কঠিন পথে। লেবু জলে চুমুক বহরমপুরের কংগ্রেস প্রার্থী মনোজ চক্রবর্তীর (বাঁয়ে), জলে একটু লেবু দিয়ে নেওয়া মুর্শিদাবাদের বিজেপি প্রার্থী গৌরীশঙ্কর ঘোষের (মাঝে), ডাবে জলে গলা ভেজাচ্ছেন মুর্শিদাবাদের তৃণমূল প্রার্থী অসীম ভট্ট (ডান দিকে)। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে পদ্মা।
কখনও ভাঙন নিয়ে হাহাকার, ভেসে গিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। পরে জেগে ওঠা চর নিয়ে চুলোচুলি।
বর্ষায় ইলিশের বান। এলাকার বাজার চাঙ্গা। বিরোধী আর শাসকের কাছে তাই পদ্মাই ভোটের মন্ত্র।
শাসক দল চোঙা ফুঁকে বলতে থাকে— ভাঙন রোধ করেছি, চরের মানুষকে পাট্টা দিয়েছি, পদ্মায় মাছ ধরার জন্য পরিচয়পত্র বানিয়ে দিয়েছি মৎস্যজীবীদের।
বিরোধীদের পাল্টা চিৎকার— ভাঙনে সবর্স্বান্ত মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, পাট্টার নামে দলবাজি চলছে, মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে গিয়ে মার খাচ্ছেন বিএসএফের হাতে।
শেষ কথা— অন্য দলকে একটিও ভোট নয়, পদ্মায় ছুড়ে ফেলে দিন।
গোটা জলঙ্গি বিধানসভা এলাকার পূর্ব পার হয়ে একেবেঁকে বয়ে গিয়েছে পদ্মা। কোথাও আবার ছুঁয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের মাটি। কোথাও মাঝ পদ্মায় ভাগ হয়েছে এ দেশ-ও দেশ। এক সময়ে রাজনীতির কারবারিদের মতই এই পদ্মা ভরসা ছিল এলাকার চোরাকারবারীদের। মূলত পদ্মাকে ভর করেই হাজার কারবার চলত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পদ্মা বদলেছে গতি, বদলেছে চলার পথ। আর তার কবলে পড়ে একের পর গ্রাম সবর্স্বান্ত হয়েছে। আটচালা দালানবাড়ি থেকে দোতলা স্কুল চোখের নিমেষে তলিয়ে গিয়েছে তার তলায়। কেবল গ্রাম নয়। ১৯৯৪ সাল নাগাদ জলঙ্গি বাজারেও হানা দিয়েছিল পদ্মা। বড় স্কুলবাড়ি, থানা থেকে অফিস-কাছারি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মন্দির-মসজিদ সবই তলিয়ে যায়।
আর সেই সময় থেকেই পদ্মা নিয়ে রাজনৈতিক তরজা বাড়তে থাকে। ওই ঘটনায় তৎকালীন বাম নেতারা মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়ে নিজেদের ঘাঁটিতেও অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। পরে পাড় বাঁধিয়ে পদ্মাপাড়ে একটি অতিথি নিবাস গড়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়। চর এলাকায় পার্ক থেকে অতিথি নিবাসের মতো নানা রকম পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছিল। বাম জমানার শেষ হতেই সব কিছু থমকে যায়।
এখানেই থেমে থাকেনি পদ্মার গল্প। ১৯৯৮ সালের ১৩ জানুয়ারির এক কুয়াশাচ্ছন্ন এক ভোরে লালবাগ থেকে পিকনিক সেরে বাড়ি ফেরার পথে বিপজ্জনক একটি বাঁকে উল্টে যায় ছাত্রছাত্রী বোঝাই একটি বাস। মৃত্যু হয় ৬৩ জনের। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, তখনকার বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এলাকায় এসে হইচই বাধিয়ে দেন। তাঁর প্রশ্ন, কেন পদ্মাপাড় দেওয়ালে ঘেরা হয়নি? কেন দেওয়া হয়নি ‘সাবধান, সামনে বাঁক’ লেখা বোর্ড। নিজেই দলের কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে তিনি বোর্ড লাগিয়ে দেন।
ওই ঘটনায় রক্তচাপ বাড়তে থাকে সিপিএমের। পরে পাড় বাঁধানো থেকে শুরু করে বড়-বড় করে লাল অক্ষরে ‘সাবধান’ লেখা হয় রাজ্য সরকারের তরফে। আমলাশোলের অনাহার-মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই পদ্মার ভাঙন এবং উপদ্রুত মানুষদের দারিদ্র্যের ছবি সামনে উঠে আসে।
বস্তুত, পদ্মার ভাঙন নিয়ে রাজনীতি চিরকালই চলে এসেছে। কিন্তু তাতে বামেদের ভোটব্যাঙ্কে বিশেষ প্রভাব পড়েনি। সেই ১৯৭৭ সাল থেকে টানা তারা জলঙ্গি কেন্দ্র নিজেদের দখলে রেখেছে। ২০১১ সালে রাজ্য জুড়ে বাম ভোটে ধস নামলেও পদ্মাপাড়ের এই কেন্দ্রে তারা ৩৭ হাজারেরও বেশি ভোটে জেতে।
গত বিধানসভা ভোটেও জলঙ্গিতে লড়াই ছিল ত্রিমুখী। তৃণমূল নেত্রী কলকাতা থেকে ইদ্রিশ আলিকে উড়িয়ে এনেছিলেন। প্রচারে এসে বলেছিলেন, জলঙ্গিকে ইদ্রিশের চোখ দিয়েই দেখবেন। কিন্তু কংগ্রেস জোটধর্ম ভেঙে গোঁজ গুঁজে দেওয়ায় হাফ সেঞ্চুরিও করতে পারেনি তৃণমূল। গোঁজপ্রার্থীই ২৬ হাজার ভোট টেনে নেন। লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস আর তৃণমূল লড়ে। প্রায় ৫২ হাজার ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আসে কংগ্রেস। তৃণমূল পায় ৪০ হাজার ভোট। ৬৬ হাজার ভোট পেয়ে সিপিএম এগিয়ে ছিল অনেকটা। গ্রাম পঞ্চায়েতের নিরিখে অবশ্য কংগ্রেস- সিপিএম সমান সমান। দু’জনেরই দখলে ৬টি করে গ্রাম পঞ্চায়েত, তৃণমূলের দখলে ২টি।
এ বার কংগ্রেস-সিপিএম জোট হওয়ায় অবশ্য এই সব হিসেব-নিকেশ কার্যত অবান্তর হয়ে গিয়েছে। বরং যে সব কেন্দ্রে জোটপ্রার্থীর রেকর্ড ভোটে জেতার সম্ভাবনা, তার মধ্যে জলঙ্গি একটি। মজবুত জোটের হাওয়ায় ফুরফুরে মেজাজে সিপিএম প্রার্থী আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল বলছেন, ‘‘এলাকার তৃণমূল নেতারা মুখপোড়া। তাঁদের কাউকে দল প্রার্থী করতে পারেনি। ১৯ মে ফলর বেরনোর পরে দিদির প্রার্থীও মুখ পুড়িয়ে পদ্মায় ঝাঁপ দেবেন।’’ তৃণমূলের প্রার্থী, কলকাতা থেকে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ অলোক দাস অবশ্য দাবি করছেন, সব অঙ্ক ঘেঁটে দিয়ে তিনি জিতবেন। তাঁকে জেতালে জলঙ্গির অলিগলি-নর্দমা সবেতেই উন্নয়নের বান ডাকিয়ে দেবেন, বলে গিয়েছেন খোদ দিদি।
আপাতত, একমুখ হাসি হেসে অলোক বলছেন, ‘‘মানুষ উন্নয়নের স্রোতে ভাসছে। জয় কেবল সময়ের অপেক্ষা। প্রচারে গেলে আমাকেই বিধায়ক ভেবে মানুষ দাবি করছেন, এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। তাঁদের বোঝাতে পারছি না, বিধায়ক হতে আরও কয়েকটা দিন সবুর করতে হবে আমায়।’’
তবে জলঙ্গির কথার চল রপ্ত করে নিয়েছেন ‘বহিরাগত’ অলোকও।
বলছেন— ‘‘দেখুন না, এ বার মানুষ ওদের পদ্মায় নিয়ে ফেলবে।’’
শুনে হাসছেন জলঙ্গি ব্লক কংগ্রেস সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক। বলছেন, ‘‘উনি বরং এই ক’টা দিনে সাঁতারটা শিখে রাখুন। মাঝপদ্মায় পড়লে উঠে আসতে হবে তো!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy