Advertisement
Back to
Kunal Ghosh

কুণালকে নিয়ে ‘লিন্ডনপন্থা’ নিয়েছিল তৃণমূল, বাংলায় খাটল না মার্কিন কৌশল, ‘ফেরারি’ ঘোষ স্বপথেই!

কুণালের বিরুদ্ধে বুধবার কড়া পদক্ষেপ করেছে তৃণমূল। তাঁকে রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তার পরেও কুণাল তাঁর আক্রমণ জারি রেখেছেন।

Two opinions are emerging from within the TMC about Kunal Ghosh

কুণাল ঘোষ। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২৪ ১৮:৫১
Share: Save:

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনকে এক সরকারি কর্তা প্রশ্ন করেছিলেন, এফবিআইয়ের বড়কর্তাকে কেন সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না? জবাবে জনসন বলেছিলেন, ‘‘বেটার টু হ্যাভ ইয়োর এনিমিজ় ইনসাইড দ্য টেন্ট পিসিং আউট দ্যান আউটসাইড দ্য টেন্ট পিসিং ইন!’’ অর্থাৎ, শত্রুকে তাঁবুর ভিতরে রাখা ভাল। তা হলে সে ভিতর থেকে তাঁবুর বাইরে প্রস্রাব করবে। কিন্তু বার করে দিলে সে বাইরে থেকে তাঁবুর ভিতরে প্রস্রাব করবে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এই নীতি প্রয়োগ করেছিলেন জ্যোতি বসু। দলের অনুশাসন এবং পার্টি লাইনের বাইরে গিয়ে বিবিধ কাজ কারবারের দায়ে সুভাষ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যখন বার বার দলের অন্দরে দাবি উঠছে, তখন বসুও ‘লিন্ডনপন্থা’ নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি জানতেন, সুভাষ দলের বাইরে গেলে দলের পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ হবেন। তখন তিনি বাইরে থেকে তাঁবুর ভিতরে জলবিয়োগ করে দিতে পারেন! কিন্তু দলের অন্দরে রেখে তাঁকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা যাবে।

কুণাল ঘোষ সম্পর্কেও সেই একই পন্থা নিয়েছিলেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। দলীয় লাইনের বাইরে গিয়ে মুখ খোলার জন্য অতীতে তাঁকে এক বার ‘সেন্সর’ করেছিল দল। পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে সে বার যে তিনি একটু ‘বেশি’ই বলে ফেলেছিলেন, তা মেনে নেন কুণাল নিজেও। কিন্তু তার পরেও তিনি মুখপাত্রের ভুমিকায় ফিরে এসেছিলেন। সেটা কয়েক বছর আগের ঘটনা। তার পরেও সম্প্রতি তৃমমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন আক্রমণ করেছেন কুণাল। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁর উপরে রুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু একটা পর্যায়ের পরে কঠোর হতে পারেননি। আসলে হতে চাননি। কারণ, তৃণমূলের শাখা-প্রশাখা এ কথা জানে যে, কুণাল দলের ভিতরের চেয়ে বাইরে বেশি ‘বিপজ্জনক’ হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। দ্বিতীয়ত, তাঁকে দিয়ে এমন রাজনৈতিক (কখনও-সখনও ব্যক্তিগত) আক্রমণ করানো যায়, যা অন্য অনেককে দিয়ে করানো যায় না। দ্বিতীয়ত, কুণাল নিজে দীর্ঘ দিনের সাংবাদিক হওয়ায় সংবাদমাধ্যমের চাহিদা বোঝেন। প্রায় সমস্ত সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁর পেশাদারি তো বটেই, ব্যক্তিগত পর্যায়েও সখ্য রয়েছে। রাতবিরেতে তাঁর কাছে প্রতিক্রিয়া চাইলেও পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, কুণাল এমন সমস্ত বিষয়ে দলকে ‘রক্ষা’ করতে মাঠে নেমে পড়তে পারেন, যা অন্য অনেকের কাছে অকল্পনীয়। মন্ত্রী তথা তৃণমূলের মুখপাত্র শশী পাঁজা তো একটি অনুষ্ঠানে বলেই ফেলেছিলেন, ‘‘কুণালদাকে দেখি আর ভাবি, কত সহজে কত কথা বলে দিতে পারেন!’’

সত্যিই তাই! কুণাল যে ভাষায়, যে ভঙ্গিতে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেছেন, তা কার্যত অভাবনীয়। সেই কারণেই তাঁর ‘উপযোগিতা’ নিয়ে কোনও সন্দেহ তৃণমূলের অন্দরে ছিল না। সেই কারণেই তাঁর বিবিধ ‘বিচ্যুতি’কে খানিকটা ‘লঘু’ করেই দেখেছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে কখনও- সখনও। কিন্তু তার পরে আবার তা মেরামতও করে নিয়েছে উভয় পক্ষ। কুণালের হিতৈষীরা বলেছেন, ‘‘দলের কুণাল ঘোষকে প্রয়োজন। যেমন কুণালেরও দরকার দলকে। উভয়েই উভয়ের এই অবস্থানটা বোঝে।’’

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘লিন্ডনপন্থা’ ধরে রাখতে পারল না তৃণমূল। সুভাষের ক্ষেত্রে বসুর ‘কৌশল’ কাজে লেগেছিল। কিন্তু কুণালের ক্ষেত্রে তা খাটল না বলেই এখনও পর্যন্ত মনে করছেন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের একটা বড় অংশ।

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে গত কয়েক মাস ধরেই প্রকাশ্যে কথা বলছিলেন কুণাল। যদিও সুদীপ সে বিষয়ে একটিও পাল্টা মন্তব্য করেননি। বস্তুত, বুধবারেও সুদীপের সঙ্গে তাঁর এক অনুগামীর কুণালকে নিয়ে যে হোয়াট্‌সঅ্যাপ কথোপকথন ফাঁস হয়েছে, সেখানেও সুদীপ বিষয়টিকে ‘অবজ্ঞা’ করতেই বলেছেন। যা নিয়ে লোকসভায় সুদীপের এক সতীর্থ বলছিলেন, ‘‘এই হল বড় রাজনীতিক! প্রকাশ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে যা করণীয় করবেন।’’ সুদীপ সত্যিই ‘ভিতরে ভিতরে’ কিছু করেছেন কি না, তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু গোটা তৃণমূল দেখেছে, কুণালকে বিবৃতি জারি করে তাঁর দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে তার পর থেকে কুণাল যা শুরু করেছেন, তা সদর দফতরে কামান দাগার শামিল! যে বক্তব্য সম্পর্কে ঘরোয়া আলোচনায় তৃণমূলের অনেক নেতাই মনে করছেন পরিস্থিতি আরও ঘোরাল হতে পারে। এক নেতার কথায়, ‘‘হাটের মাঝে অনেক হাঁড়ি রাখা রয়েছে। এত দিন কুণালকে হাঁড়ি পাহারার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ বার ওর হাতে খেটো বাঁশ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ও তো হাঁড়ি ভাঙবেই!’’

কুণাল সেই অর্থে ‘জননেতা’ নন। কিন্তু তিনি তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ। দলের ‘প্রত্যাবর্তন’-এর পরেও যে সাংগঠনিক পদে ছিলেন, তাতে দলের অন্দরের অনেক তথ্য তাঁর গোচরে রয়েছে। যা প্রকাশ্যে এলে বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে শাসক শিবিরের। যদিও সেই পদের ‘গুরুত্ব’ নিয়ে বুধবার একটি ‘কাঁচা কটাক্ষ’ করেছেন স্বয়ং কুণাল। কিন্তু তিনি জানেন কোন অঙ্কে কে, কী ভাবে, কোথায়, কোন পদে রয়েছেন। কার সঙ্গে কার কী রসায়ন। রাজ্য সম্পাদক পদ যাওয়ার পর থেকেই সে ব্যাপারে কিছু কিছু ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ মন্তব্য বাজারে ছাড়তে শুরু করেছেন কুণাল। তার মধ্যে অন্যতম হল, শিক্ষায় দুর্নীতির বিষয়টি দল ২০২১ সালের ভোটের আগে থেকে জানত। এমনও বলেছেন যে, শিক্ষায় দুর্নীতিতে জড়িত এক নেতা এখনও রাজ্যের মন্ত্রিসভার সদস্য।

গত ১ জানুয়ারি তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাদিবসে ‘নবীন-প্রবীণ’ প্রশ্নে কুণালের উপর্যুপরি মন্তব্য দলকে আলোড়িত করেছিল। তার পরবর্তীকালে জরুরি ভিত্তিতে মমতা-অভিষেকের বৈঠক, কুণালকে শোক়জ়, কুণালের ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডল থেকে দলের পদের উল্লেখ মুছে দেওয়া— গত পাঁচ মাসে ঘটনার ঘনঘটা দেখেছে বাংলা। কিন্তু তার পরেও কুণাল দলের তরফে গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক বৈঠক করছিলেন। দলের হয়ে বিবৃতিও দিচ্ছিলেন। তৃণমূলের উচ্চ নেতৃত্বের তরফে সাংবাদিকদের ঘরোয়া আলোচনায় এমনও বলা হয়েছিল যে, ‘সিরিয়াস ইস্যু’তে দলের তিন জন মূলত প্রতিক্রিয়া দেবেন। তাঁরা হলেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, কুণাল ঘোষ এবং শশী পাঁজা। নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছিল, এঁদের তিন জনকে কখনও না পাওয়া গেলে মন্ত্রী ব্রাত্য বসু দলের তরফে প্রতিক্রিয়া জানাবেন। সেই কুণাল সম্পর্কেই বুধবার তৃণমূল জানিয়েছে, কুণালের কোনও কথাই ‘দলের কথা’ নয়। কোনও সংবাদমাধ্যম কুণালের বক্তব্যকে ‘দলের বক্তব্য’ হিসেবে ব্যবহার করলে আইনানুগ ব্যবস্থারও হুঁশিয়ারি ছিল রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের সই করা প্রেস বিবৃতিতে।

কুণালের বিরুদ্ধে দলের পদক্ষেপ নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে দু’টি অভিমত রয়েছে। একাংশের বক্তব্য, কুণাল যে ভাবে ভোটের সময় প্রতিপক্ষের প্রার্থী তাপস রায়কে ‘ভাল জনপ্রতিনিধি’ বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন, তাতে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না করা হলে দলে শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকত না। যে যা ইচ্ছা বলতেন। করতেন। কুণালকে শাস্তি দিয়ে গোটা দলকেই ‘বার্তা’ দেওয়া হয়েছে। আবার অন্য অংশের বক্তব্য, কুণালের সঙ্গে এক বার কথা বলে তিনি ওই মঞ্চে কেন এবং কী বলেছেন, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিলে ভাল হত। তাঁর সঙ্গে কথা না বলে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা না-নিলেই হত। আবার অন্য একাংশের বক্তব্য, মুখপাত্র হিসেবে কুণালের ‘দাপটে’ দলেরই একটা অংশ ‘অসূয়াপ্রবণ’ হয়ে পড়েছিল।

চক্রবর্তী সুভাষের কালজয়ী কথা ছিল, ‘‘যত দিন বাঁচুম, হেডলাইনে বাঁচুম!’’ কুণাল ঘোষ নিজে সাংবাদিক। ‘শিরোনাম’ তাঁর ধমনীতে। তৃণমূলের অন্দরে একটি বিশেষণ চালু আছে কুণাল সম্পর্কে— ব্রেক ফেল-করা ফেরারি গাড়ি। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘কুণাল ফেরারি গাড়ি। দুরন্ত গতি। কিন্তু ব্রেক ফেল করলে দু’একটা লোককে চাপা দেবেই।’’

ব্রেক ফেল করেছেন ‘ফেরারি’ কুণাল। উদ্বিগ্ন তৃণমূল তাকিয়ে আছে— কে কে চাপা পড়ে!

অন্য বিষয়গুলি:

Kunal Ghosh Lok Sabha Election 2024
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy