(বাঁ দিকে) শরদ পওয়ার এবং (ডান দিকে) অজিত পওয়ার। —ফাইল চিত্র।
‘কাল রাতে আমার ঘরে এসেছিল এক চোর। এসেই বলে, আমায় দিয়ে দে সব তোর। নিজের কাছে যা যা আছে সব।’
গোটা দেশে সম্প্রতি রমরম করে চলা এই গানটির (মূল হিন্দিতে) প্রথম কয়েকটি লাইন মরাঠা ভোটবাজারে ‘ইন্ডিয়া মহাবিকাশ আগাড়ি’র নেতাদের মুখে মুখে। কেউ তা প্রচারে ব্যবহার করছেন, অনেকে গানটির ভিডিয়ো লিঙ্ক পোস্ট করছেন সমাজমাধ্যমে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, অথবা মহারাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক রাজধানী কিম্বা স্রেফ শান্তিতে ছুটি কাটানোর জায়গা। পুণেকে যে নামেই ডাকা যাক না কেন, উত্তপ্ত ভোটবাজারে (লড়াই এখানে বিজেপি-এনসিপি-শিন্দের শিবসেনার মুরলীধর কিসান মহল বনাম কংগ্রেসের তথা মহাবিকাশ আগাড়ির রবীন্দ্র ধঙ্গেকরের) এ শহরে সহানুভুতির তরঙ্গ বেশ টের পাচ্ছি। তরঙ্গের কেন্দ্রে রয়েছে একটি বড় ‘চুরি’। যে ‘চুরির’ কারণে খুড়ো-ভাইপোর (শরদ পওয়ার তথা সাহেব এবং অজিত পওয়ার তথা দাদা) ভোটযুদ্ধে সামান্য হলেও কোণঠাসা দেখাচ্ছে ভাইপোকেই।
‘‘মরাঠা পরিবারের সবচেয়ে বড় সংস্কার কী জানেন তো? সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটিকে বাড়তি যত্নআত্তি, তাঁকে সব সময় আগলে রাখা। কিন্তু দাদা এটা কী করলেন? সাহেবের ঘরে বড় হয়ে তাঁরই লোক, নাম ভাঙিয়ে নিলেন, দলের এত বছরের ঐতিহ্যের ঘড়িকেও (এনসিপি-র আদি প্রতীকচিহ্ন) চুরি করে নিলেন! বিরাশি বছরের বৃদ্ধ কাকার সঙ্গে তিনি যা করলেন, তার জবাব দেবে মানুষ।’’ লক্ষ্মী রোড মার্কেটের কাছে শনিবারওয়াড়া দুর্গের খিলানে হেলান দিয়ে বসে আড্ডা মারছি প্রশান্ত ইগলের সঙ্গে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, গরমের ঝাঁঝটাও কম, কিছু পায়রা ছাড়া এই ‘ভুতুড়ে’ কেল্লায় আমরা ছাড়া এখন কেউ নেই। দু’বার সিকিয়োরিটি গার্ড এসে তাড়া দিয়ে গিয়েছেন।
এই কেল্লাতেও খুড়ো-ভাইপোর যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস, তবে যা কিনা পুণের চলতি ভোট নাট্যের উল্টো ভাষ্যে লিখিত। জনশ্রুতি, পেশোয়া রাজ প্রথম বাজিরাওয়ের তৈরি এই তেরো তলা দুর্গে রাতে নাকি এখনও রাজপুরুষের আর্ত চিৎকার শোনা যায়। দশম পেশোয়া রাজ নারায়ণ রাও আঠারো বছরে সিংহাসনে বসলে ক্ষিপ্ত হন তাঁর কাকা রঘুনাথ রাও এবং তাঁর স্ত্রী। এক শিকারির সাহায্যে কিশোর রাজাকে কুচিকুচি করে কেটে ভাসিয়ে দেওয়া হয় কোনও নদীতে।
লিঙ্গায়ত জাতিগোষ্ঠীর (ওবিসিভুক্ত) এই বৃদ্ধ গাইডটি দীর্ঘদিন ধরে ‘সাহেব’কে দেখছেন। বললেন, ‘‘ভাইপোকে কী না দিয়েছিলেন সাহেব। আসলে এই পুণের আসনগুলি কখনওই বিজেপি বা শিবসৈনিকের ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকেই পুণে, বারামতী, শিরুর, খের বিধানসভাগুলিতে কংগ্রেসের দাপট। এখানেই সাহেবের বিএমসিসি কলেজে বাণিজ্য নিয়ে পড়াশোনো। এখানেই তাঁর বড় হওয়া, খেলাধুলো, সাংস্কৃতিক নানা কাণ্ডে জড়িয়ে থাকা, অল্প বয়স থেকেই থিয়েটার করা। রাজনীতির পাশাপাশি সাহেব আর সুপ্রিয়া এখানকার কবি-সাহিত্যিক-অভিনেতা-থিয়েটারকর্মী সমাজেও যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন। রামদাস ফুটানের মতো নামকরা কবিকে বিধায়ক করেছেন।’’
পাশাপাশি সংশয়াতীত শরদের বাণিজ্যমহলে নেটওয়ার্ক। পওয়ারের পরিবারের উপর গবেষণা করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মাধব কারান্ডিকর। যিনি মনে করেন, পুণের লাগোয়া পিম্পরি-ছিনছেওয়াড় এলাকায় প্রায় তিন হাজার একরের উপর যে হিঞ্জেওয়াড়ি তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক মহারাষ্ট্র তথা দেশের গর্ব, তা হতই না শরদ পওয়ার না থাকলে। কারান্ডিকরের কথায়, ‘‘পওয়ার সাহেব দিল্লি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় তাঁর গড় পুণের দেখভাল করতেন সুরেশ কলমডী। কলমডী ছিলেন পওয়ার সাহেবের খুবই বিশ্বস্ত, ডান হাতই বলা যায়। দুর্নীতির কারণে তিনি গ্রেফতার হওয়ার পরে শরদ চোখ বুজে পুণের দায়িত্ব সঁপেছিলেন ভাইপোর হাতে। সুপ্রিয়া সুলের কাছে পুণের কোনও অনুরোধ গেলে তিনিও অজিতের কাছেই পাঠিয়ে দিতেন। তবে অজিতের বাংরবার অনুরোধেও তাঁকে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী করেননি শরদ। ক্ষোভের শুরু সেখানেই।’’
‘‘তবে কাকার কাছ থেকে পুণের দায়িত্ব নিয়ে অজিত দাদা কিন্তু বসে থাকেননি,’’ বলছেন, মাধব গোখলে (নাম পরিবর্তিত), যিনি বিশ বছর ধরে রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা। ‘‘ভোর ৬টাতেও তিনি সরকারি কর্তাদের বৈঠকে ডাকেন, আবার রাত একটা পর্যন্ত কাজও করেন। পুলিশ এবং রাজ্য প্রশাসন থেকে কাজ করিয়ে নিতে জানেন। এখানকার মিউনিসিপ্যালিটিতে কোনও কালেক্টর নিয়োগ হয় না তাঁর নির্দেশ ছাড়া। গত এক বছরে কেন্দ্রীয় সরকার হাতে থাকায় তাঁর কাছে সমস্যা নিয়ে গেলে দ্রুত সমাধান করে দিচ্ছেন। এখানে দুধ, চিনি, কৃষি, শ্রমিক-সহ বিভিন্ন সমবায় সংস্থাগুলিতে অজিত দাদার লোক ঢোকানো আছে।’’
অজিত পওয়ারপন্থী এনসিপি-র পুণে মুখপাত্র প্রদীপ খড়ডেকর তথ্য সাজিয়ে ধরলেন, শরদ পওয়ারের প্রতীক ‘চুরি’ নিয়ে প্রশ্ন করায়। যে যুক্তি অজিত জনসভায় দিচ্ছেন, তাকেই সংক্ষিপ্ত করে বললেন, ‘‘চুরি বলা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদ, বিধায়কই দাদার সঙ্গে থেকেছেন। সাহেবই বরং দলের মধ্যে সংখ্যালঘু। ফলে প্রতীকের অধিকার কার থাকা উচিত? আর আবেগ দিয়ে পেট ভরে না। দাদা উপমুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর গত ন'মাসে মন্ত্রিসভায় সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে জায়গা দিয়েছেন। পুণেতে বেসরকারি ন’টি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩০টিরও বেশি কলেজ গড়ে উঠেছে। আইটি এবং অটো হাব, কারখানা সবই বাড়ছে, অন্য রাজ্য থেকে শ্রমিকরা এখানে কাজ পাচ্ছেন। বেকারত্ব পশ্চিম মহারাষ্ট্রে কোনও বিষয়ই নয়। বরং প্রতিদিনই নতুন কাজের সুযোগ বাড়ছে।’’ অন্য দিকে শরদ শিবিরের দাবি, এই সাম্রাজ্য তো গত ন’মাসে তৈরি হয়নি। সাহেবের গত বিশ বছরের বহু উদ্যোেগের ফল খাচ্ছেন অজিত।
মোদী যে ভাষায় আক্রমণ করছেন শরদকে, তা মহারাষ্ট্রের সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়—বলছেন মহাত্মা ফুলে মান্ডির ফল ও আনাজের বেচাকেনা করা মানুষ। সম্প্রতি পওয়ারকে ‘অতৃপ্ত আত্মা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন মোদী তাঁর জনসভায়। ক্ষোভ তা নিয়েও। এখানে দেখা পাওয়া গেল একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্যামকান্ত চহ্বানের। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি উদ্ধত ভাষায় প্রচার করছে, শরদ পওয়ারকে আক্রমণ করছে। এখানকার মানুষের শিক্ষাদীক্ষা, রুচি, মনন সবেরই ন্যূনতম পরিশীলন রয়েছে। আপনাদের বাংলার মতো মরাঠাও দেশকে সাংস্কৃতিক দিশা দেখিয়েছে। বদলা নেওয়ার রাজনীতি, উগ্র বাচনভঙ্গি এখানকার মানুষ পছন্দ করেন না।!! উনিশ-বিশ একই কথা ফলবিক্রেতারও মুখে।
বারামতীর মতো পুণেতেও তাই ঘন হচ্ছে আবেগের সঙ্গে উন্নয়নের কৃতিত্ব নেওয়ার লড়াই। ‘সাহেবে’র জন্য তৈরি হওয়া আবেগকে উস্কে দিতে যাঁকে গত ৫৫ বছরে দেখা যায়নি, সেই প্রতিভা পওয়ারকে (শরদের স্ত্রী) দেখা যাচ্ছে মঞ্চে বসে থাকতে। আর অজিত ফোন করে সমস্ত কর্পোরেটর এবং ভোট সংক্রান্ত প্রশাসনিক পদে থাকা কর্তাদের কড়া স্বরে জানাচ্ছেন, কোনও ‘বেচাল’ না করতে।
শরদ জীবনের শেষ বড় লড়াইটা লড়ছেন, অজিতের স্বপ্ন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy