চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে— কথাটি বহু ব্যবহারে জীর্ণ, নিঃসন্দেহে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দুই প্রধান শহর কলকাতা এবং হাওড়া প্রশাসনের পরিবেশ ও নাগরিক সুরক্ষা বিষয়ে প্রাথমিক ভাবনাচিন্তার বহর এবং বিপদ-অন্তে হঠাৎ তৎপরতা বৃদ্ধি দেখে অন্য কিছু ভাবা কঠিন। হাওড়ার বেলগাছিয়া ভাগাড়ে ধস নেমে সম্প্রতি যে বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুখীন হল সমগ্র এলাকা, জলের পাইপলাইন ফেটে তীব্র জলকষ্টের সম্মুখীন হতে হল বাসিন্দাদের— এই সমগ্র পরিস্থিতি সহজে এড়ানো যেত নগর-প্রশাসন যথাসময়ে ব্যবস্থা করলে। অথচ, একাধিক সতর্কবার্তার পরেও নির্বিকার থেকেছে প্রশাসন। বিপর্যয়ের পর সেখানে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী আবর্জনার পাহাড় কাটতে বায়োমাইনিং পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্যোগ করা হচ্ছে, বাসিন্দাদের অন্যত্র সরানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে, ভাগাড় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। অথচ, ২০০৩ সালেই কলকাতা হাই কোর্ট এই ভাগাড়কে অন্যত্র সরানোর নির্দেশ দিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। ২০০৮ সালে কলকাতা হাই কোর্ট হাওড়া পুরসভাকে নির্দেশ দেয় ভাগাড়ের জমি থেকে যাবতীয় জবরদখল উচ্ছেদ করে এলাকা দূষণমুক্ত করা এবং স্থানীয়দের সুরক্ষা বিধান করার। নির্দেশ ছিল ভাগাড়ের জন্য বিকল্প জমির সন্ধান করারও। অতঃপর রাজ্যে পালাবদল ঘটেছে। সেই সরকারও তিনটি পর্ব অতিক্রম করার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। কিন্তু বেলগাছিয়ার সেই ভাগাড় থেকে গিয়েছে তার স্ব-চরিত্রেই। ফলে যে বিপর্যয় সময়ের অপেক্ষা ছিল, সেটিই ঘটেছে।
একবিংশ শতকের আধুনিক একটি শহরে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা কেমন হতেই পারে না, হাওড়া সেটাই দেখিয়ে দিল। বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, তার কোনও আপৎকালীন সুরাহা সম্ভব নয়। হাওড়া পরিস্থিতিই তার প্রমাণ। বেলগাছিয়া ভাগাড়ে আবর্জনা ফেলা বন্ধ। বিকল্প ভাগাড়ের বন্দোবস্ত এখনও সম্ভব হয়নি। সুতরাং, শহরে জমে থাকা ১২০০ টনেরও বেশি আবর্জনা পুর প্রশাসনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমনই যে, হাওড়ার আবর্জনা ফেলতে ব্যবহার করা হচ্ছে কলকাতা পুরসভার ধাপাকে। এবং সমস্যা দেখা দিয়েছে আবর্জনা বহনকারী গাড়িগুলি নিয়েও। এত দিন হাওড়ার আবর্জনা ফেলার কাজ করত যে লরি ও ডাম্পারগুলি, তাদের নাকি অর্ধেকের ভগ্নদশা, কাগজপত্রও ঠিক নেই। অগত্যা ডাম্পার, জেসিবি ভাড়া নিয়ে শহরকে আবর্জনামুক্ত করা চলছে। এই জরাজীর্ণ পরিকাঠামো নিয়ে এত বছর ধরে এই বিরাট শহরে বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের কাজটি চলেছে, ভেবে আতঙ্ক জাগে।
আতঙ্ক লাগে কলকাতার ধাপা নিয়েও। এই অঞ্চলও বহু দিন পূর্বেই তার ধারণক্ষমতা অতিক্রম করে গিয়েছে। অবিলম্বে ময়লা ফেলার বিকল্প জায়গা স্থির না করলে বেলগাছিয়ার বিপর্যয় অনতিবিলম্বে নেমে আসতে পারে। কারণ, উৎস থেকে বর্জ্য পৃথকীকরণ এবং প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতিটি কলকাতায় এখনও পূর্ণমাত্রায় চালু হয়নি। সুতরাং, ধাপাতেও বর্জ্যের পাহাড় জমছে। সেখান থেকে কার্বন মনোক্সাইড ও মিথেনের মতো বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হওয়ার মাত্রাও উদ্বেগজনক। একাধিক বার এখানে আগুন লাগার খবরও মিলেছিল। উঠেছিল ‘দূষণ বোমা’র প্রসঙ্গও। সতর্কবার্তা উপেক্ষা করার পরিণতি দেখিয়ে দিয়েছে হাওড়া। কলকাতা পুরসভা প্রস্তুত তো?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)