প্রথম ছবি ২০০২-এ। ‘ফিলহাল’। পরেরটা পাঁচ বছর পরে। ২০০৭-এ। ‘জাস্ট ম্যারেড’। আর একটা দীর্ঘ অপেক্ষা। মেঘনা গুলজার তৃতীয় ছবি বানালেন আরও আট বছর পর। সেই ‘তলবার’ নিয়ে তার পর দেশ জুড়ে আলোচনা চলেছে। আরুষি-হত্যা মামলার ছায়ায় তৈরি এই ছবিই নাকি এখনও এ বছরের দর্শকদের রিভিউ পাওয়া অন্যতম সেরা ছবি!
শুভ বিজয়া, পুজো কেমন কাটালেন?
শুভ বিজয়া। পুজো এ বার খুব ব্যস্ততায় কেটেছে। ছবিটা মুক্তির পরে ছুটি কাটাতে লখনউ গিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরেই লন্ডনে ছবির স্ক্রিনিং ছিল। পুজোর সময় তো ছিল দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাসভবনে ছবির বিশেষ প্রদর্শনী। তাই পুজোটা এ সবের মধ্যেই কেটে গেল।
পুজোর কলকাতায় এসেছেন কখনও?
না, আসার ইচ্ছে থাকলেও হয়ে ওঠেনি। তবে ছোটবেলায় পুজোতে মুম্বইতে খুব মজা করতাম। মহালয়া থেকে শুরু হত। নতুন জামা থেকে শুরু করে, অঞ্জলি, ধুনুচি নাচ, ভোগ কিছুই বাদ যেত না। সারাদিন কাটত প্যান্ডেলেই। মা তখন ব্যস্ত অভিনেত্রী, তবুও একদিন আসতই। দু’বছর আগেও ছেলেকে নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোতে গিয়েছি। লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজোও খুব নিষ্ঠার সঙ্গে হত আমাদের বাড়িতে। দিদার পাশে বসে আমিও নারকেল নাড়ু বানিয়েছি। ওই দিনগুলো কী ভীষণ মিস করি...।
‘জাস্ট ম্যারেড’ করেছেন আট বছর আগে। তৃতীয় ছবি বানাতে এত দিন লেগে গেল?
কারণটা একদমই ব্যক্তিগত। আমার ছেলে এখন সাড়ে পাঁচ। ছোট্টবেলা থেকে সব সময় ওর সঙ্গে থাকা, মা হিসেবে ওকে, আমার পরিবারকে সময় দেওয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এতটা গ্যাপ।
কিন্তু, আরুষি মামলার মতো বিষয়-ই বা কেন?
প্রাথমিক আইডিয়াটা ছিল বিশাল ভরদ্বাজের। হ্যাঁ, আরুষি-মামলার বিষয়টা আমি মিডিয়া থেকেই জেনেছিলাম। কিন্তু এটা থেকে আস্ত ছবি তৈরির কথা বিশালই আমাকে বলেন। আমিও ক্রমশ ভাবনাটার সঙ্গে জড়িয়ে যাই।
সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা কি এখনও প্রাসঙ্গিক?
অবশ্যই। নয়ডার জোড়া খুনের মামলার ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তদন্তকারী দলই বদলেছে এত বার! আদালত এত বার রায় দিয়েছে। যত বারই এই ঘটনা নিয়ে কোনও বিষয় সামনে এসেছে, জনগণ মুখিয়ে থেকেছে কী হল জানতে। আদালত আরুষির বাবা-মা রাজেশ ও নূপুরকে সাজা দিয়েছে। অনেকেই কিন্তু সেটা মেনে নেননি। অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি।
সম্প্রতি শিনা বরা হত্যা মামলার সময়েও দেশজুড়ে মিডিয়ায় ঝড় উঠল। আরুষির ঘটনার সঙ্গে কোনও মিল পেলেন?
একটা জিনিসই বুঝতে পারলাম। সাত বছরে কিছুই বদলায়নি আমাদের। দোষী খুঁজে বেড়ানোর ধরন, রসালো গসিপের জন্য সেই এক আকচাআকচি, সেই এক ভাবে সেনসেশন তৈরি করার চেষ্টা। মিডিয়ার একাংশ তখন আরুষি, তার পরিজনদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যা ইচ্ছে গল্প তৈরি করে গিয়েছিল। এ বারেও তাই। আরে, মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি তো আমাদের ন্যূনতম সংবেদনশীলতাটুকু রাখা উচিত। যতক্ষণ না কেউ দোষী প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ এই ‘ট্রায়াল বাই মিডিয়া’ ব্যাপারটাই উচিত নয়।
এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? কী মনে হয় আপনার?
মিডিয়ার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়া বিপুল সংখ্যক মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়াকে প্রভাবিত করে। তবে এখন মিডিয়ার মধ্যেও প্রবল প্রতিযোগিতা। কে বেশি ‘আইবল গ্র্যাব’ করবে, তা নিয়ে টানাটানি। সেটা করতে গিয়ে ‘সেনসেশনের’ মাত্রাটাও বেড়ে যাচ্ছে। তবে পুরো দোষটা মিডিয়ারও নয়। ওরাও তো পুলিশ-প্রশাসনের ভিতরের সোর্স থেকেই খবর পায়। সেই খবর যখন টিভি বা কাগজে আসে তখন শুধু শিরোনামেই আসে। একটা বড় অংশের মানুষ পুরো খবরটা খুঁটিয়ে জানার ধৈর্য দেখান না। তাঁরা শিরোনামটা দেখেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান। ভদ্রতা, সংবেদনশীলতা যেন থাকে, মিডিয়ার সেটাও গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার।
আপনি ‘তলবার’-এ একদম নির্মোহ ভাবে পুরো বিষয়টা দেখিয়েছেন। এ রকম ‘সেনসেশন’ তৈরি করা একটা ঘটনা এমন ‘ডিসপ্যাশনেট’ ভাবে দেখালেন। কতটা কঠিন ছিল?
আমরা ঠিকই করেছিলাম ছবির প্রতি ১০০ শতাংশ সৎ থাকব। তদন্তে তিন রকম বয়ানের কথা উঠে এসেছে। আমরা তিন রকম মতের কথাই দেখিয়েছি। ছবি দেখে যদি মনে হয় আমরা কারও দিকে বেশি ঝুঁকে আছি, তাহলে সেটা এ জন্য যে, তথ্য তার দিকে বেশি ঝুঁকে রয়েছে। আমরা যা তথ্য পেয়েছি, তার প্রতি সম্পূর্ণ সৎ থেকেছি।
আপনার ছবির অনেকগুলো প্রশ্নের মিল পাওয়া যায় অভিরুক সেনের লেখা ‘আরুষি’ বইয়ের সঙ্গে...
হ্যাঁ, ওঁর বইটার কথা আমি জানি। তবে পড়া হয়নি। কারণ ওঁর বইটা যখন প্রকাশিত হয় তখন ‘তলবার’য়ের পোস্ট প্রোডাকশন চলছিল। তবে উনি খবরের কাগজে আরুষি মামলা নিয়ে যেগুলো লিখেছেন, সেগুলো আমি পড়েছি। দ্যাট ওয়াজ পার্ট অব আওয়ার রিসার্চ ওয়ার্ক।
বছর দু’য়েক আগে একটি মামলায় সিবিআইকে ‘কেজড প্যারট’ (খাঁচাবন্দি তোতাপাখি) বলে ভর্ৎসনা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি। এই ছবি বানানোর আগে রিসার্চ ওয়ার্ক করার অভিজ্ঞতা থেকে এ নিয়ে আপনার অভিমত কী? সত্যিই কি কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাইরে গিয়ে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে?
এখানে দু’রকম ব্যাপারই আছে। এই মামলাতেই সিবিআইয়ের দু’টি দল দু’রকম মত দিয়েছে। দু’টি মতই একে অপরের থেকে বিপরীত। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, এমন ক্ষেত্রে এই ধন্দ তৈরি হওয়াটাই ঠিক নয়। এই ধন্দ থাকাটাই মানুষের ভরসা হারিয়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ। সেটা সবার আগে দূর করা দরকার। তবে আমাদের দেশে অনেক সমস্যাও রয়েছে। তদন্ত, বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রয়োজনীয় অফিসার, বিচারপতি, বিচারক প্রয়োজনের তুলনায় কম। তাই বিচার পেতে এত দেরি হয়। সাধারণ মানুষের মনে তাই এ সব সম্বন্ধে ভয় থাকাটা স্বাভাবিক। আরুষি মামলার মতো বা, তার থেকেও ভয়াবহ ঘটনা হয়তো আমাদের দেশে আরও অনেক ঘটেছে, ঘটছে। খবরে না আসায় আমরা তা জানতেও পারি না।
ছবির গান নিয়ে নাকি আপনি ভীষণ খুঁতখুঁতে। গুলজারের লেখাও একবারে পছন্দ হয় না...
(হেসে) এটা সেই ফিলহাল থেকে চলছে। এখানেও আমি বাবাকে গানগুলো একাধিকবার রি-রাইট করতে আবদার করেছি। তবে বিশাল ভরদ্বাজ আর বাবার বোঝাপড়া এত ভাল, কখন যে কথা লেখা হয় আর কখন যে সুর হয়, বোঝাই যায় না!
বাবা হিসেবে গুলজারের অনুপ্রেরণা নিয়ে কী বলবেন?
একটা কথাই বলব, ডিসিপ্লিন। বাবা যে কী ডিসিপ্লিনড তা না দেখলে বোঝা অসম্ভব। এখনও, এই বয়সে ঘড়ি ধরে সকাল দশটা থেকে বিকেল অবধি নিজের ডেস্কে কাজ করেন। ওনার জীবনই আমার অনুপ্রেরণা।
‘তলবার’ তো সফল। পরের ছবি নিয়ে ভাবছেন? আবার অনেক দিন পর?
(হাসতে হাসতে) ‘তলবারের’ জন্য তিন বছর ধরে রিসার্চ করেছি আমরা। এই তো সবে সেটা মুক্তি পেল! হ্যাঁ, আমার মাথায় ভাবনা আছে। ছেলেও একটু বড় হয়েছে। আশা করি আর আট বছর অপেক্ষা করতে হবে না!
অনেক ধন্যবাদ...
ধন্যবাদ! লেখাটা মেল করবেন কিন্তু! (হাসতে হাসতে) মায়ের কাছে গিয়ে পড়তে বলতে হবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy