Advertisement
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আর কত ছাড় অনুব্রতকে, চাপে পড়ে শহরে ফুল বেঞ্চ

লোকসভা ভোটের মতো বিধানসভা ভোটেও অনুব্রত মণ্ডল যাতে তাদের গোলের মালা পরাতে না পারেন, সে জন্য নড়েচড়ে বসল নির্বাচন কমিশন। আগামী রবিবার বীরভূমে ভোটের দিন বিরোধীদের ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন অনুব্রত।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৫৬
Share: Save:

লোকসভা ভোটের মতো বিধানসভা ভোটেও অনুব্রত মণ্ডল যাতে তাদের গোলের মালা পরাতে না পারেন, সে জন্য নড়েচড়ে বসল নির্বাচন কমিশন। আগামী রবিবার বীরভূমে ভোটের দিন বিরোধীদের ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন অনুব্রত। বুধবার আনন্দবাজারে সেই খবর প্রকাশিত হওয়ার পরেই সফরসূচি পাল্টে বৃহস্পতিবার কলকাতায় আসার কথা ঘোষণা করল নির্বাচন কমিশন। তৃতীয় দফায় উত্তরবঙ্গের ৪৫টি আসনে ভোট থাকলেও, বীরভূমের ১১টি আসনকে পাখির চোখ করেই তাদের এই সফর বলে নির্বাচন সদন সূত্রের খবর।

অনুব্রতর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের কাছে প্রথম অভিযোগটি দায়ের করেন ময়ূরেশ্বরের বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়। তিনি সিউড়িতে নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুব্রতকে গ্রেফতারের দাবি জানান। পরে কলকাতায় শিশির বাজোরিয়ার নেতৃত্বে বিজেপির প্রতিনিধিদল মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের কাছে গিয়ে একই দাবি জানিয়েছে। অনুব্রত অবশ্য বলছেন, ‘‘আমি চোর না ডাকাত, যে আমাকে গ্রেফতার করতে হবে?’’

বিরোধী কোনও দলের এজেন্টকে বীরভূমের ১১টি কেন্দ্রের কোনও বুথেই বসতে দেবেন না, এ কথা গত কয়েক দিন ধরেই বলে আসছেন অনুব্রত। বিরোধী প্রার্থীদের হুমকিও চলছে অনবরত। তার পরেও কমিশন হাত গুটিয়ে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। লকেট সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যের পরে কমিশন কেষ্টকে স্রেফ ভর্ৎসনা করে ছেড়ে দেওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ। অনুব্রতর বুধবারের মন্তব্য নিয়ে কমিশনের উপরে তাই চাপ বাড়াতে চান বিরোধীরা।

কমিশন সূত্রেও খবর, নির্বাচনের দিন বিরোধী ভোটারদের বাড়ি থেকে বেরোতে দেওয়া হবে না— এই হুমকিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখছে কমিশন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী এ দিন ভিডিও কনফারেন্সে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক সুনীল গুপ্ত-সহ অন্য অফিসারদের কাছে জানতে চান, অনুব্রত মণ্ডলের মতো নেতারা একতরফা ভোট করানোর হুমকি দিলে কেন তাঁদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়নি? এ ছাড়াও আর চার দফা প্রশ্ন তোলেন জৈদী। (গ্রাফিক্স দেখুন)

কিন্তু রাজ্যের অফিসারদের জবাবে তিনি খুশি নন বলেই কমিশন সূত্রে খবর। পরবর্তী পর্যায়ের ভোট নিয়ে তাঁর সংশয়ও কাটেনি। সেই কারণেই তড়িঘড়ি কলকাতা আসার সিদ্ধান্ত বলে জানান কমিশনের এক কর্তা। তাঁর মতে, অনুব্রত যে ভাবে ভোটের দিন বিরোধীদের ‘ম্যাজিক করে ভ্যানিশ’ করার কথা বলেছেন, তাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে কমিশন। ১৭ এপ্রিল কী ভাবে সেই ‘ম্যাজিক’-এর মোকাবিলা করতে হবে, কলকাতায় এসে সেই নির্দেশই দিয়ে যাবে ফুল বেঞ্চ।

পাশাপাশি, ভ্যানিশ-মন্তব্য নিয়ে এ দিন অনুব্রতকে শো-কজ করার তোড়জোড় শুরু করেছে কমিশন। রাজ্যের উপমুখ্য নির্বাচনী অফিসার দিব্যেন্দু সরকার বলেন, ‘‘অনুব্রত মণ্ডলকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হবে। তাঁর জবাব পেয়ে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।’’ বস্তুত, এ দিনই অনুব্রতকে নোটিস পাঠানোর কাজ শুরু করেছিলেন বীরভূমের জেলাশাসক পি মোহনগাঁধী। কিন্তু রাতে তাঁকে নোটিস না পাঠিয়ে কমিশনের কাছে অনুব্রতর মন্তব্য সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ-সহ সবিস্তার রিপোর্ট পাঠাতে বলা হয়। ওই রিপোর্ট পাওয়ার পরে কমিশনই যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে বলে জানা গিয়েছে।

কমিশন সূত্রের খবর, আজ ফুল বেঞ্চের বৈঠকে অনুব্রতর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। তাঁর কাছ থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া, এমনকী ভোটের দিন আটক করার কথাও ভাবা হচ্ছে বলে জানান কমিশনের এক কর্তা।

কমিশন তেড়েফুঁড়ে ওঠায় চাপ তৈরি হচ্ছে অনুব্রতর উপরেও। তাই এ দিন সকালে বোলপুরের নিচুপট্টিতে নিজের ডেরায় বসে, ভিজে সুপারি খেতে খেতে যে কেষ্ট (অনুব্রতর ডাকনাম) বলেছিলেন, ‘‘ভোট আমার কাছে ফুটবল ম্যাচ। ভাল গোলকিপার ছিলাম। গোল কী করে আটকাতে হয় জানি। প্রতিপক্ষ যে-ই হোক, গোলে দাঁড়িয়ে আছি আমি!’’ সেই তিনিই বিকেলে সাংবাদিক বৈঠকে কেন বলবেন, ‘‘বাম আমলের ভোটে মারামারি-খুনোখুনি হতো। মানুষ চোখে দেখত। কিন্তু বামফ্রন্টের নেতারা বলত, ‘কই, আমরা তো কিছু দেখিনি’। তার মানে, উনারা ভ্যানিশ করে দিত। এটা বলতে গিয়েছিলাম। সেটা চাপিয়ে দেওয়া হল আমার নামে।’’

গুড়-জল দিয়ে ভোট করানোর কথা বলে ‘নাম কুড়নো’ অনুব্রত আনন্দবাজারকে গুড়ের বাতাসার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘গুড়ের বাতাসার রং হল একটু কালচে লাল। কালচে লাল কীসের রং জানেন?’’ সে রং শুকিয়ে যাওয়া রক্তের কি না জানতে চাওয়ায় হেসে বলেছিলেন, ‘‘আপনি বুঝে নিলেন। আমি কিন্তু কিছু বলিনি।’’ কিন্তু এ দিন তাঁর দাবি, ‘‘গুড়ের বাতাসার রংটা মাটি কালারের হয়। কালচে কালারের হয় না।’’ বীরভূমে এ বার নির্বিঘ্নে ভোট হবে বলেও সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করেন কেষ্ট। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও মারামারি হবে না। রক্তক্ষয় হবে না। সুস্থ ভাবে ভোট হবে। এবং প্রত্যেকটি মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে, তার ব্যবস্থা প্রশাসন করেছে।’’

বিরোধীরা অবশ্য স্পষ্টই বলছেন, অনুব্রতকে বাইরে রেখে বীরভূমে অবাধ ভোট সম্ভব নয়। রাজ্যের নির্বাচন কমিশনকে সে কথা জানানোর পাশাপাশি আজ কমিশনের ফুল বেঞ্চের কাছেও একই আশঙ্কা তুলে ধরবেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্তকে সরানোর দাবি তোলা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির তরফে। এই পরিস্থিতিতে বীরভূমের ভোট নিয়ে কিছুটা চাপে রয়েছেন কমিশনের কর্তারা। আর বীরভূম নিয়ে কমিশন কী করে, কোনও পুলিশ অফিসার বা প্রশাসনিক কর্তাকে তারা সরিয়ে দেয় কি না, সে দিকে নজর রাখছে নবান্নও।

তথ্য: আবীর মুখোপাধ্যায়, জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় ও মহেন্দ্র জেনা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE