Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Entertainment news

ওয়েব সিরিজ ‘পঞ্চায়েত’: বাংলায় এমন কাজ কেন হয় না?

প্রকৃত মনের ভাব প্রকাশে সঠিক বিশেষণ বা যথার্থ শব্দের অভাব ঘটে প্রশংসার ক্ষেত্রেই। বিশেষ করে তা যদি হয় ‘পঞ্চায়েত’-এর মতো অনবদ্য একটি কাজ।

ওয়েব সিরিজ ‘পঞ্চায়েত’-এর একটি দৃশ্য।

ওয়েব সিরিজ ‘পঞ্চায়েত’-এর একটি দৃশ্য।

অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২০ ১২:৪৬
Share: Save:

নিন্দের কোনও ভাষা নেই, এই কথাটাই আসলে ভুল। নিন্দে করার জন্য খুব একটা ভাবতে হয় না। অনেক বেশি কঠিন কোনও কিছুর প্রশংসা করা। প্রকৃত মনের ভাব প্রকাশে সঠিক বিশেষণ বা যথার্থ শব্দের অভাব ঘটে প্রশংসার ক্ষেত্রেই। বিশেষ করে তা যদি হয় ‘পঞ্চায়েত’-এর মতো অনবদ্য একটি কাজ। গল্প, কাহিনিবিন্যাস, চিত্রনাট্য, সংলাপ এবং তার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা অভিনয়ের মুন্সিয়ানা এই ওয়েব সিরিজের মেরুদণ্ড। অবশ্য বাকি ক্রু মেম্বাররা কেউই কম যান না। সম্পাদনার পরিমিতিবোধ, মেদহীন স্মার্ট পরিচালনা, দৃশ্যভাবনার সঙ্গে মিশে যাওয়া সঙ্গীত পরিচালনার বোধ, এমনকি চরিত্রদের আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা কস্টিউম— প্রত্যেকেই নিজস্ব দক্ষতার ছাপ রেখে গিয়েছে। অসম্ভব তৃপ্তি নিয়ে অনায়াসে তাই বলে দেওয়া যায়, অ্যামাজন প্রাইম-এ দীপক কুমার মিশ্র পরিচালিত ‘পঞ্চায়েত’ ওয়েব সিরিজের আটটি এপিসোড আসলে একটা অসাধারণ টিমওয়ার্কে তৈরি নির্ভেজাল ভাল কমেডি ড্রামা। এই বিধ্বস্ত সময়ে যেন কোনও নতুন অনুভূতি।

গল্পের নায়ক অভিষেক ত্রিপাঠী শহুরে ছেলে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও চাকরির ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে রেজাল্টের কারণে। এক রকম বেকার। অবশেষে যে চাকরি পায় সেটা মোটেই তার মনের মতো নয়। বালিয়া জেলার পঞ্চায়েত শাসিত প্রত্যন্ত এক গ্রাম ফুলেরা। সেখানে পঞ্চায়েত প্রধানের সেক্রেটারির চাকরি। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল, এই যুক্তিতে তীব্র অনিচ্ছা আর একরাশ বিরক্তি ভরা মুখে ফুলেরা যাওয়ার বাসে সে উঠে পড়ে লটবহর নিয়ে।তার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকে কাজ এবং জায়গা সম্পর্কে একটা ধারণাহীন বিভ্রান্তি। আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকা ভোলাভালা একটা মানুষ। এখান থেকেই শুরু হয় তার পদে পদে নানা রকম বাধাবিপত্তির জার্নি। অভিষেক শহর থেকে যে কাজ করার মাইন্ডসেট নিয়ে এসেছিল, যে সামান্যতম কাজের পরিবেশ ও সম্মান আশা করেছিল, সেটা বাস্তবে সোনার পাথরবাটি বুঝতে পেরে ‘ক্যাট’ পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি শুরু করে।

বলা বাহুল্য, কমেডির ছত্রেছত্রে ট্র্যাজেডির শাখাপ্রশাখা। নানা বিড়ম্বনার মধ্যে সূক্ষ্ম হাস্যরসের যুগলবন্দি একদম শুরু থেকেই। এককথায় যাকে বলা যায় সিচুয়েশনাল কমেডি। চিত্রনাট্যে এমন অনেক পরিস্থিতি, অজস্র মুহূর্ত তৈরি করা হয়েছে যেখানে কখনও সংলাপে, কখনও অভিনেতাদের রিয়্যাকশনে, কখনও বা ঘটনার অদ্ভুত পরিণতি নিপাট হাসির খোরাক হয়।

আরও পড়ুন: মধুচন্দ্রিমার দিনই গুলিবিদ্ধ প্রথম স্বামী, ২১ বছরের বড় কিশোরকুমারই ছিলেন নায়িকা লীনার সঙ্গী

শুরুতেই দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি নিয়ে তালাবন্ধ পঞ্চায়েত অফিসের সামনে পৌঁছনোর পর দরজার তালা খোলা সংক্রান্ত কিছু দৃশ্যের মধ্য দিয়ে আগামীতে তার অভিজ্ঞতা কতটা দুর্বিষহ হতে চলে তার প্রমাণ পায় দর্শক। সরকারের খাতায় ফুলেরার পঞ্চায়েত প্রধানের নাম মঞ্জুদেবী, অর্থাৎ নীনা গুপ্ত। কিন্তু বাস্তবে তাঁর স্বামী ব্রিজভূষণ দুবে, অর্থাৎ রঘুবীর যাদবই প্রধানের ভূমিকা পালন করে। সে আবার মুখরা স্ত্রী মঞ্জুদেবীকে বেশ সমঝেও চলে! নীনা গুপ্ত এবং রঘুবীর যাদবের স্বচ্ছন্দ সাবলীল অভিনয় আবারও তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে নিঃসন্দেহে। তাঁরা এ ভাবেই বার বার প্রমাণ করবেন, প্রকৃত শিল্পীর জাত নষ্ট হয় না কখনও।

‘পঞ্চায়েত’-এর কাহিনিবিন্যাস এবং চরিত্রায়ণে সব থেকে মুগ্ধ করে মানুষগুলির আপাত অশিক্ষা, উচ্চাশাহীন, ছোটখাটো বিষয়ে সুখ খুঁজে নেওয়া যাপনের মধ্যে অসম্ভব সারল্য। উপরি পাওয়া, এরা কেউই তেমন ক্ষতিকারক, প্রতিহিংসাপরায়ণ বা তথাকথিত ভিলেন নয়। ব্রিজভূষণ ছাড়াও পঞ্চায়েতের কাজে অভিষেকের নিত্যসঙ্গী দুজন বিকাশের ভূমিকায় চন্দন রায় আর প্রহ্লাদ পান্ডের চরিত্রে ফয়জল মালিকের অভিনয়ে কমেডির রিফ্লেক্স এবং সেন্স অব টাইমিং মুগ্ধ করে। আর অভিষেক ত্রিপাঠীর চরিত্রে জিতেন্দ্র কুমার তো অনবদ্য। একাধারে কমিক সিচুয়েশন এবং ট্র্যাজিক মুহূর্ত, দু’ক্ষেত্রেই তাঁর অভিনয় হৃদয় ছুঁয়েছে। এককথায় তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া।

গ্রাম্যজীবনের দৈনন্দিন একেঘেয়েমিতে তারা এতটাই অভ্যস্ত এবং নিশ্চিন্ত যে ঘোঁট পাকিয়ে চক্রান্ত করার অবকাশও নেই তাদের। তবু পঞ্চায়েত সচিব শহুরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি অভিষেক ত্রিপাঠীর এদের বুঝতে জানতে শেখাতে গিয়ে নাকানিচোবানি অবস্থা। কারণ, সারল্যের সঙ্গে অজ্ঞতার সহাবস্থান মূর্খামির পরিণাম হয়ে ওঠে গ্রামের সার্বিক উন্নতির পথে প্রতিবন্ধকতা। নিরীহ সরল স্বভাবের কিছু মানুষ, যারা লোডশেডিং, কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা আর ভোটের সুবিধাভোগী রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের ছোট ছোট পাওয়া, না পাওয়াগুলোকে বেশ মেনে নিতে শিখেছে। এই অপরিবর্তনশীল আবদ্ধ মানসিকতা থেকে তাদের মুক্ত করাটাই যেন হয়ে দাঁড়ায় অভিষেকের চাকরির প্রায়োরিটি। স্ক্রিপ্ট আর অভিনয়ের মেলবন্ধন কোনও দৃশ্যেই আরোপিত নায়ক করে তোলেনি পঞ্চায়েত সচিব অভিষেক ত্রিপাঠীকে। বরং রক্তমাংসের মানুষের মতোই সে নিজেকে ভেঙেছে গড়েছে পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কখনও হতাশায় হাল ছেড়ে দিতে চেয়েছে, কখনও খুঁজে পেয়েছে সমাধানের আশার আলো। গ্রামে সোলার লাইটপোস্ট বসানোর মিটিংয়ের দৃশ্যে সে যতটা নিজের মনের কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেছে, ঠিক ততটাই আত্মবিশ্বাসী আচরণ করেছে গ্রামে ভুতুড়ে গাছ নিয়ে মানুষের মনের ভ্রান্ত ধারণা ভাঙার ছোট ছোট দৃশ্যগুলিতে। সরকারি নির্দেশে পরিবার প্রথার দেওয়াল লিখন নিয়ে গ্রামের কিছু লোকের নির্বোধ সেন্টিমেন্টকে সে ধুয়েমুছে দেয় উপস্থিত বুদ্ধি আর বিচক্ষণতায়।

ক্রমশ চিত্রনাট্যের পরতে পরতে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা যায় অভিষেকের মধ্যে। গ্রামের প্রধান ও দুজন সহকর্মীর মধ্যেও তার সুন্দর একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। একটা সুন্দর পারস্পরিক বোঝাপড়া। আদপে তারাই হয়ে ওঠে ওর পরিবার। মান-অভিমানের মানুষ। বিষাদ এবং নাছোড়বান্দা মনোভাবের সঙ্গী। এত ভাল মানবিক চরিত্রচিত্রণ, সম্পর্কগুলোর ভেতর নিখাদ ভালবাসার ছোঁয়াচ, নিপাট ভরসা ও বিশ্বাস কমেডির নাটকীয়তার মোড়কেও ঝকঝকে।

আরও পড়ুন: দুই মেয়ের পর করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি বলিউড প্রযোজক করিম মোরানি

পঞ্চায়েত প্রধান ব্রিজভূষণের সঙ্গে অভিষেকের সম্পর্কের গভীরে যে স্নেহ, যে সম্মান দেখা যায় তাকে কুর্ণিশ করতেই হয়। কারণ একটাই। সেটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নানা দৃশ্যে চরিত্রের আচার-আচরণের মধ্যে দিয়ে, আরোপিত সংলাপের কচকচানির মধ্য দিয়ে নয়। গ্রাম পঞ্চায়েতের আর দুই সঙ্গী বিকাশ এবং প্রহ্লাদের চরিত্রের আনুগত্য ও আন্তরিকতা মনে করিয়ে দেয় কর্মক্ষেত্রে বিপদে বিষাদে আমরা এমনই মানুষদের আঁকড়ে ধরি। ‘পঞ্চায়েত’-এ গভীর আবেগপ্রবণ জায়গাগুলোও প্রত্যেক বার চমৎকার হাস্যরসের সূক্ষ্মতার ভেতরে সহজ দৃশ্যবিন্যাসে উপস্থাপিত।

এই ওয়েব সিরিজটি সহজ করে অনেক কঠিন কথা বলার চ্যালেঞ্জটায় দর্শকের মন জিতে নেবেই প্রত্যেক এপিসোডে। এক এক সময় মনে হবে কোনও চরিত্রই অভিনয় করছে না। এরা ফুলেরা এলাকারই মানুষ। এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় সবার। যিনি একটি দৃশ্য বা একটি এপিসোডে ছিলেন, সেই মানুষটিও। ছোট্ট পরিসরে শপিং মলের দৃশ্যে বা ফোন কলে অভিষেকের শহুরে কর্পোরেট বন্ধু প্রতীকের ভূমিকায় বিশ্বপতি সরকারও চলনে বলনে বোধে যথাযথ। যে বার বারই অভিষেককে উৎসাহ দেয়, ইতিবাচক ভাবাতে চেষ্টা করে, সর্বোপরি নিজের কাজটাকে ভালবেসে করতে বলে। শেষভাগে এসে মঞ্জুদেবী অর্থাৎ নীনা গুপ্তর জাতীয়সঙ্গীত শেখার অধ্যবসায় প্রমাণ করে তিনি হয়তো চরিত্রটিতেই বাস করছেন সারা ক্ষণ।

‘পঞ্চায়েত’-এ অসামান্য ভূমিকা সঙ্গীত পরিচালক অনুরাগ সইকিয়ার। তিনি গল্পের আবেগ ও প্যাশনকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন দৃশ্য ও প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এক আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে। রেশ রেখে যায় তার প্রাণবন্ত আন্তরিক গ্রাম্য সুরের ছোঁয়া। সিনেমাটোগ্রাফিতে অমিতাভ সিংহ প্রেক্ষাপট ও পারিপার্শ্বিককের সঙ্গে দর্শকের বন্ধুতা তৈরি করতে সফল।

একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, আটটি এপিসোড দেখার শেষে দর্শক দিন গুনবে ‘পঞ্চায়েত’-এর সিক্যুয়েলের অপেক্ষায়। টিভিএফ-এর প্রযোজনার অভিনব দিক এটাই যে তারা বার বার এমন বিষয় বেছে নেন যা আমাদের চারপাশেই আছে, যা খুব প্রাসঙ্গিক, যার মধ্যে আছে গ্রাম্য ভারতবর্ষের পারিপার্শ্বিকতা। প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিলেন তাঁরা। বাঙালি দর্শক হয়তো ‘পঞ্চায়েত’ দেখার পর ভাববেন, বাংলায় এমন কাজ কেন হয় না!

অন্য বিষয়গুলি:

Panchayat film Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy