গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গোটা মুর্শিদাবাদ জেলা একটা সময় পর্যন্ত ছিল ‘অধীরগড়’। আর গত তিন দশকের রাজনীতির বহরমপুর ‘অধীরপুর’। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিজয়রথ পাহাড় থেকে নামতে নামতে প্রথম থমকায় মুর্শিদাবাদ-ঘেঁষা মালদহ দক্ষিণে। আবু হাসেন খান জয় পান বিজেপিকে দ্বিতীয় করে। আবার পাশের জেলা মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর তৃণমূল ছিনিয়ে নেয় কংগ্রেসকে হারিয়ে। কিন্তু পঞ্চম বারের লড়াইয়ে বহরমপুর ধরে রেখেছিলেন অধীর। সেই সূত্রেই লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা হন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি।
এ রাজ্যে তিনি কংগ্রেসের ‘একা কুম্ভ’। তিনিই বরাবরের বামেদের দখলে থাকা জঙ্গিপুরে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে জিতিয়েছিলেন। তিনিই বছরের পর বছর ধরে আরএসপির হাতে থাকা বহরমপুরের দখল কায়েম রেখেছেন ১৯৯৯ সাল থেকে টানা পাঁচ বার। এ বার অধীরের ষষ্ঠ বার সাংসদ হওয়ার লড়াই। ভূগোলের মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত বাকি দু’টি আসন এবং মালদহ দক্ষিণেও নিজস্ব দাপট দেখিয়েছেন। কিন্তু দিন দিন কি তাঁর ‘রাশ’ আলগা হচ্ছে?
বহরমপুর আসনের ইতিহাস বলছে, অধীরের আগে মাত্র এক বার জয় পেয়েছিল কংগ্রেস। স্বাধীনতার পর থেকে টানা সাত বার ‘কোদাল-বেলচা’ প্রতীকে জিতেছিলেন আরএসপির নেতা ত্রিদিব চৌধুরী। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে বাংলায় ১৬টি আসন জিতেছিল কংগ্রেস। সে বার কংগ্রেসের অতীশচন্দ্র সিংহ জেতেন বহরমপুরে। কিন্তু ১৯৮৯ থেকে বহরমপুর আবার চলে যায় আরএসপির হাতে। কিন্তু ১০ বছর পর ১৯৯৯ সালে আরএসপির সাংসদ প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়কে প্রায় এক লাখ ভোটে হারিয়ে দেন অধীর। সেই শুরু। এর পরে ওই আসনে দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থানে অনেক বদল এসেছে। তবে এক নম্বর জায়গার নড়চড় হয়নি। সেখানে থেকে গিয়েছেন অধীর।
তবে হিন্দু-মুসলিম মিশ্রিত এই আসনে বিজেপির একটা ভোট ছিল। অধীর প্রথম বার জেতার আগে ১৯৯৮ সালে তৃণমূল সমর্থিত বিজেপি প্রার্থী কর্নেল সব্যসাচী বাগচি আড়াই লাখের বেশি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তবে ১৯৯৯ সালের ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে প্রথম বারই অধীর হারিয়ে দিয়েছিলেন আরএসপিকে। সব্যসাচী সে বার তৃতীয় হয়ে যান।
বামেরা এর পরে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রমথেশকেই প্রার্থী করে গিয়েছে। আর জিতে এসেছেন অধীর। ২০১৪ সালে অল্প ব্যবধানে প্রমথেশকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় হয়েছিলেন তৃণমূলের গায়ক প্রার্থী তথা বর্তমানে রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন। ২০১৯ সালের ভোটেও অধীর জেতেন। তখনও দ্বিতীয় ছিল তৃণমূল। ৩৯.২৬ শতাংশ ভোট পান ঘাসফুলের অপূর্ব সরকার। যিনি স্থানীয় রাজনীতিতে ‘ডেভিড’ নামেই পরিচিত। একদা অধীরের ‘বিশ্বস্ত অনুগামী’ হিসাবে জেলার রাজনীতিতে পরিচিতি ছিল ডেভিডের। প্রাক্তন ‘গুরু’র সঙ্গে যুদ্ধে অপূর্ব পরাজিত হন। বিজেপি হয় তৃতীয়। আরএসপি চতুর্থ। তবে এ-ও মনে রাখতে হবে যে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ‘বামফ্রন্ট’ অধীরের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়নি। আরএসপি একপ্রকার জোর করেই প্রার্থী দিয়েছিল বহরমপুরে। ভোট পায় মাত্র ১৩,৩৬২টি। সেটা প্রত্যাশিতই ছিল। যেটা অপ্রত্যাশিত ঘটে, তা হল অধীর জিতলেও তাঁর ব্যবধান কমে যাওয়া। ২০১৪ সালে সাড়ে তিন লাখেরও বেশি ভোটে জেতা অধীরের জয়ের ব্যবধান ২০১৯ সালে কমে দাঁড়ায় ৮০ হাজারের সামান্য বেশি।
বহরমপুর জানে, অধীর মুসলিম ভোট পান। আবার অধীর হিন্দু ভোটও পান। তবে এই প্রথম তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূলের প্রার্থী এক জন মুসলিম। তৃণমূলের জোড়াফুল প্রতীক নিয়ে বহরমপুরের মাঠে অধীরের প্রতিপক্ষ প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান। অন্য দিকে, বিজেপি হিন্দু ভোট এককাট্টা করতে চায়। গত বিধানসভা নির্বাচনেই খোদ বহরমপুর আসনটাই বিজেপি দখল করে নিয়েছে। বহরমপুর লোকসভার আরও কয়েক বিধানসভাতেও পদ্মের শক্তিবৃদ্ধি দেখা গিয়েছে। সেই কারণে কি খানিক চিন্তায় ৬৮ বছরের অধীর? বিধানসভা নির্বাচনের ফলের ছায়া লোকসভা নির্বাচনে পুরোপুরি কাজ করে এমন বলা যাবে না। তবে গত বিধানসভা ভোটের ফল কিছুটা হলেও উদ্বেগে রেখেছে অধীরকে।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে এক নম্বরে ছিল তৃণমূল। দ্বিতীয় বিজেপি। তৃতীয় অধীর তথা কংগ্রেস। সেই ফলাফলের উপর ভর করেই এ বার বহরমপুর দখলের ব্যাপারে আশাবাদী তৃণমূল। সে জন্যই প্রার্থী করা হয়েছে প্রথাসিদ্ধ রাজনীতির বাইরের লোক ইউসুফকে। তার অবশ্য আরও একটা কারণ, মুর্শিদাবাদের দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের উপর রাশ টানা। গুজরাতের বাসিন্দা পাঠান তথা ক্রিকেটারকে সামনে রেখে মুসলিম ভোটের পাশাপাশি ‘ক্রিকেটমোদী’দের ভোট টানাও তৃণমূলের লক্ষ্য।
বিজেপি চাইছে ভোট কাটাকাটির অঙ্কে বাজিমাত করতে। বহরমপুর-সহ সংখ্যালঘু কম, এমন বিধানসভা এলাকাগুলিতে নিজেদের ভোট ধরে রাখার পাশাপাশি অতিরিক্ত ভোট পেতে জেলার পরিচিত চিকিৎসক নির্মল সাহাকে প্রার্থী করেছে তারা। দলের হিসাব, ‘ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা’ কাজে লাগিয়ে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাতেও প্রভাব ফেলবে প্রার্থীর ‘নির্মল’ ভাবমূর্তি। শল্যচিকিৎসক হিসেবে জেলা জুড়ে পরিচিতি রয়েছে নির্মলের। প্রত্যন্ত গ্রামের রোগীদের বিনামূল্যে অস্ত্রোপচারও করেন। তাই হিন্দু-মুসলিম সকলের কাছেই তিনি ‘ভাল ডাক্তারবাবু’। করোনাকালেও তাঁর কাজ দাগ কেটেছিল।
‘অধীরপুর’ আপাতত একটাই প্রশ্নের উত্তর জানতে অধীর আগ্রহে। কার দিকে যাবে সম্প্রদায়ের বিভেদ-ভাঙা ভোট? ভাল ক্রিকেটার, ভাল চিকিৎসক, না ভাল রাজনীতিক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy