ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
আইপিএল দেখছেন?
নাহ্। দেখা হচ্ছে না।
সেটা কি সৌরভ নেই বলে?
হ্যাঁ। রাতে যখন সৌরভ আর সানা লাস্ট ওভারগুলো দেখে, তখন দেখি। আর খেলা নিয়ে ওদের আলোচনা শুনি। ব্যস, ওইটুকুই।
গৌতম গম্ভীরকে কেমন লাগছে?
আমি অত খুঁটিয়ে দেখি না। খারাপ লাগে না। ঠিকঠাকই মনে হয়।
এখন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সব চেয়ে হট কে?
বিরাট কোহলিকে বেশ লাগে।
আর মহেন্দ্র সিংহ ধোনি?
ভালই তো চালাচ্ছে। আসলে সৌরভ কমেন্ট্রি করে বলে জানি ইন্ডিয়ার পরের কী কী সিরিজ আছে। ইংল্যান্ডে ইন্ডিয়া খেলবে। চারটে টেস্ট ম্যাচ আছে। আমি আসলে কোনটায় যাব সেটার জন্য জায়গাগুলো ওর কাছ থেকে জানতে থাকি। নিজের যাওয়ার জন্যই আমার এই আগ্রহ। এ ছাড়া কিছু না। ক্রিকেটের জগৎ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। যে সিরিজে সৌরভ যায় না, সেখানে কে জিতল, তার খবরও রাখি না আমি।
সৌরভ রাজনীতিতে এলেন না কেন?
সেটা আমি কী করে বলব? সেটা সম্পূর্ণ ওর বিষয়। তবে ও এখন ভীষণ ব্যস্ত। কাগজে ক্রিকেট নিয়ে লেখা, কমেন্ট্রির কাজ, ফুটবল টিমের মালিক, সিএবি ক্রিকেটের কোচিং, তার পর তিনটে চ্যানেল আর একটা রিয়্যালিটি শো-এর কাজ, সঙ্গে স্কুলের বিশাল দায়িত্ব— এত কিছু সামলে রাজনীতির জন্য আবার সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না বোধহয়।
সৌরভ রাজনীতিতে এলেন না বলেই কি আপনাকেও সেখানে দেখা গেল না? পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ সংস্কৃতি জগতের মানুষকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চে দেখা গিয়েছে। আপনাকে সেখানে দেখা যায়নি। কেন? আপনি কি সিপিএম?
নাহ্। বিষয়টা সিপিএম তৃণমূল নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চে যাওয়ার আমন্ত্রণ আমি পাইনি। কিন্তু ‘উদয়শঙ্কর ফেস্টিভ্যাল’ যা সরকার আয়োজেন করে, তাতে তো আমি অংশ নিয়েছি। আসলে রাজনীতির মঞ্চে তো শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রদর্শন সম্ভব নয়। শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রদর্শনের মঞ্চ হল ‘খাজুরাহো ফেস্টিভ্যাল’, ‘কোনার্ক ফেস্টিভ্যাল’, ‘ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স’।
কিন্তু আপনার মনে হয় না ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে সৌরভকে পেলে খেলার জগতের একটা পজিটিভ পরিবর্তন আসত?
সৌরভ অসম্ভব ভাল লিডার। ক্রীড়ামন্ত্রী হলে খেলার জগতের চেহারাটা অন্য রকম তো হতই। কিন্তু শুধু ক্রীড়ামন্ত্রী নয়, এটা আমার ব্যক্তিগত মত যে ও যেখানেই যাক, লিডার হিসেবে সেই ক্ষেত্রটাকে সঠিক ভাবে বদলে দিতে পারে।
সৌরভের জন্যই আপনার ক্রিকেট দুনিয়ায় প্রবেশ। কিন্তু ডোনার জন্য সৌরভ কখনও নাচের জগতে এসেছেন?
একটা মজার ঘটনা বলি। একবার হিন্দিতে ‘দীক্ষামঞ্জরী’-র তরফ থেকে ‘চিত্রাঙ্গদা’ করছি। ‘চিত্রাঙ্গদা’-য় ভাষ্যের জন্য আমি হন্যে হয়ে স্মার্ট হিন্দি জানা লোক খুঁজছি। সৌরভ হঠাৎই বলে উঠল “বাড়িতে স্মার্ট হিন্দি জানা লোক থাকতে তুমি বাইরে লোক খুঁজে বেড়াচ্ছ?” সৌরভ ‘চিত্রাঙ্গদা’য় আমার প্রোডাকশনে সে বার হিন্দিতে দারুণ ভাষ্যপাঠ করেছিল। এত অনায়াস ছিল, যে এক মুহূর্তর জন্যও মনে হয়নি ও আমার নাচের জগতের বাইরের কেউ। কোথাও আরোপিত লাগেনি।
কিন্তু রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’-য় আপনি ছৌ নাচ দেখিয়েছেন। ‘শাপমোচন’-এ কুলো, চামড় এই ধরনের প্রপস্ ব্যবহার করেছেন। এগুলো আরোপিত নয়?
রবীন্দ্রনাথ নিজেই তো নাচের ক্ষেত্রে কথাকলি, মণিপুরী, ভরতনাট্যম দিয়ে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করেছেন। ক্যান্ডি নাচ ভাল লেগেছিল বলে শান্তিনিকেতনে সেই ধারারও প্রচার করেছিলেন। আর ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যে অর্জুনের পৌরুষ, দীপ্তি বোঝাতেই ছৌ নাচ ব্যবহার করেছিলাম, বনবাসীদের সঙ্গে অর্জুনকে ছৌ-এর ফর্মে নাচিয়েছিলাম। দর্শকও সেটা ভীষণ এনজয় করেছিল। আমাদের প্রোডাকশন শুধু তো কলকাতা নয়, বহু বার বিদেশেও গিয়েছে। অনুষ্ঠানের মানটা ধরে রাখার একটা বিষয় থাকে। ‘শাপমোচন’-এ বিয়ের আমেজটাকে ধরে রাখতে কুলো নিয়ে সখীদের নাচিয়েছিলাম। আমাদের সমসাময়িক বাঙালিয়ানাকে যদি নাচের ক্ষেত্রে ধরতে চাই, তা হলে ক্ষতি কি? আমি নৃত্যনাট্যের টেক্সট তো বদলাচ্ছি না, বা রোলেক্সের শাড়ি বা কাঁচুলি পরিয়ে তো লাউড কিছু করছি না।
আপনার অরুণেশ্বর-কমলিকাও বেশ ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিমায়, নীল আলোয় কাছে আসে। আপনি কি রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের জায়গা থেকে এই বিষয়টাকেও একেবারে সাধারণ বলবেন?
দেখুন বরাবর যা হয়ে আসছে কেবল সেটাই করে যাব, নিজের শিক্ষা, মনন নিয়ে কিছু ভাবব না, এটা হতে পারে না। অরুণেশ্বর আর কমলিকার মিলনের নৃত্যভঙ্গিমায় যদি উভয়ের হাত নাই মেলে, মানে আমি বলতে চাইছি, তারা যদি ইন্টিমেট নাই হয় তো সেখানে প্রেম বোঝাব কেমন করে? রবীন্দ্রনাথের কথাতেই আছে তো কমলিকার এলো চুল অরুণেশ্বরের পায়ে লুটিয়ে পরল। আর নীল আলোর কথা বলছেন? অন্ধকারের রোম্যান্স দেখাতে গেলে নীল আলোর চেয়ে ভাল আর কিছু হয় না। আমরা নৃত্যনাট্যে নীল আলো ব্যবহার করার পরে সকলেই এখন দেখছি নৃত্যনাট্যে মঞ্চে নীল আলো ব্যবহার করছে।
ওড়িশির মতো শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীর ক্ষেত্রেও কি এক্সপেরিমেন্ট করেন আপনি?
আমার গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রর প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ আমি ওড়িশির ক্ষেত্রে কিছু বদল করি না। গুরুজির অন্য ছাত্রছাত্রীরা যদিও অনেক চেঞ্জ করেন। কিন্তু কলকাতায় গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রর প্রকৃত ঘরানা যদি কেউ শিখতে চান, জানতে চান, তা হলে আমার শিক্ষা পদ্ধতিই তাঁকে গ্রহণ করতে হবে। গুরুজি আমায় হাতে করে সব শিখিয়েছেন। ওঁর নৃত্যশৈলী আমার কাছে রেকর্ড করা আছে। তিরিশ বছর টানা আমি ওঁর কাছে নাচ শিখেছি।
নৃত্যশিল্পীরা প্রবল ঈর্ষাপরায়ণ হন। আপনাকে তেমন কিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি।
অনেকেই বলে আমি জানি, ও তো সৌরভের বৌ। ও আবার রবীন্দ্রনাথের ‘শাপমোচন’ কী করবে! একজন নৃত্যশিল্পী আমাদের প্রোডাকশন না দেখেই ফেসবুকে লিখলেন “সৌরভের বৌ তো, কিছু না শিখেই ঝলমলে জামাকাপড় পরিয়ে শাপমোচন করল”।
কে তিনি?
নাম দিয়ে কী হবে! আমি এ সব নিয়ে মাথা ঘামাই না। কারণ আমি জানি ‘দীক্ষামঞ্জরী-র রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের প্রোডাকশন কলকাতার যে কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভাল হয়।
তা হলে সৌরভের বৌ-এর ইমেজে নৃত্যশিল্পী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায় খানিক চাপা পড়ে যাচ্ছেন তো?
লোকে ভাবে সৌরভের বৌ, নাচের ভিত নেই, এমনই পাবলিসিটি পেয়ে যায়। এটা একদম ভুল। আমি ক্লাস টেনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ‘অ্যান্টিক্যুটি ফেস্টিভ্যাল’-এ স্বপ্ননায়িকা করেছি। চার বছর থেকে অমলাশঙ্করের কাছে নাচ শিখছি। সংস্কৃতি জগতের সকলেই আমায় নৃত্যশিল্পী হিসেবেই জানে।
কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তো আপনি ‘দাদা’-র বৌ। তাই নয় কি?
আমি সকলের কাছে ‘দাদার বৌ’ হয়ে থেকে গেলাম। ‘বৌদি’ ভেবে কেউ প্রেম করতেও এল না।
সৌরভের মহিলা ফ্যানদের কেমন করে সামলান?
সৌরভের মতো সেলিব্রিটির তো মহিলা ফ্যান থাকাটা এনজয় করি।
‘দাদাগিরি’তে তো সৌরভ বিয়ে, বৌ এসব নিয়ে বেশ মজার কমেন্ট করেন। কেমন লাগে?
আমার নামে ভীষণ বাজে কথা বলে সৌরভ। বৌ মানে খুব ভয়ের, এমন ভাব দেখায়। এটা একদম বাজে। আমি যদি ‘দাদাগিরি’ নিয়ে কিছু সমালোচনা করি, শোনে তো নাই, উল্টে বলে এ সব টিআরপি-র জন্য করতে হয়। একমাত্র তুমিই সমালোচনা করো আমার। সবাই তো ভাল বলে।
এ রকম তো অনেক সময় হয়েছে যে সৌরভের খেলা আর আপনার নাচের অনুষ্ঠান এক দিনে পড়েছে। কাকে বেছেছেন তখন?
সিরিজ থাকলে আমি সৌরভের সঙ্গেই গিয়েছি। আসলে নাচের ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানগুলো রিপিট করে। একবার মিস করলে পরের বছর করাই যায়।
ক্রিকেটের বাড়িতে নৃত্যশিল্পীকে স্যাক্রিফাইস করতে হয় না?
আমার শ্বশুরবাড়িকে শুধু ক্রিকেটের বাড়ি বললে ভুল হবে। আমার জা, ননদ সকলেই নাচত। আমাদের পাশাপাশি বাড়ি ছিল। তাই অনেক ছোট থেকেই ওঁরা আমাকে নাচতে দেখেছেন। সকলের ক্ষেত্রেই বিয়ের পর প্রথম দিকে অ্যাডজাস্ট করতে অসুবিধা হয়। আমারও হয়েছিল। আর কিছু স্যাক্রিফাইসও করা উচিত বলে আমি মনে করি।
উচিত কেন?
একবার একটা ডান্স ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার দিন সানার শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়। মা হিসেবে ওকে ফেলে কি আমি যেতে পারি? আমাকে অনুষ্ঠান বাতিল করতেই হয়েছিল। সৌরভের বাবা যখন মারা যান, তখনও উদয়পুর ফেস্টিভ্যালে যাইনি। এটা করতেই হবে।
মনখারাপ হয় না? কী করেন তখন?
মনখারাপ তো হয়। একটা ঘটনা বলি। আমার বিয়ের পর প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে আমি সৌরভের সঙ্গে গিয়েছি। আর সঙ্গীতা, আজহারউদ্দিনের সঙ্গে। তখন খুব কাছে থেকে দেখেছি সঙ্গীতাকে। লক্ষ করতাম মনখারাপ হলেও ও বলত, শপিং-এ যাই। আবার খুব খুশি হলেও বলত, শপিং করে আসি। আমার মনখারাপ হলেও ওর এই নিজেকে ভাল রাখার স্পিরিটটা আমায় মোটিভেট করে। মনখারাপ হলে বা আনন্দ হলেও আমিও শপিং করি, সিনেমা দেখি। সৌরভও খুব সিনেমা দেখতে পছন্দ করে।
নিউ এজ বাংলা ছবি দেখেন?
নাহ্, বাংলা ছবি সে ভাবে দেখি না। আজও বাংলা ছবি মানে আমার কাছে উত্তম-সুচিত্রার রোম্যান্স। তবে হিট বাংলা ছবি দেখি। যেমন ‘গয়নার বাক্স’ দেখেছি।
সম্প্রতি কী দেখলেন?
‘টু স্টেটস্’। তবে আলিয়া ভট্ট-এর চেয়ে দীপিকা পাড়ুকোন, করিনা আর রণবীর কপূর আমার খুব প্রিয়।
সৌরভের বৌ না ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়? কী ভাবে সকলের মনে থেকে যেতে চান?
সৌরভের বৌ আর নৃত্যশিল্পী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়— দুই সম্বোধনেই আমি সকলের মনে থাকতে চাই। তবে সানার মা হিসেবে থেকে যেতে পারলে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy