা ছবি হোক বা রাজনীতি। দীর্ঘসময় এমপি থেকেছে, তার আগে এমএলএ। কিন্তু রাজনীতিতে থেকেও ঠিক মতো রাজনীতির ভাষাটা কি শিখতে পেরেছিল তাপস? বোধহয় পারেনি। সে কারণে কিছু বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে। যেটা ওর সারল্য। আরও কিছু কিছু কাজ ও জীবনে করেছে, যে কারণে বিপাকেও পড়েছে। গ্রেফতার হয়েছে, জেল খেটেছে... সেগুলোও হয়তো বা ওর ছেলেমানুষির জন্য।
আমাদের তিনজনের পথ ভিন্ন হলেও আসলে আমরা বন্ধু ছিলাম। খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। আউটডোরে গিয়েছি। মেকআপ ভ্যানের কাছে নিজের সিগারেটটা রেখে, তাপস আমার কাছে সিগারেট চাইত। আমি অন প্রিন্সিপাল সিগারেট বা ড্রিঙ্কস কাউকে দিই না। তাই বলতাম, ‘স্পটে পৌঁছে খাবি।’ তখন বলত, ‘দাও না একটা, খেতে ইচ্ছে করছে, ওখানে পৌঁছে তোমাকে দিয়ে দেব।’ এ রকম পাগলামো করত। তাপস খেতে ভীষণ ভালবাসত। একটা শুটিংয়ে আমি স্টু আর টোস্ট খাচ্ছি। দেবশ্রীও (রায়) তা-ই, সঙ্গে আচার। ও এসে বলল, ‘আমিও তোমাদের মতো খাব।’ বললাম, ‘পারবি না তুই এটা খেতে।’ বলল, ‘হ্যাঁ খাব। আমি এখন ডায়েটিং করছি।’ স্টু আর টোস্ট খেল। তার পরে আমরা যখন শট দিচ্ছি, দেখলাম, দৌড়ে গিয়ে একগাদা খাবার নিয়ে ফিরল। সেগুলোও খেল! বললাম, ‘তুই তো ডাবল খেলি। এই তোর ডায়েটিং!’
এমএলএ-এমপি হিসেবে ওর যে কাজ, তা ও করেছে। কিন্তু ওই যে একফোঁটা চোনা ফেলে দিল! তার জন্য এত বড় শাস্তি হতে পারে না যে, ঘরবন্দি হয়ে রয়ে গেল। অসুস্থ ছিল। ওই সময়ে ওর সঙ্গে কারওরই যোগাযোগ ছিল না। আর তাপস-প্রসেনজিতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা? আসলে ভিতরে এই লড়াই কী ভাবে লড়তে হয়, সেটা ও জানত না। দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল রাজনীতি ও সিনেমার মধ্যে। আমি সরে গিয়েছিলাম। তাপসও সরে যায়। বুম্বা সেই সময়টা ইউনিকলি ইউটিলাইজ় করেছে।
বাংলা সিনেমার ইতিহাসে তাপস একজন অসাধারণ অভিনেতা হিসেবে থেকে যাবে। থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের আমরা তিনজন, আমাদের মধ্য থেকে এক নক্ষত্র চলে গেল। অত সুন্দর হাসি, অত এক্সপ্রেসিভ! ‘সাহেব’-এ যে চরিত্রটা করেছিল, সেটা আর কেউ পারত না। আমিও না। এত সাবলীল অভিনয়! কিন্তু এখানেও সমস্যা একটাই। ওকে দর্শক মনে রেখেছে প্রথম দিকের ছবির জন্য। ‘দাদার কীর্তি’, ‘অনুরাগের ছোঁয়া’, ‘সাহেব’... পরের দিকে আমরা ভাল ছবি করলেও ও আর পারেনি।
তাপস মাথায় একটা চোট পেয়েছিল। দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিল। অনেক ওষুধ খেতে হত। ডায়াবিটিসও ছিল। তখন ওর বোধহয় কনসেনট্রেশনে সমস্যা হত। মনে রাখতেও পারত না বলেই আমার মনে হয়েছে। ‘ঘর সংসার’-এ (’৯৩) আমরা যখন অভিনয় করছি, ও বলত সংলাপ প্রম্পট করতে। আমি বলতাম, ‘মাত্র দেড় পাতা স্ক্রিপ্ট শুনে শুনে বলবি কেন?’ বলত, ‘আমি মনে রাখতে পারছি না।’ যাত্রার ক্ষেত্রেও অনেকের কাছে শুনেছি, স্টেজে গিয়ে সংলাপ ভুলে যেত। সেখান থেকেও ও একটু পিছিয়ে পড়েছিল। তবে শেষটা বড় ট্র্যাজিক। নিউজ় তৈরি করতে গিয়ে একটা সাংঘাতিক ভুল কথা বলে ফেলা, তার ফলাফল এমন হল... তাই সব দিক বিচার করে আমার মনে হয়, হি ওয়াজ় আ ভেরি সিম্পল বয়। ইডি, সিবিআইয়ের কথাও যদি ধরা হয়, সেগুলোও আগেপিছে না ভেবে করেছিল।
আমার বরাবর মনে হয়েছে, কোনও একটা সময় হয়তো এর শেষ হবে। কিন্তু তা আর হল না। সেখান থেকেই চলে গেল তাপস।
অনুলিখন: পারমিতা সাহা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy