Advertisement
E-Paper

ফাঁকা পকেটে চিন্তা শুধু ‘ধর্ম’

আমার আজকাল রাগ-ক্লান্তি এই দুটো অনুভূতি গুলিয়ে যায় মাঝেমাঝে। এদের উপর রাগ করব, সেও বড় ক্লান্তিকর কাজ। বললাম, “আমি বাংলায় কথা বলি। আমি কি তা হলে আপনার কথায় বাংলাদেশি?”

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৫ ০৫:৩৩
Share
Save

আপকো কহাঁ জানা হ্যায়?”

রাত খুব বেশি নয়। তবে বৃষ্টি-বাদলার জন্যই হয়তো অ্যাপ-ক্যাবে ওয়েটিং আর ওয়েটিং। পাক্কা আধ ঘণ্টা পরে মিলল গাড়ি। আর যখন পাওয়া গেল, পাঁচ মিনিটে সে আসছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দেখলাম ৩.৮ রেটিং। কেন এত কম রেটিং ভাবতে ভাবতেই ফোন এল। ‘কহাঁ জানা হ্যায়’? বললাম। চলেও এল গাড়ি। আর তার পর যা হল, তা এ রকম—

“আপ বঙ্গালি হো?”

“হ্যাঁ।”

“কলকাতা মে নন-বেঙ্গলি লোগোকো রহনে নেহি দে রহা হ্যায়।”

উপরের হিন্দি বাক্যের গঠনে ভুল থাকলে মার্জনা করবেন। কাজ চালানোর মতো হিন্দি বলতে পারি। চালক কাজ চালানোর মতো বাংলাও বলতে পারেন না। তাঁর রাগ, বাংলা না বলতে পারার জন্য তাঁকে হেনস্থা হতে হচ্ছে এই রাজ্যে। শুনে বললাম, আপনাকে কেমন হেনস্থা হতে হয়েছে জানি না, আপনার সুবিধার জন্য আমি হিন্দি বলছি। কিন্তু আমি যদি আপনার রাজ্যে যাই, আপনি কি আমার সুবিধার জন্য বাংলায় কথা বলবেন?

যা হোক, চালক মহাশয় দ্রুত ভাষা থেকে দিক বদলালেন। ২৫ মিনিটের পথ। ‘মস্তিষ্ক-প্রক্ষালন যন্ত্র’ (পড়ুন ওঁর গাড়ি)-এর হাতে ওইটুকুই সময়। ভাষা নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। সোজা ‘ধর্ম’-এ ডাইভ মারলেন। বললেন, এ রাজ্যে ‘একই অপরাধ’-এ অবাঙালিদের হেনস্থা করা হয়, আর একটি বিশেষ ধর্মের মানুষদের সব ছাড় দেওয়া হয়। (আমার আর প্রশ্ন করা হয়নি, হিন্দু বাঙালিদের সঙ্গে কী করা হয়।)

“মানে? কী রকম?”

“মানে বাংলাদেশিদের কিছু বলা হয় না। এখানে শুধু বাংলাদেশি।”

কারা বাংলাদেশি? কী করে বুঝলেন বাংলাদেশি?

উত্তরে বললেন, “কেন, যাঁরা বাংলায় কথা বলেন!”

আমার আজকাল রাগ-ক্লান্তি এই দুটো অনুভূতি গুলিয়ে যায় মাঝেমাঝে। এদের উপর রাগ করব, সেও বড় ক্লান্তিকর কাজ। বললাম, “আমি বাংলায় কথা বলি। আমি কি তা হলে আপনার কথায় বাংলাদেশি?”

এর পর আর কথা বলিনি। রাস্তায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে নারাজ। মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্রে যখন এক বার আমাকে পুরেছে, মগজ ধোলাই করতেই হবে।

একাই বলে যেতে শুরু করলেন। “ইঁহাপে সব বাংলাদেশি ভর গ্যয়া। জব কাশ্মীর হো জায়েগা, তব আপলোগোকা সমঝ আয়েগা।”

আমি চুপ।

“একটু খারাপ কথা বলছি ম্যাডাম, কাশ্মীরে কী হয়েছিল জানেন? ওরা বলেছিল মেয়ে-বৌদের রেখে দিয়ে চলে যাও। তার পর...”

আমি চুপ।

“শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় না থাকলে পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তানে চলে যেত।”

আমি চুপ।

“নাথুরাম গডসে ঠিক করেছিল। ওর শরীরে ক’টা গুলি ছিল জানেন!”

খুব ক্লান্তি-বিরক্তি নিয়েই বললাম, তবে প্রশংসাসূচক ভঙ্গিতে। “আপনি তো অনেক জানেন।” গদগদ চালক হাসছেন। “কোথা থেকে জানলেন এত সব?” বললেন, “কেন ২৫ জনের সঙ্গে কথা বললেই জানা যায়।” তা-ও ভাল, ওয়টসঅ্যাপ-এ জেনেছি, বলেননি। জানি লাভ নেই, তা-ও বললাম, দেশভাগ, স্বাধীনতা আন্দোলন, এ সব নিয়ে অসংখ্য বই আছে। একটু বই-ও পড়ুন।

তখন প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। চালকের মন খারাপ। আমাকে কিচ্ছু বোঝাতে পারেননি।

আবার জ্ঞান দিলাম। “আপনারা ধর্ম, জাত, ভাষা সব নিয়ে লড়ে মরুন। আর গরিব হয়ে থাকুন।”

শিক্ষায় দুর্নীতি, স্বাস্থ্যে দুর্নীতি, জিনিসপত্রের হুড়মুড়িয়ে বাড়া দাম, ট্রেনে ‘আউশভিৎসগামী রেল-কামরার’ মতো ভিড়। বিশ্বাস করুন, সম্প্রতি বেশ কিছু ট্রেনের এসি কামরার দৃশ্য দেখে আমার শিন্ডলার’স লিস্ট-এর সেই ট্রেনটার কথা মনে পড়ছিল। এ ভাবে এক জায়গা থেকে অন্যত্র যেতে হয় আমাদের! চাকরির বাজারের এই অবস্থা। এত হাহাকার। বড়লোকের ঘড়া উপচে যাচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। আর দিনের শেষে ফাঁকা পকেটে এটাই চিন্তা, এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম!

কী আশ্চর্য এখন আর মানুষ বই পড়েন না। প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই মনে করেন না। সব শুনে শুনে মুখস্থ! জন-শ্রুতি ধীরে ধীরে ‘বেদ-মন্ত্র’-এ পরিণত হচ্ছে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Religious Fundamentalism Scams

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}