সব ক’টি পঞ্চায়েত দখলে। পঞ্চায়েত সমিতি থেকে জেলা পরিষদ আসন, সে সবও হাতে রয়েছে। পুরভোটে এলাকায় আধিপত্য কায়েমের পরে এখনও বছর ঘোরেনি। এ বার তাই জামুড়িয়া বিধানসভা আসনটি পাখির চোখ করেছিল তৃণমূল। কিন্তু এ বারও ফিরতে হল খালি হাতে। সাত হাজারেরও বেশি ভোটে সিপিএমের কাছে হারের কারণ হিসেবে তৃণমূলের অন্দরে উঠে আসছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথাই। তৃণমূল সূত্রের খবর, এই কেন্দ্র নিয়ে ইতিমধ্যে রিপোর্ট চেয়েছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৭৭ সাল থেকে জামুড়িয়া কেন্দ্রটি টানা বামেদের হাতে রয়েছে। গত বার প্রায় চোদ্দ হাজার ভোটে জেতেন সিপিএমের জাহানারা খান। এ বারও এখানে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী ছিলেন তিনি। তৃণমূল প্রার্থী করেছিল দলের আসানসোল জেলা সভাপতি ভি শিবদাসনকে। তবে তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, এই শিল্পাঞ্চলে মোট চারটি আসন খোয়ালেও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব দুর্গাপুর পূর্ব ও জামুড়িয়ায় হার নিয়ে বেশি চিন্তিত। সে জন্য নিরপেক্ষ রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়েছে।
তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অনেকেই মনে করছেন, জামু়ড়িয়ায় হারের পিছনে মূল কারণ অন্তর্কলহ। তাঁদের দাবি, এই শিল্পাঞ্চলে দলের সংগঠনে মলয় ঘটকের অনুগামীদের প্রভাব দীর্ঘ দিনের। শিবদাসন শিল্পাঞ্চল সভাপতি হওয়ার পরে তাঁর গোষ্ঠীরও প্রভাব বাড়ছিল। দু’পক্ষের লোকজনের মধ্যে বিবাদও বেধেছে। তৃণমূলের এক জেলা নেতার কথায়, ‘‘পুরভোটে শিবদাসনকে জামুড়িয়ার দায়িত্ব দেওয়ার পরে সেখানে ভাল সাফল্য মেলে। তার পরে দলীয় নেতৃত্ব আসানসোলের মেয়র হিসেবে বেছে নেন জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে, যিনি শিবদাসনের ঘনিষ্ঠ। এর পরেই গোষ্ঠী-অসন্তোষ বেড়েছে। এর পরে আবার শিবদাসনকে জামুড়িয়ায় প্রার্থী করায় কর্তৃত্ব হারানোর আশঙ্কায় ভুগছিল দলের একটি অংশ।’’
তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, জামুড়িয়ায় দলের নেতা পূর্ণশশী রায়, তাপস চক্রবর্তী, সুকুমার ভট্টাচার্য, অলোক দাসদের প্রভাব রয়েছে। পূর্ণশশীবাবু শিবদাসনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। দলের একাংশের ধারণা, অন্য সব গোষ্ঠী ভোটে ঠিক মতো ময়দানে নামেনি। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ফল বেরনোর পরে স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতার নেতৃত্বে ঢাক বাজিয়ে মিছিল হয় এলাকায়। শিবদাসন জানান, দলনেত্রী তাঁকে ফোন করেছিলেন। হারের কারণ নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে পাঠাতে বলেছেন। অন্তর্ঘাতের বিষয়টি কী ভাবে অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে তা তথ্য-সহ বিশদে জানানো হবে বলে জানান তিনি।
শিবদাসন জানান, জামুড়িয়া শহরের ১৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪, ১০, ১২ ও ৩২ নম্বর ছাড়া অন্য কোথাও তিনি এগোতে পারেননি। ১০টি পঞ্চায়েত এলাকায় যেখানে ২০১৪-র লোকসভা ভোটেও ৫ হাজারের বেশি ভোটে তারা এগিয়ে ছিলেন, সেখানে এ বার মাত্র ৬৪২ ভোটে এগিয়ে থেকেছেন। শিবদাসন বলেন, “রাজ্য নেতৃত্ব আমাকে জামুড়িয়ায় দলের জেলা কার্যালয়ের একটি ইউনিট চালু করার নির্দেশ দিয়েছে। সেখানেই আমাকে বেশি সময় থাকতে বলা হয়েছে। কারণ, জামুড়িয়ায় গোষ্ঠীশূন্য, মজুবত সংগঠন তেরি করতে হলে এ ছাড়া কোনও উপায় নেই।’’ যাঁরা অন্তর্ঘাতে জড়িত দল তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবে বলেও দাবি তাঁর। মলয়বাবুর সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তাপসবাবু, অলোকবাবুরা ভোটে কোনও অন্তর্ঘাতে জড়িত থাকার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন।
সিপিএমের অবশ্য দাবি, বরাবর জামুড়িয়ার মানুষের পাশে থাকার ফল মিলেছে ভোটে। দলের অজয় জোনাল সম্পাদক মনোজ দত্তের কথায়, ‘‘আমরা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মানুষের পাশে থেকে আন্দোলন করেছি। স্কুলভোট ও পুরভোটে শাসক গোষ্ঠীর রিগিং, সন্ত্রাসের জন্য মানুষ ভোট দিতে পারেননি। সেটা মানুষ মেনে নিতে পারেননি। তাই ভোট দিতে পেরেই আবার আমাদের বেছে নিয়েছেন।’’ মনোজবাবু দাবি করেন, জামুড়িয়ার শিল্পতালুকে একটি কারখানাতেই খাতায়-কলমে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। যাঁরা দায়িত্ব আছেন তারা শ্রমিকদের হয়ে কাজ করেন না। মনোজবাবু বলেন, ‘‘শ্রমিকেরা আমাদের নৈতিক সমর্থন নিয়ে এই পাঁচ বছর দাবি আদায় করে আসছে। তাই আমরা হারিনি।”
এলাকার তৃণমূল কর্মীদের একাংশেরও দাবি, শ্রমিক সংগঠন গড়ায় গুরুত্ব না দিয়ে সিন্ডিকেটের নামে কারখানা থেকে সুবিধা আদায় ও কয়লা কারবারিদের নিয়ে জনা কয়েক নেতার তোলাবাজি, দৌরাত্ম্য মানুষ মেনে নিতে পারেননি। ভোটের প্রচারেও সেই সব নেতাদের দেখা যাওয়ায় দলের ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়েছে। শিবদাসন বলেন, “সব ধরনের অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy