প্রতাপ ষড়ঙ্গী। — নিজস্ব চিত্র।
কালো রংয়ের ঢাউস এসইউভি-র দরজা খুলে ধরলেন মেটে সিঁদুরের মোটা তিলক কাটা এক বিজেপি কর্মী। গুমোট বৈশাখী রাতে কালো কাচে ঢাকা সেই গাড়ির ভিতর থেকে উড়ে এল শীতাতপ যন্ত্র নিঃসৃত শীতল হাওয়ার চিলতে ঝাপট, সঙ্গে চন্দনের সুবাস।
তিনি নামলেন। রাত ১০টা ১৫। সারা দিন জনসংযোগ, সন্ধ্যায় কর্মীদের সভা, বুথ-বৈঠক। তবু ক্লান্তির লেশটুকু নেই ছিপছিপে বর্ষীয়ান শরীরে। চন্দনের সুবাস আরও ছড়াল। বোঝা গেল, চোস্ত পায়জামার উপরে পরা ফিনফিনে খদ্দরের পাঞ্জাবিই গন্ধের উৎস। চওড়া কপালে চন্দনের তিলক।
বিরোধীরা বলেন, ১৯৯৯-এ অস্ট্রেলিয়ান যাজক গ্রাহাম স্টেনকে দুই শিশুপুত্র-সহ পুড়িয়ে মারার জন্য দারা সিংয়ের শাস্তি হলেও সে দিনের হামলার ‘আদর্শগত কারিগর’ ছিলেন বজরং দলের সেই সময়ের প্রধান এই প্রতাপচন্দ্র ষড়ঙ্গী। গত বছর বালেশ্বর থেকে বিজেপির টিকিটে জয়ী হয়ে সংসদে গিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রাণিসম্পদ ও ডেয়ারি দফতরের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে প্রতাপচন্দ্রকে দায়িত্ব দেওয়ার পরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সঙ্ঘ-সমর্থকেরা সব চেয়ে বেশি হর্ষ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর নাম ডাকার সময়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রতাপের প্রতাপ এবং ‘স্টেনপর্ব’ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি শুরু হওয়ায় দু’বছর দু’মাস পরেই তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় দেন মোদী।
হিন্দুত্ববাদীদের হাতে গ্রাহাম স্টেনের হত্যাকাণ্ড যদি রাষ্ট্রের লজ্জা হয়, আরও বড় লজ্জা তদন্ত রিপোর্টের নামে বজরং দল ও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া তার কর্মীদের একের পর এক ছাড় দেওয়া। দারা সিংহের মৃত্যুদণ্ড হলেও দু’বছর পরে সাজা কমিয়ে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের চিহ্নিত করা তার যে ১২ জন সঙ্গীকে পুলিশ গ্রেফতারের পরে আদালত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দিয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে পরে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তি দেয় হাই কোর্ট। এরা সকলেই বজরং দলের কর্মী। খুনি দারা সিংহ জেল থেকে বাছাই করা কিছু সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিয়ে দাবি করে, কখনওই সে বজরং দলে ছিল না। তার আদর্শ পুরুষ আরএসএস বা বিজেপির কেউ নয়, তিনি শিবসেনা প্রধান বালাসাহেব ঠাকরে। বিরোধীদের দাবি, সঙ্ঘ থেকে তার দূরত্ব রক্ষা করাটাও সঙ্ঘ এবং দারা সিংহের সুচিন্তিত কৌশল। কিন্তু আসল সত্য নিহিত রয়েছে, সে দিনের বজরং-প্রধান প্রতাপ ষড়ঙ্গী দিল্লিতে শপথ নেওয়ার সময়ে সমবেত সঙ্ঘ-কর্মীদের জান্তব হর্ষোল্লাসে।
আজ ঘটনার ২৫ বছর পরে আনন্দবাজারের মুখোমুখি বসে পুরনো সেই দিনের কথা পাড়তেই কপালে ভাঁজ প্রতাপচন্দ্রের। শীতল দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তাকে বিদ্ধ করে যা বলেন, তার সার কথা— ওই হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত নিন্দনীয়। বজরং দল যে তার সঙ্গে যুক্ত ছিল না, তদন্ত কমিটির রিপোর্টে তা প্রমাণিত হয়েছে। ওই সংগঠনের তখনকার প্রধান হিসাবে তিনি সে দিনও ওই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছিলেন, আজও করছেন। এই ভোটে ওই হত্যাকাণ্ড কোনও বিষয় নয়, তাই সবিস্তার আলোচনায় যেতে চান না। শুধু বলতে চান, বজরং দলকে তার সঙ্গে জড়ানোটা ছিল হিন্দু-বিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, যা ব্যর্থ হয়েছে।
তবে ভোটের বিষয় কী?
প্রতাপের জবাব, “নরেন্দ্র মোদীজির উন্নয়ন। দেশ আজ বিশ্বশক্তি। অর্থনীতি দুনিয়ার সব চেয়ে অগ্রগণ্য। সারা বিশ্ব ভারতকে গুরু মানছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ চাঁদে পৌঁছেছে। ‘বন্দে ভারত’ দৌড়চ্ছে। এই বালেশ্বরের চাঁদবালি রেঞ্জে রোজ নতুন নতুন আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা সফল হচ্ছে। মোদীজির নেতৃত্বে ভারত এখন নতুন পরিচিতির পথে।”
কংগ্রেস বলছে, প্রতাপ যড়ঙ্গী পাঁচ বছরে বালেশ্বরের জন্য কিচ্ছু করেননি। মানুষ কংগ্রেস প্রার্থীকে জেতাবে। কিছু বলবেন?
“দিবাস্বপ্ন,” প্রতাপের ছোট্ট জবাব। বলেন, “কংগ্রেসের না আছে ভাল কাজের অতীত, না আছে আদর্শগত আকর্ষণ। মানুষ তাদের ত্যাগ করেছে। বালেশ্বরের মানুষও। মানুষ মোদীজিকে ভরসা করেন। গত বারের চেয়ে এ বার বহু গুণ বেশি ভোটে যে জিতব, তার ইঙ্গিত স্পষ্ট।”
নিঝুম রাতে ফাঁকা রাস্তায় স্কুটি ছুটিয়ে এগিয়ে দিতে এসে বিজেপির এসসি মোর্চার নেতা নিতুন সাহা বলেন, “গেল বার ১৩ হাজারের ব্যবধান এ বার লিখে নিন, লাখ-দেড় লাখে দাঁড়াবে। কোটি টাকার প্রচার সামগ্রীর অর্ডার দেওয়া হয়েছে কলকাতায়। ননা-র ছবি দেওয়া টুপি, টি-শার্ট, ফেস্টুন, ফ্লেক্স আসছে। কলকাতায় দেওয়াল লেখে, ও সব গরিব পার্টির কাজ। আমরা স্টিকারের অর্ডার দিয়েছি। এক একটায় গোটা দেওয়াল। তাতে মোদীজি আর ননা-র ছবি।”
প্রতাপ ষড়ঙ্গীকে কর্মীরা শ্রদ্ধাভরে ননা নামে ডাকেন, ওড়িয়া ভাষায় যার অর্থ প্রাজ্ঞজন। কিন্তু বালেশ্বর জেলার কংগ্রেস সভাপতি সঞ্জীব গিরির কথায়, “প্রাজ্ঞ না ছাই। ঘোর সাম্প্রদায়িক একটা লোক। ২০১৪-য় গোহারা হেরেছিলেন। ২০১৯-এ তালেগোলে নামমাত্র ভোটে জিতে গিয়েছিলেন। এলাকায় পর পর কারখানা বন্ধ, এমপি-র হুঁশ নেই। দাঙ্গা করা ছাড়া আর কোনও কাজের যোগ্যতা যে তাঁর নেই, মানুষ বুঝেছেন।”
গত বার বিজেডির রবীন্দ্র জেনাকে সামান্য ব্যবধানে হারিয়েছিলেন প্রতাপচন্দ্র। কংগ্রেসের দুর্বল প্রার্থী নবজ্যোতি পট্টনায়ক পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ৭৯ হাজার ভোট। বিজেপি ছেড়ে আসা লেখাশ্রী সামন্তসিংহারকে এ বার প্রার্থী করেছে বিজেডি। মুখ পাতলা লেখাশ্রী রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র হিসাবে এত দিন বাছা বাছা অপশব্দে বিঁধেছেন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ককে। কংগ্রেসের আশা, বিজেডি-কংগ্রেস নির্বিশেষে বালেশ্বরের বিজেপি-বিরোধী অসাম্প্রদায়িক মানুষ কংগ্রেস প্রার্থী শ্রীকান্ত জেনাকেই ভোটটা দেবেন। কংগ্রেস নেতা সঞ্জীব গিরি বলেন, “শ্রীকান্ত জেনা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীন বালেশ্বরে এমস করেছেন।
রেললাইনের দু’পাশকে চওড়া উড়ালপুলে বেঁধে বালেশ্বরকে নগরে পরিণত করেছেন। আধুনিক জলপ্রকল্প করেছেন। বেশ কিছু শিল্প এই মহল্লায় ডেকে এনেছেন, যে গুলি কেন্দ্রের নীতিতে আজ উঠে যাচ্ছে। বিড়লা টায়ার বন্ধ হয়ে কয়েক হাজার লোক কর্মহীন। বালেশ্বরে অসাম্প্রদায়িক মানুষই বেশি। আমরা আশাবাদী।”
বালেশ্বর কেন্দ্রে বাঙালি ভোটারদের দিকে তাকিয়ে ২০১৯-এ প্রার্থী দিয়েছিল তৃণমূল। সেই প্রার্থী পেয়েছিলেন ৩,৯০০টি ভোট। আর নোটা-য় ভোট পড়েছিল ৭,৪৩৬টি। এ বার অবশ্য জোড়াফুল উধাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy