পঞ্জাবে ভোটপ্রচারে মায়াবতী। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।
লখনউয়ের মল অ্যাভিনিউয়ে বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) সদর দফতর চিরকালই ভোটের মরসুমে ফাঁকাই পড়ে থাকে। এ বারও তার ব্যতিক্রম নয়। লোহার ফটক পেরিয়ে বি আর অম্বেডকর, কাঁসিরাম, মায়াবতীর পাথরের মূর্তি, বহুজন সমাজ পার্টির প্রতীক হাতির মূর্তির পাশ দিয়ে দফতরে ঢুকলে উত্তর মেলে, ‘‘বহেনজি প্রচারে লখনউয়ের বাইরে। দলের নেতা, কর্মকর্তারাও সব নিজের নিজের এলাকায়।’’ এটাই স্বাভাবিক। ভোটের সময় কেন আর দলের নেতারা সদর দফতরে বসে থাকবেন!
এ বার লখনউয়ের রাস্তায় ঘুরুন। লখনউ থেকে অযোধ্যার রাস্তা ধরুন বা আগরা, অমেঠী যান বা আজমগড়, গোরক্ষপুর যান বা বারাণসী। উত্তরপ্রদেশের যে কোনও লোকসভা কেন্দ্রে গিয়ে প্রশ্ন করুন, মায়াবতীর দল বিএসপি-র হালচাল কী? একটাই উত্তর মিলবে—‘‘বহেনজি বা বিএসপি তো কোত্থাও নেই!’’
নেই মানে নেই। গোটা উত্তরপ্রদেশ ঘুরে বিএসপি-র প্রচার দেখতে পাবেন না। হাতি প্রতীক-সহ বিএসপি-র নীল পতাকা ও কাঁসিরাম-মায়াবতীর ছবিওয়ালা হোর্ডিং খুঁজতে টেলিস্কোপ দরকার হতে পারে। মায়াবতী এমনিতেই শেষবেলায় প্রচারে নামেন। এ বারেও তিনি লোকসভা ভোট ঘোষণার ২৬ দিন পরে প্রচার শুরু করেছেন। দিনে দু’একটি করে জনসভা করছেন। উত্তরপ্রদেশের বাইরেও যাচ্ছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার বাইরে উত্তরপ্রদেশ ঘুরলে টের পাবেন না, মায়াবতী ভোটে লড়ছেন।
চোখের সামনে নেই। অথচ তিনি আছেন। উত্তরপ্রদেশের যে কোনও লোকসভা কেন্দ্রে গিয়ে জাতপাতের অঙ্কে ভোট কাটাকুটি নিয়ে আলোচনা হলেও মায়াবতীর নাম ভেসে উঠছে। কোথাও তিনি মুসলিম প্রার্থী দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সমাজবাদী পার্টির মুসলিম ভোট কাটবেন বলে আশঙ্কা। যেখানে সমাজবাদী পার্টির যাদব প্রার্থী, সেখানে তিনি যাদব প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। কোথাও আবার তিনি ব্রাহ্মণ প্রার্থী দিয়ে কংগ্রেসের ভোট কাটবেন বলে অঙ্ক কষা চলছে।
২০১৯-এর লোকসভায় উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব ও মায়াবতীর জোট হয়েছিল। বিএসপি ১০টি আসন জিতেছিল। পাঁচ বছর পরে অখিলেশ যাদব প্রচারে বলছেন, ‘‘বিজেপি ও বিএসপি গোপনে হাত মিলিয়েছে।’’ মায়াবতীর দলিত ভোটব্যাঙ্ককে নিজের দিকে টানতে অখিলেশের নেতৃত্বে সমাজবাদী পার্টি গত মাসেই মায়াবতীর রাজনৈতিক গুরু, দলিত নেতা কাঁসিরামের জন্মবার্ষিকী পালন করেছেন। রায়বরেলীতে কাঁসিরামের মূর্তিও বসিয়েছেন অখিলেশ। ২০২২-এর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে বিএসপি ৪০৩টি বিধানসভা আসনের মধ্যে মাত্র একটি আসন জিতেছিল। অখিলেশ বলছেন, ‘‘একটা ছোট্ট দলের এক জন বিধায়ক ভুল করে জিতে গিয়েছিল। এ বার তারা বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বহুজন সমাজের মানুষকে সাবধান হতে হবে।’’
উত্তরপ্রদেশের চার বারের মুখ্যমন্ত্রী কি বিজেপির হয়ে বিরোধীদের ভোট কাটার পার্টি হয়ে গেলেন?লখনউয়ের গোমতী নগরে মায়াবতী সরকারের তৈরি বিরাট বিরাট উদ্যান। তাতে বৌদ্ধ স্তুপের আদলে স্থাপত্য আর অম্বেডকরের মূর্তি। সার দিয়ে বিএসপি-র প্রতীক হাতির মূর্তি। উদ্যানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ট্যাক্সির চালক রবিদাস কুমার বলছিলেন, ‘‘বহেনজি কিন্তু নিজের সিলমোহর রেখে গিয়েছেন উত্তরপ্রদেশে।’’ রবিদাস দলিত সম্প্রদায়ের জাটভ গোষ্ঠীর সন্তান। দলিত জনসংখ্যার অর্ধেকই জাটভ সম্প্রদায়ের। মায়াবতী নিজেও জাটভ। এ তাঁর নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক। রবিদাস গর্ব করে বলেন, ‘‘আমাদের সমাজের সবাই বহেনজিকেই ভোট দেয়। এ বারও অন্যথা হবে না।’’
এখানেই অভিযোগ মায়াবতীর বিরুদ্ধে। তিনি নিজের ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইছেন, কিন্তু অন্যের ভোটব্যাঙ্ক কাটতে নেমেছেন। তাই উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে চার ভাগের এক ভাগ আসনে তিনি মুসলিম প্রার্থী দিয়েছেন। সমাজবাদী পার্টির মুসলিম-যাদব ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে। সমাজবাদী পার্টির নেতারা বলছেন, মায়াবতী যে বিজেপির ‘বি-টিম’ হয়ে গিয়েছেন, এতে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর ভাইপো আকাশ আনন্দ বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন বলে তিনি তাঁকে ‘অপরিণত’ বলে দলের সর্বভারতীয় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। অথচ এই ভাইপোকেই তিনি উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেছিলেন।
যদিও মায়াবতী প্রকাশ্যে বিজেপি-আরএসএসকে আক্রমণ করে চলেছেন। এপ্রিল মাসে তাঁর প্রথম জনসভায় মায়াবতী বলেছিলেন, বিজেপি জমানায় গরিব মানুষের মতো ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণের মানুষকেও হেনস্থা হতে হচ্ছে। শনিবার ষষ্ঠ দফায় ভোটগ্রহণের আগে শুক্রবার বিহারে, পঞ্জাবে প্রচারে গিয়ে মায়াবতী বলেছেন, নিরপেক্ষ ভোট হলে, ইভিএমে কারচুপি না হলে বিজেপির ‘জুমলাবাজি’ কাজ করবে না। তাঁর দাবি, মানুষ এ বার মুখ বুজে ভোট দিচ্ছেন। ক্ষমতার পরিবর্তন হতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে।
মুচকি হাসছেন সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেসের নেতারা। সমাজবাদী পার্টির দফতরে বসে দলের মুখপাত্র আশিস যাদব বলছেন, ‘‘বহেনজি কী করছেন, তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। লোকসভা ও বিধানসভায় ওঁর ভোটের হার লাগাতার কমছে। বিধানসভায় বিএসপি-র সবেধন নীলমণি মাত্র একজন বিধায়ক। বহেনজির দলের রাজনৈতিক অস্তিত্বই এখন সঙ্কটের মুখে।’’ আর কংগ্রেসের মুখপাত্র অংশু অবস্থী মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘পাঁচ বছর আগে বিএসপি-র যে দশ জন সাংসদ হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচ জনই অন্য দলে চলে গিয়েছেন। কারণ, মায়াবতী নিজের আদর্শ ত্যাগ করেছেন।’’
মায়াবতী নিজে আড়ালে চলে যাচ্ছেন। দলের নেতারা তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। একদা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখা মায়াবতীর রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা থাকবে কি না, তা নিয়ে আঁক কষছে উত্তরপ্রদেশের রাজনীতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy