Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

এঁরা চাইছেন পতন, ওঁরা দেখছেন উত্থান

বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী! স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন— নারায়ণগড় তাঁর চাই-ই চাই! উল্টো দিকে প্রধান বিরোধী দলের রাজ্য সম্পাদক এবং বিরোধী শিবিরের সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীর নারায়ণী সেনাও প্রস্তুত! আদিবাসী পাড়ায় মিছিলে মিছিলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, ‘‘উনাকে জিতাতে না পারলে গোটা রাজ্যের লোক গায়ে থুতু দিবে!’’

জনজোয়ারে। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রকে প্রচার-গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন কর্মী-সমর্থকেরা। শনিবার নারায়ণগড়ে সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।

জনজোয়ারে। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রকে প্রচার-গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন কর্মী-সমর্থকেরা। শনিবার নারায়ণগড়ে সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।

সন্দীপন চক্রবর্তী
নারায়ণগড় শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:২৪
Share: Save:

বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী!

স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন— নারায়ণগড় তাঁর চাই-ই চাই! উল্টো দিকে প্রধান বিরোধী দলের রাজ্য সম্পাদক এবং বিরোধী শিবিরের সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীর নারায়ণী সেনাও প্রস্তুত! আদিবাসী পাড়ায় মিছিলে মিছিলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, ‘‘উনাকে জিতাতে না পারলে গোটা রাজ্যের লোক গায়ে থুতু দিবে!’’

উনি মানে সূর্যকান্ত মিশ্রের সামনে সুযোগ ছিল। কিন্তু যুদ্ধের জন্য নিরাপদ প্রান্তর বেছে নিতে তিনি অস্বীকার করেছেন। প্রথা ভেঙে ভোটে দাঁড় করিয়ে সিপিএম তার রাজ্য সম্পাদককে এগিয়ে দিয়েছে অরক্ষিত এক ময়দানে। যেখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুভেন্দু অধিকারী বারেবারে শুনিয়ে যাচ্ছেন, ৫০ হাজারে হারাব এ বার। পাল্টা কোমর বেঁধেছেন তরুণ রায়েরাও। তাঁরা জানেন, রাজ্য সম্পাদক লড়ছেন মানে গোটা সিপিএমের ইজ্জতের লড়াই। নারায়ণগড় আসলে এখানে স্রেফ ঘটনাচক্র। একটা জায়গার নাম শুধু। লড়াইটা কিন্তু হচ্ছে গোটা রাজ্যের ক্যানভাসে।

তৃণমূলের শুভেন্দু হুঙ্কার দিয়েছেন, ‘‘গর্তে পড়েছেন সূর্যবাবু। সেখান থেকে তাঁকে টেনে তোলার মতো কোনও ক্রেন এখনও আবিষ্কার হয়নি!’’ বলে রাখা যাক, গর্ত বেশ গভীর। পঞ্চায়েত ভোটের হিসেব ধরলে প্রায় ১৩ হাজার এবং বিগত লোকসভা নির্বাচনের তথ্য হাতে নিলে ২৬ হাজার ৮০০ ভোটে তৃণমূল এগিয়ে। লোকসভা ভোটে অবশ্য ভূতের উপদ্রব ছিল। বিধানসভায় বিরোধী পক্ষের সেনাপতিকে মাটিতে পুঁতে ফেলার তাড়নায় তেনাদের আবার দেখা মিলতে পারে, সে আশঙ্কাও রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ভারতী ঘোষ— কেউই কোনও চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না।

উল্টো দিকে ভাঙা পাঁজর নিয়েও সাহসে ভর করে লড়াইয়ের প্রস্তুতি চলছে। পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকেই যেখানে গুটিয়ে গিয়েছিল সিপিএম, একের পর এক কার্যালয়ে উড়েছিল তৃণমূলের পতাকা, সেখানে সংখ্যায় স্বল্প হলেও কিছু জেদী মুখ বাইরে বেরোচ্ছে। তাদের একটাই কথা— রাজ্য সম্পাদককে বিধানসভায় ফেরত পাঠিয়ে তৃণমূলের মুখে ঝামা ঘষতে হবে! তার জন্য ভোটারদের বুথে টেনে আনতে হবে, প্রয়োজনে ভূতের তাণ্ডব রুখতে হবে। মমতা যখন এসে বলে গিয়েছেন, ‘‘এত বড় সাহস! আমাদের সবাইকে চোর বলে। নিজে চোরেদের সর্দার! পাঁচ বছর ধরে কুৎসা করছে। মিশ্রবাবুকে জিততে দেওয়া যাবে না!’’ তখন উল্টো দিকের রোখও যাচ্ছে বেড়ে। সূর্যবাবুর নির্বাচনের অন্যতম ভারপ্রাপ্ত নেতা ভাস্কর দত্ত বলছেন, ‘‘নারায়ণগড় আমরা জিতব! গোটা পশ্চিমবঙ্গ দেখবে।’’

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

খুব বেশি কিছুই কি এ বার বাজি রাখা হয়ে গেল না? একে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট। কোনও কারণে জোট ভোটে ব্যর্থ হয়েছে কী দলের ভিতরে-বাইরে ছুরি-তলোয়ার নিয়ে লোক বেরিয়ে পড়বে! তার উপরে আবার এই রকম আসনে লড়াই! বেলদা জোনাল অফিসের দোতলায় ছোট্ট ঘরে ছত্রিভাঙা খাটে বসে সূর্যবাবু বলছেন, ‘‘কিচ্ছু ছুরি-তলোয়ার বেরোবে না! ইতিহাসে ওই রকম দোষারোপ দাঁড়ায়নি কখনও। মানুষ যা চায়, সেটাই হবে।’’ কিন্তু এই কঠিন ভোটটা? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের জবাব, ‘‘অঙ্ক সব সময় শেষ কথা বলে না। বিধায়ক হব ভেবে তো পার্টিতে আসিনি। অনেক ব্যাপারেই দলের মধ্যে সংখ্যালঘু ছিলাম। রবি ঠাকুরের কথা মেনে সত্যকে সহজে নেওয়ার চেষ্টা করি শুধু! যখন যেমন পরিস্থিতি এসেছে, মোকাবিলা করেছি।’’

সূর্যবাবুই গল্প বলছেন, ‘‘যখন ডাক্তারি পড়তাম, অন্য কেউ ফাঁকি দিলেই দুই বন্ধু মিলে ইমারজেন্সি ডিউটি নিতাম। তা থেকে অনেক কিছু শেখা যেত। চ্যালেঞ্জ থেকেই সত্যের কাছাকাছি যাওয়া যায়। যদিও চরম সত্যি বলে কিছু হয় না!’’

তৃণমূল অবশ্য মনে করছে, নারায়ণগড়ের পতনই এ বার তাদের জন্য চরম সত্য হতে চলেছে! এমনিতে নারায়ণগড়ে তৃণমূলকে দেখলে মনে হবে, তারা এখনও বিরোধী দল! কথায় কথায় শুধুই ৩৪ বছর। গত বার পরিবর্তনের বাজারে সূর্যবাবুর বিরুদ্ধে দাঁড়়িয়ে যিনি হেরেছিলেন, তৃণমূলের সেই নেতা সূর্য অট্ট বলছেন, ‘‘পাঁচ বছর আগে শুধু মকরমপুর অঞ্চল থেকে লিড না পাওয়ায় হেরে গিয়েছিলাম। এ বার তেমন হবে না। সিপিএমের হার নিশ্চিত।’’ এ বারের প্রার্থী, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোৎ ঘোষও ভয়ানক আশাবাদী। তৃণমূল নেত্রী অবশ্য প্রদ্যোৎবাবুকে খানিক পথে বসিয়েই গিয়েছেন! বলেছেন, জিতে প্রদ্যোৎ বিধায়ক হতেই পারেন। কিন্তু মিহির চন্দ, কৌসর আলিদের সঙ্গে আলোচনা করে এখানে কাজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন মমতা। তা হলে আর প্রার্থীর গুরুত্ব কী— প্রশ্ন উঠেছে দলেই। আর সূর্য-কৌসর-প্রদ্যোতেরা কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারেন না, এমন অভিযোগ নারায়ণগড়ে কারও নেই!

ধর্মযুদ্ধে নিজের কুরুক্ষেত্র ছুঁয়ে যাবেন বলে রাজ্য জুড়ে প্রচারের মাঝে মাঝেই এখানে ঘুরে গিয়েছেন সূর্যবাবু। পথে এক দিন তাঁর গাড়ি থামিয়ে এক দঙ্গল মহিলা বলেছেন, নারায়ণগড় নিয়ে ভাবতে হবে না। আপনি রাজ্যটা দেখুন।

রাজ্য আসলে দেখছে নারায়ণগড়কেই! এমনিতেই মেদিনীপুর যুদ্ধের মাটি। তায় এমন রাজসিক সংঘাত! এখানে মেদিনী ছাড়ে কে?

আরও পড়ুন:
উল্টে দেবেন না তো! সূর্যকে হারানোর আবদার করেও শঙ্কিত তৃণমূল নেত্রী

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE