গৌরীকুঞ্জ। ছবি: পার্থ চক্রবর্তী।
প্রতি রবিবারের সকালে যেন প্রাণ ফিরে পায় ঘাটশিলার ডাহিগোড়ার ‘গৌরীকুঞ্জ’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাড়ি।
একটা সময়ে অবহেলায় প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল খোলার চালের মাটির বাড়িটি। উন্নয়ন সমিতির তৎপরতায় ভোল বদলেছে। কংক্রিটের তোরণ হয়েছে। মূল ভবনের পাশে হলঘর গড়ে নাম রাখা হয়েছে বিভূতিভূষণের একমাত্র পুত্রের নামে ‘তারাদাস মঞ্চ’। রবিবার সকাল ১০টা থেকে পাঠশালা হয়ে ওঠে এই মঞ্চ। স্থানীয় কচিকাঁচারা দল বেঁধে আসে বাংলা শিখতে। অবসরে যাওয়া শিক্ষকেরাই পড়ান তাঁদের। নিঃশুল্ক এই শিক্ষাকেন্দ্রের নাম ‘অপুর পাঠশালা’।
চাকরিবাকরি বা শংসাপত্রের আকর্ষণ নেই এই পড়াশোনার। আছে নিখাদ ভাষাপ্রেম। হিন্দি বা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ার ফলে মাতৃভাষা বাংলা চর্চার সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলা কথা হয়তো বাড়িতে বলা হচ্ছে, কিন্তু আটকে যেতে হচ্ছে পড়তে গিয়ে। শুধু বাঙালি নয়, উৎসাহী যে কোনও ভাষাভাষী তরুণই ‘অপুর পাঠশালা’য় ভর্তি হতে পারে। হয়ও। ঝাড়খণ্ড বাংলাভাষী উন্নয়ন সমিতির সভাপতি অচিন্ত্যম গুপ্ত জানালেন, এক মারোয়াড়ি তরুণ এই পাঠশালায় বাংলা শিখে ছোটদের দিব্যি পড়াচ্ছেন।
২০০৪-এ বাংলাকে দ্বিতীয় রাজ্যভাষা ঘোষণা করেছিল ঝাড়খণ্ড সরকার, তবে তার সঙ্গে আরও ১১টি ভাষাকে জুড়ে দিয়ে। অথচ সরকারি হিসেবে এ রাজ্যের জনসংখ্যার অন্তত ৩৬ শতাংশ বাংলাভাষী। ওই ঘোষণায় এ রাজ্যের বাঙালিরা ক্ষুব্ধ হলেও আস্থা রেখেছিলেন সরকারের আশ্বাসে— বাংলা স্কুল হবে, বাঙালি প্রধান এলাকার সব স্কুলে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা ও পরীক্ষার বন্দোবস্ত হবে, তার জন্য বাংলা শিক্ষক নিয়োগ হবে, বাংলায় পাঠ্যবই হবে। সে সব তো কিছু হয়ইনি, উল্টে হাতে গোনা বাংলা স্কুলগুলিকেও হিন্দি স্কুলে পরিণত করা হয়েছে। সঙ্গে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের রমরমা।
সরকারের উপরে ভরসা করা ছেড়ে এ বার তাই নিজেরাই শিশুদের মনে বাংলার বীজ পুঁততে নেমেছে বঙ্গভাষী উন্নয়ন সমিতি। রাঁচী, হাজারিবাগ, কোডার্মা, বোকারোর বাঙালি প্রধান গ্রামগুলির অপু-দুর্গারা এখন রবিবার সকাল হলেই খাতাবই বগলে পাথুরে টাঁড়জমি পেরিয়ে দে-ছুট ‘অপুর পাঠশালা’-য়।
এ তো গেল বর্ণমালা। রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুলগীতি, লোক গান, কীর্তন, ভক্তিগীতি, বাংলা কবিতা আবৃত্তি, নাট্যচর্চায় অনুপ্রেরণা জোগাতে গত কয়েক বছর ধরে জামশেদপুর শহরে সব চেয়ে বড় মাঠ গোপাল ময়দানে ‘বঙ্গোৎসব’-এর আয়োজন করছে বঙ্গভাষী উন্নয়ন সমিতি।
তবে শহুরে বাঙালিদের গা-নেই। শহরে তাই ‘অপুর পাঠশালা’-ও গড়ে তোলা যায়নি, জানাচ্ছেন বাংলাভাষী উন্নয়ন সমিতির সভাপতি অচিন্ত্যম। সম্প্রতি বাংলাপ্রধান এলাকার রেলস্টেশনগুলির বোর্ড থেকে বাংলায় লেখা উধাও করে উর্দুতে লেখা হয়েছিল স্টেশনের নাম। বাঙালি সমাজ স্টেশনে বিক্ষোভ দেখাতে রেল কোম্পানি জানায়, রাজ্য সরকারই ঠিক করে দেয় কোন স্টেশনে কোন ভাষায় নাম লেখা হবে। অচিন্ত্যমের নেতৃত্বে রাঁচী গিয়ে ধর্নায় বসেন বাঙালিরা। অবশেষে শিবু সোরেনের হস্তক্ষেপে স্টেশনে স্টেশনে বাংলা ফিরিয়ে উল্লাসে মেতেছেন বাঙালিরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটা লাভের কথা জানাচ্ছেন অচিন্ত্যম, সব প্রধান রাজনৈতিক দল এ বার ভোটের আগে আলাদা করে বাঙালি সমাজের প্রতিনিধিদের বৈঠকে ডেকে জানতে চেয়েছেন, কী চান তাঁরা। ২৪ বছরে এই প্রথম!
তার পরেও হতাশায় অচিন্ত্যম— “যতটা হওয়ার ততটা হচ্ছে কই! সরকার জামশেদপুরের স্কুলগুলিতে বাংলা বই পাঠিয়েছে বলে খুব প্রচার করল। যেখানে পাঁচ হাজার বই দরকার, পাঠাল পাঁচশো। তার উপরে রাজনীতির ভেদাভেদ।” ঝাড়খণ্ডে বাংলা ভাষা প্রসারের কাজে দীর্ঘদিন ধরে লেগে থাকা শিবলাল ঘোষ বলেন, “এখানকার বাঙালির একতা থাকলে অনেক দূর এগোনো যেত।” আদতে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা শিবলালের শৈশব কৈশোর কেটেছে দুমকায়। তাঁর মতে, “কাঁকড়ার প্রবৃত্তি শোনা যায় বাঙালির মজ্জাগত। ঝাড়খণ্ডের বাঙালি যেন আরও এককাঠি এগিয়ে। এক জন একটু উঠে গেলে বাকিরা উঠে পড়ে লাগেন তাঁকে হিঁচড়ে নামাতে।”
ঝাড়খণ্ড জুড়ে বহু পুরনো পুরনো বাঙালি ক্লাব রয়েছে। জামশেদপুর, রাঁচী, বোকারো, হাজারিবাগ, দুমকা সব শহরে। রাঁচীর ইউনিয়ন ক্লাব তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমবয়সি। জামশেদপুর ১০৩ বছরের পুরনো বেঙ্গলি ক্লাব। সেখানকার সদস্য বিশ্বদীপ মণ্ডল বলেন, “অধিকাংশ ক্লাবের মতো এই ক্লাবও আদতে বৃদ্ধাবাসে পরিণত হয়েছে। কারণ, তরুণরাই তো রাজ্যে নেই! লেখাপড়ার যা হাল, রাজ্যের বাইরে যেতেই হবে। বুড়োরা তাস পিটিয়ে চলে যান। বিয়েবাড়িতে হল ভাড়া দিয়ে আয়হয় ক্লাবের।”
ঝাড়খণ্ডের ১৪টি আসনে কোনও রাজনৈতিক দল এক জনও বাঙালি প্রার্থী দেয়নি। কেন?
ঝাড়খণ্ডের শাসক দল জেএমএমের এক শীর্ষ নেতাকে প্রশ্নটি করতে তিনি মুচকি হাসেন। পাল্টা প্রশ্ন করেন, “কেন বাঙালি প্রার্থী দেবে, হেরে যেতে?” ব্যাখ্যাও দিলেন— “ধরুন এই জামশেদপুর লোকসভা আসনে আমরা সমীর মহান্তিকে প্রার্থী করেছি। এই কেন্দ্রে বহু ওড়িয়াভাষী ভোটার রয়েছেন। আমরা নিশ্চিত, তাঁদের পাঁচটা ভোটও অন্য দিকে পড়বে না। অথচ কোনও বাঙালিকে প্রার্থী করলে তাঁদেরই একাংশ তাঁকে হারাতে উঠে পড়ে লাগতেন।” মনে করিয়ে দিলেন ওই নেতা, “সমীর মহান্তি কিন্তু বাংলা ভাষায় বিধানসভায় শপথ নিয়েছিলেন, জানেন তো?”
বিজেপির মুখপাত্র প্রতুল সহদেও আবার সাবধানী। বলেন, “ঝাড়খণ্ডের বাঙালিদের বড় অংশ বরাবর আমাদের সঙ্গে আছেন। বিজেপি জাতীয়তাবাদী দল। প্রার্থী বাছতে জাত-পাত-প্রাদেশিকতা দেখি না আমরা। সবাই নরেন্দ্র মোদীর প্রার্থী।”
ঝাড়খণ্ডের একমাত্র বাঙালি সাংসদ মহুয়া মাঝি রাজ্যসভার সদস্য। আগে রাজ্যের মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন ছিলেন, ছিলেন জেএমএমের মহিলা শাখার প্রধান। জানালেন, তাঁর উদ্যোগেই রাজ্য সরকার রাঁচীর টেগোর হিল সাজিয়ে তুলেছেন। মহুয়া বলেন, “ডিসেম্বরে আমাদের আবার সরকার গড়া একরকম নিশ্চিত বলতে পারেন। এই সরকারের বড় সময় কেটেছে কোভিড সামলাতে। মুখ্যমন্ত্রী আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এ বার বাঙালি সমাজের দাবিগুলি তিনি দেখবেন। কয়েক হাজার বাংলা শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। যথেষ্ট বাংলা পাঠ্যবইও যাবে স্কুলে স্কুলে।”
ঝাড়খণ্ডে আশায় বাঁচেন— বাঙালি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy