গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
নির্বাচনের মধ্যে এমন একটা পরিসর তৈরি করে দেওয়ার জন্য আনন্দবাজার অনলাইনকে ধন্যবাদ। বহু মানুষের কাছে বহু কথা পৌঁছনো বাকি আছে। যদিও এই লেখা পড়ে অনেকেই ট্রোল করবেন। তাঁদের জন্য বলব, কথা বলা জরুরি। তাই আমায় যখন সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছে, আমি বলব। যাঁরা চোখ কান বন্ধ করে অরাজনৈতিক থাকছেন, তাঁদেরই এই লেখা আমি উৎসর্গ করলাম।
প্রথমেই বলব, একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কতটা গুরুত্বপূর্ণ এক প্রক্রিয়া, সেটা আমরা ছোট থেকেই বইতে পড়েছি। নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি, নির্বাচন ভারতের মতো দেশে কত গুরুত্বপূর্ণ।
এ বার, অর্থাৎ ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে একটা কথা মনে হচ্ছে। নির্বাচনে ভোটদানের প্রক্রিয়াটা কতটা নিজের বা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে আটকে আছে, এই নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ আছে। অর্থাৎ একজন নাগরিক কতটা স্বচ্ছ থেকে ভোটদান করছেন, তা নিয়ে আমার মনে একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। যদিও আমার অভিজ্ঞতা বেশি নয়, বয়সের জন্য।
কিন্তু গত কয়েক বছরের নির্বাচন দেখে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে সেটা হল, এই ভোটদান প্রক্রিয়ার মধ্যে বা নেপথ্যে নানা রকমের ‘ম্যানিপুলেশন’ থাকে। যার ফলে মানুষ সত্যিই স্বচ্ছতা রেখে ভোট দিতে পারে কি না, সেটা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছি না। বিশেষ করে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ‘ম্যানিপুলেশন’ কাজ করে। সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে ফোন আসছে, কোনও অ্যাপ খুললেই সেখানেও বিজ্ঞাপন। সারা দেশ ও শহর জুড়ে দেখতে পাচ্ছি রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞাপনের পোস্টার, কাটআউট। আমরা জানি, এর পিছনে বিপুল পরিমাণে অর্থ ব্যয় করা হয়।
চুলের শ্যাম্পু থেকে শুরু করে চিপ্সের প্যাকেট বা ছবিরও প্রচার হয়। কিন্তু রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের পিছনেও এখন বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। বিশেষ করে আমরা ইলেক্টোরাল বন্ডের পরে জানতেই পারছি, কত লক্ষ কোটি টাকা খরচ করা হয়। কখনও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলোচনা, কখনও পোস্টার, নানা রকমের অনুষ্ঠান —এই সবের মধ্যে মানুষ কতটা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, নিজের আশপাশ, সমাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, পুরসভা বা পঞ্চায়েত এলাকা বা বৃহত্তর ভাবে গোটা দেশের কথা ভেবে ভোটদান প্রক্রিয়া করছে, তা নিয়ে আমার একটা সন্দেহ জন্মেছে।
আমার মনে হয় ভোটদান প্রক্রিয়ার উপর থেকে আস্থা তুলে নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া চলছে সারা দেশ জুড়ে। গণতন্ত্র, সংবিধান ও পরিবেশের উপর বিপুল আক্রমণ তৈরি করা হচ্ছে। ২০২৪-এর নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গত ১০ বছর ধরে ভারতের নাগরিকদের যে বোকা বানানোর প্রক্রিয়া চলেছে, তার কী জবাব মানুষ দিতে চলেছে, সেটা দেখার।
গত ১০ বছরে দেশের মানুষকে বিপুল পরিমাণ স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিশ্রুতিগুলি থেকেই বঞ্চিত করে মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৯ এর আগে যে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল ভারত রাতারাতি একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে প্রথম বিশ্বের দেশ হয়ে যাবে। ভারতের সব মানুষ নিজেদের অধিকারগুলি সহজে প্রয়োগ করতে পারবে, এমনও মনে হয়েছিল। ১০ বছর পর পরিষ্কার, সেই কথাগুলি রাখা হল না। সেই স্বপ্নগুলি আসলে দুঃস্বপ্ন। আগামি দিনে এগুলি স্বপ্নভঙ্গ হয়েই থেকে যাবে। তাই ভারতের এবং পশ্চিমবঙ্গে (যে হেতু আমি এ রাজ্যে থাকি) মানুষকে বোকা বানানোর এই সার্বিক প্রক্রিয়ার কী জবাব দেয় তারা, সেটাই দেখার। তাই এটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন।
তবে আমরা সকলেই প্রায় জানি, এই নির্বাচনের ফলাফল কী হতে চলেছে। যা-ই হয়ে যাক, কিছু রাজনৈতিক দল ও কয়েক জন প্রার্থী জিতবেনই। বলা ভাল, এই ফলাফল নিয়ে প্রায় সকলেই নিশ্চিত। আসলে মূলধনই সব। মূলধন বা বিপুল পরিমাণ লগ্নির দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা এই মুহূর্তে কোনও রাজনৈতিক দলের নেই।
আমি দেখতে চাই, সত্যিই কি মানুষ বেকারত্ব, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন? এমন একটা দেশে আছি, যেখানে ১৮-৩৫ বছরের মানুষকে দেশ ছেড়ে বা রাজ্য ছেড়ে যেতে হচ্ছে। কারণ চাকরি নেই। কম বেতনের চাকরি পেয়েও রাজ্য বা দেশ ছাড়তে হচ্ছে। আমি দলমতনির্বিশেষে মানুষের সঙ্গে কথা বলি। বর্তমানে মানুষের সব চেয়ে বড় দুঃখের জায়গা হল, কাজ নেই। শুধু মাত্র ভাতার রাজনীতি হচ্ছে। ভাতা দিয়ে উন্নয়নের নামে আসলে এই ১৮-৪০ বছরের মানুষকে স্টার্টআপ, ব্যবসা. চাকরি এগুলি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
এই বিষয়গুলি না দেখে ধর্মীয় আবেগ, বিদ্বেষের রাজনীতিতে মানুষ মন দিচ্ছে। সেই অনুযায়ী তাঁরা ভোট দিচ্ছেন। ফলে এর পরে যা ফলাফল হতে চলেছে, যে শোষণের মুখোমুখি আমরা হতে চলেছি, এবং যে ভাবে আগামিদিনে মানুষকে আরও বোকা বানানো হবে, ভারতের মানুষের প্রাপ্য সেটাই। ভারতের মানুষ ভোট দিয়ে প্রমাণ করে দেবেন, তাঁরা আসলে ভাল ভবিষ্যৎ, ভাল রাস্তা, শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এগুলি নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। করোনা অতিমারীর সময়ে দেখা গেল, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কেউ তখন পাশে ছিল না।
স্নাতকোত্তরের পরে গবেষণা করার সময়ে নতুন শিক্ষানীতির জন্য তাঁরা সমস্যার মধ্যে পড়ছেন। নতুন নিয়মের দ্বারা ভবিষ্যতে যাঁরা উচ্চশিক্ষা পেতে চান, তাঁদের জন্য সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান —এই তিনটি বিষয় নিয়ে মানুষ চিন্তিত নয়। এটা যদি প্রমাণিত হয় , তা হলে বলব, ভারতীয়রা এই ফলাফলেরই যোগ্য। কারণ তাঁরা হিংসা চান, বিদ্বেষ চান, রাজনীতিবিদদের মুখে অকথ্য ও অশ্লীল ভাষা শুনতে চান, ভাতা চান।
পরিবেশকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। জঙ্গল কেটে ফেলা হচ্ছে। জলবায়ু বদলে যাচ্ছে। এগুলি নিয়ে মানুষ চিন্তিত নয়। গণতান্ত্রিক ভাবে আমরা কতটা আক্রান্ত হচ্ছি, সেটা যদি মানুষ বুঝতে না পারে, তা হলে দুঃখ পাব। তবে সেই দুঃখে কারও কিছু আসে-যায় না। এই ভাবেই সব চলবে। এই ভাবেই আমাদের বোকা বানানো হবে। বহু শিক্ষিত যুবক-যুবতী দেশ ছেড়ে চলে যাবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে আবার নদীতে লাশ ভাসতে দেখব। সব দেখেও আমরা যে ভাবে চুপ করে থাকছি তার খেসারত আমাদেরই দিতে হবে। ভুল সরকার আমরা নির্বাচন করেছি এবং করেই চলেছি।
এর পরেও থিয়েটারের মঞ্চ থেকে আমরা যখন এগুলি নিয়ে কথা বলি, কিছু মানুষ আসেন। আমাদের প্রতিবাদে গলা মেলান। যার জন্য আমরা আজও উৎপল দত্তের ‘দিল্লি চলো’-র মতো নাটক করার সাহস পাই। সম্প্রতি চন্দন সেনের ‘আমাদের গপ্পো’ নাটকে সরাসরি এই অরাজকতার বিরুদ্ধে কথা বললাম। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি আমাদের কাজের মাধ্যমে। কারণ এই দেশকে যে ভাবে বিদ্বেষের দেশ বানানো হচ্ছে, সেটা দেখে দুঃখ হয়। কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনৈতিক দলাদলির মাঝে মানুষ পিষে মরছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy