জাভেদ শামিম
একই উর্দি। একই প্রশাসন। তবু কত আলাদা!
সাত মাস আগে সল্টলেক পুর নির্বাচনের দিন একের পর এক বুথে ভোট লুঠ হতে দেখে ওঁরা নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছাপ্পা দিতে আসা শাসকদলের গুন্ডাবাহিনীর হাতে নিরীহ ভোটারদের মার খেতে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। কোমরের বেল্টে অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখা খাঁকি উর্দির এমন আচরণ দেখে গোটা রাজ্য আঁতকে উঠেছিল। প্রশাসনের অন্দরেও প্রশ্ন জেগেছিল, এই কি দায়িত্ব পালনের নমুনা?
সেই বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশই সোমবার একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়াল। ভোটদানের নাগরিক অধিকার যাতে সুরক্ষিত থাকে, তার জন্য চেষ্টার কসুর করল না। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বিধাননগর পুলিশ এ দিন কার্যত গোটা সল্টলেক দাপিয়ে বেড়িয়েছে। শাসক দলের হয়ে ‘ভোট করাতে’ শনিবার থেকে যে ক’হাজার বহিরাগত ঢুকেছিল, এ দিন সকাল থেকে তাদের প্রায় টিকি-ই দেখা যায়নি!
দিনের শেষে শাসক দলে তাই ক্ষোভের অন্ত নেই। ‘‘পুলিশ বড্ড বাড়াবাড়ি করেছে। আমাদের ছেলেদের পর্যন্ত পিটিয়ে বার করে দিল!’’— হতাশ গলায় বিস্ময়মিশ্রিত আক্ষেপ শোনা গিয়েছে বড়-মেজো-ছোট অনেক তৃণমূল নেতার গলায়। রক্ষকের এ হেন ভোলবদল কেন?
পুলিশকর্তাদের একাংশের ব্যাখ্যা: নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে গেলে স্বাধীনতা দরকার। পুরভোটে যার লেশমাত্র মেলেনি। কিন্তু বিধানসভা ভোটে গোটা পুলিশবাহিনী চলে গিয়েছে নির্বাচন কমিশনের অধীনে, এখানে রাজ্য প্রশাসনের কোনও জারিজুরি খাটবে না। তারই সুযোগে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে সল্টলেকের পুলিশ। চেষ্টা করেছে উর্দি থেকে ‘দলদাসত্বের’ কালি মোছার।
‘কলঙ্কমোচনের’ তাগিদে এ দিন সল্টলেক, রাজারহাট ও নিউটাউনে ভোটপর্বের রাশ কার্যত পুলিশই হাতে তুলে নেয়। সূত্রের খবর: অক্টোবরের পুর নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভোট লুঠ ঠেকাতে বিশেষ ও বিশদ পরিকল্পনা আগাম ছকে ফেলেছিলেন কমিশনারেটের কর্তারা। যা কার্যকর করতে নিপুণ দক্ষতায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কাজে লাগানো হয়েছে।
কী পরিকল্পনা?
কমিশনারেট সূত্রে জানা যাচ্ছে: পুলিশের কাছে খবর ছিল, সল্টলেক, নিউটাউনে সিন্ডিকেট-মাফিয়ার দল এবং রাজারহাট-গোপালপুরে বহিরাগতেরা গন্ডগোল পাকাবে। তাই সিন্ডিকেট চাঁইদের আগেভাগে বাগে আনার ছক কষা হয়। ‘‘সিন্ডিকেটের মাথা আর দাগিদের লিস্ট আমরা বানিয়ে ফেলেছিলাম। সঙ্গে বাইরে থেকে কারা আসতে পারে, তার তালিকাও।’’— বলছেন এক আধিকারিক।
ওই তালিকা ধরে ধরে গত তিন দিন সল্টলেক, নিউটাউন লাগোয়া ভাঙর, হাড়োয়া ও কলকাতার কিছু জায়গায় অভিযান চলেছে। ভজাই, মাটি গফ্ফর, মিনি গফ্ফর, টুটুন গাজির মতো সিন্ডিকেটবাজকে করা হয়েছে নজরবন্দি। বিভিন্ন সিন্ডিকেটের অফিস ও ক্লাবঘরে হানা দেওয়া হয়। লোকজন হটিয়ে সেগুলো ফাঁকা করে দেয় পুলিশ। রাস্তাঘাটে ছিল তীক্ষ্ণ নজরদারি। সল্টলেক-রাজারহাটে সন্দেহজনক মোটরবাইক দেখলেই চাকার হাওয়া খুলে দেওয়া হয়েছে। গাড়ির ডিকি খুলে দেখতেও ছাড়েননি কেন্দ্রীয় জওয়ানেরা। তাঁদের ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টাও হয়েছে। রবিবার রাতে নিউটাউনের দশদ্রোণে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের ‘খাতিরদারি’র বন্দোবস্ত করতে গিয়েছিলেন তৃণমূলের দুই কর্মী। এক পুলিশকর্তার দাবি, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনীর নোডাল অফিসারদের বলা হয়। রাতে দু’জনকেই আটক করা হয়েছে।’’
এ ভাবে আটঘাঁট বেঁধে এ দিন একেবারে তৈরি হয়ে মাঠে নেমেছিল বিধাননগরের পুলিশ। পুরভোটে লুঠ হওয়া বুথগুলোয় সকাল থেকে যথেষ্ট সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হয়ে যায়। পুলিশকর্তারা কনভয় নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রতিটি থানাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কোনও চাপের কাছে মাথা নোয়ানো চলবে না। জটলা দেখলেই লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করতে হবে। আইসিদের নেতৃত্বে পুলিশকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের বুথে যাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। এমনকী, যেখানে বিরোধীরা এজেন্ট দিতে পারেনি, সেখানে এজেন্ট পাঠাতে বলে বিরোধী নেতাদের কাছে ফোনও গিয়েছে পুলিশের।
পরিণামে নির্বিঘ্ন পরিবেশে প্রায় উৎসবের মেজাজে ভোট দিয়েছেন বিধাননগরবাসী। পুরভোটের পরে পুলিশের জন্য তাঁদের মনে যে ঘৃণা ও ক্ষোভ জমেছিল, সেটাই বদলে গিয়েছে বাহবায়। সন্ধ্যায় কমিশনারেটের এক কর্তার সগর্ব ঘোষণা, ‘‘শুধু কলকাতা পুলিশ নয়। সুযোগ পেলে আমরাও পারি।’’ এক অফিসারের মন্তব্য, ‘‘আত্মীয়-স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারতাম না। আজ সেই কালির দাগ কিছুটা ফিকে হল। পরে যা হয়, দেখা যাবে।’’ বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিমের প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমার কিছু বলার নেই। কেমন ভোট হল, নাগরিকদের কাছেই জেনে নিন।’’
জানতে গেলে সল্টলেকের মানুষ একটাই কথা বলছেন— ডান্ডার কাছে সব বদমায়েশি ঠান্ডা। এখানকার পুলিশ এটা যেন ভুলে গিয়েছিল। আবার মনে পড়েছে, এর চেয়ে ভাল কী হতে পারে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy