ঘাটাল আসন নিয়ে অনেক অঙ্ক বিজেপির। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাজ্য রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে এখন ঘাটাল। নায়ক দেব তথা ঘাটালের সাংসদ দীপক অধিকারীই শিলাবতীর জলে আলোড়ন তুলেছেন। যার অভিঘাত গঙ্গাপারের কলকাতা-সহ রাজ্য রাজনীতিতে। শাসক তৃণমূল আর বিরোধী বিজেপি শিবিরে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা, নানা অঙ্ক। দেব আগে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে দূরত্ব রচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে সম্প্রতি তা আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে লোকসভা ভোটের মুখে একই সঙ্গে তিনি ঘাটাল কলেজ, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল ও বীরসিংহ উন্নয়ন পর্ষদের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোয়। অনেকেই বলছেন, দেব এই ইস্তফা দিয়ে লোকসভা ভোটে না লড়ার ভূমিকা করে রাখলেন।
তৃণমূলের তরফে মঙ্গলবার পর্যন্ত এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। তবে দলের ভিতরে গুঞ্জন যে, ইতিমধ্যেই ঘাটালে ‘বিকল্প’ প্রার্থী নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। অনেকের বক্তব্য, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার চণ্ডীপুরের বিধায়ক তথা অভিনেতা সোহম চক্রবর্তীকে ঘাটালে প্রার্থী করতে পারে তৃণমূল। তবে দলের অন্য অংশের মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ বেলায় কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা নিয়ে আগাম জল্পনা অর্থহীন। ২০১৯ সালেও দেব প্রার্থী হবেন না বলে শোনা গিয়েছিল। কিন্তু দলনেত্রী তাঁকে রাজি করিয়ে ফেলেছিলেন। এ বারেও তিনি দেবকে ঘাটালে প্রার্থী চান বলে দলীয় বৈঠকে জানিয়েছেন।
রাজ্য বিজেপি অবশ্য ধরে নিচ্ছে, দেব ঘাটাল আসনে প্রার্থী হচ্ছেন। তারা অঙ্ক কষছে মূলত অতীতের নির্বাচনের ফল কেন্দ্র করে। ২০০৯ সালে ঘাটাল লোকসভা আসনের জন্ম। সে বার তৃণমূল দক্ষিণবঙ্গে ভাল ফল করলেও ঘাটালে খাতা খুলতে পারেনি। নুর আলম চৌধুরী সিপিআইয়ের গুরুদাস দাশগুপ্তের কাছে প্রায় দেড় লাখ ভোটে হেরে যান। সেই ঘাটালেই ২০১৪ সালে দেব প্রার্থী হওয়ায় তৃণমূল বিপুল জয় পায়। ২ লাখ ৬০,৮৯১ ভোটে জয়ী তৃণমূলের ভোটপ্রাপ্তি ছিল ৫০.৭০ শতাংশ। ২০১৯ সালে অবশ্য সেই হার কমে ৪৮.২২ শতাংশ হয়ে যায়। দেবের জয়ের ব্যবধান কমে হয় ১ লাখ ৭,৯৫৯ ভোট।
তৃণমূলের ভোট কমে যাওয়ার থেকেও ‘উল্লেখযোগ্য’ হয়ে ওঠে ঘাটাল লোকসভা আসনে বিজেপির উত্থান। ২০১৪ সালে বিজেপি ওই আসনে এক লাখ ভোটও পায়নি। প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৭ শতাংশেরও কম। কিন্তু ২০১৯ সালে সেটা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪১ শতাংশ হয়ে যায়। ভোটের দৌড়ে দ্বিতীয় হওয়া প্রাক্তন আইপিএস ভারতী ঘোষ পান ৬ লাখ ৯,৯৮৬ ভোট। এক লাফে ৩৪ শতাংশ ভোট বেড়েছিল বিজেপির। তারা অন্য অঙ্কে ঘাটালকে ‘সহজ’ আসন বলে ধরতে চাইছে।
গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রাপ্য গড় ভোট ছিল ৪৩.৩ শতাংশ। বিজেপি মনে করে, ঘাটালে তৃণমূল অতিরিক্ত ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল দেবের দৌলতে। অভিনেতা হিসাবে তো বটেই, ভূমিপুত্র হিসাবেও দেবের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা ঘাটালবাসীর কাছে। তা অন্য কোনও প্রার্থী এমনকি, কোনও তারকার ক্ষেত্রেও মিলবে না। সেই হিসাবেই বিজেপি মনে করছে, সোহম দেবের বিকল্প হতে পারবেন না।
গত লোকসভায় বিজেপি প্রার্থী তথা দলের জাতীয় মুখপাত্র ভারতী অবশ্য দেবকেও গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘‘দেবের নামেই ভোট মিললে তো তৃণমূলকে রিগিং করতে হত না! ২০১৯ সালে কেশপুরে একাধিক জায়গায় বোমাবাজি হয়েছিল। সে বার রাজ্যে শুধু এই আসনেই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে গুলি চালাতে হয়েছিল। বুথ এজেন্টকে তরোয়াল নিয়ে তাড়া করেছিল ওরা।’’ সেই সূত্রেই ভারতীর প্রশ্ন, ‘‘এত বড় প্রার্থী হলে কি ওই রকম রিগিং করার দরকার হত?’’
বিজেপির আরও একটি অঙ্ক রয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়ে শুভেন্দু অধিকারী ছিলেন তৃণমূলে। এখন তিনি বিজেপির অন্যতম প্রধান ‘মুখ’। ভারতীর দাবি, শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে তাঁকে বলেছিলেন যে, ওই কেন্দ্রে ১ লাখ ৮,০০০ ভোট রিগিং করেছিল তৃণমূল।
এ বারেও কি ঘাটালে তিনিই প্রার্থী? সে প্রশ্নের জবাব ‘নেতৃত্ব জানেন’ বলে এড়িয়ে গিয়েছেন ভারতী। কারণ, ওই আসনে এ বার ভারতীর পরিবর্তে খড়্গপুর সদরের বিধায়ক তথা অভিনেতা বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায়কে প্রার্থী করা হতে পারে বলেও জল্পনা রয়েছে। হিরণ এখন বিধায়কের পাশাপাশি খড়্গপুর পুরসভার কাউন্সিলর। সম্প্রতি তাঁকে রাজ্য যুব মোর্চার ‘ইন চার্জ’-এর দায়িত্ব দিয়েছে বিজেপি। ফলে লোকসভায় হিরণের টিকিট পাওয়া কতটা সহজ হবে, তা নিয়ে বিজেপির মধ্যেও মতান্তর রয়েছে।
বিজেপিতে আরও একটি জল্পনার জন্ম হয়েছে দেবকে নিয়ে। ভারতী নিজে থেকেই বললেন, ‘‘দেব বিজেপির জন্য কোনও বড় বিষয় নয়। বিজেপি সমুদ্রের মতো। কোন মাছ সমুদ্রে এল কি এল না, তাতে কিছু যায়-আসে না। বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দল বিজেপিতে দেবের মতো মানুষ আসুক না আসুক, কিছু বদলায় না। তবে তিনি আসবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেবেন।’’ তবে দেবকে আক্রমণ করতেও ছাড়েননি তিনি। ভারতী বলেছেন, ‘‘কিছু পদ ছাড়লে কিছু হয় না। দল ছাড়লেও কিছু হয় না। পারলে দুর্নীতি ছাড়ুন!’’
গত বিধানসভা ভোটের নিরিখে আবার ভারতীর আত্মবিশ্বাস কিংবা বিজেপির অঙ্ক মিলছে। গত লোকসভা নির্বাচনে এই আসনের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা এলাকার মধ্যে শুধুমাত্র পাঁশকুড়া পশ্চিম আসনে এগিয়ে ছিল বিজেপি। বাকি সবং, পিংলা, ডেবরা, দাসপুর এবং ঘাটাল বিধানসভা এলাকায় কম ব্যবধানে পিছিয়ে থাকে। কিন্তু কেশপুর বিধানসভা এলাকায় তৃণমূল এগিয়ে ছিল ৯২ হাজার ৪৭ ভোটে। আর তার দু’বছর পরে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সাতটি আসনেই পরাজিত বিজেপি। ভারতী নিজেও ১১ হাজার ২২৬ ভোটে হেরেছিলেন ডেবরায়। সব আসন মিলিয়ে এই লোকসভা এলাকায় তৃণমূল এগিয়ে ৮৫,১৬৩ ভোটে। তবে বিজেপির বক্তব্য, কোনও আসনে জিততে না পারলেও লোকসভা নির্বাচনের লক্ষাধিক ভোটের তুলনায় ব্যবধান কমেছে ২২ হাজারের বেশি। এটাও ‘দেবহীন’ ঘাটাল জয়ের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকাই। তৃণমূল অবশ্য এখনও ‘স্পর্শকাতর’ ঘাটাল নিয়ে সে ভাবে কিছু বলছে না। দেব না দাঁড়ালেও ঘাটাল কি ঘাসফুলের জন্য শক্ত মাটি হয়ে থাকবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy