প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
মাটি ফাটা রোদে পুড়ে খেত থেকে বাড়ি ফিরছিলেন বৃদ্ধ। পথে ক্লান্ত হয়ে বাগদা ব্লকের হেলেঞ্চ-দত্তপুলিয়া সড়কের পাশে গাছ তলায় বসে বিড়ি ধরালেন। ভোটের প্রসঙ্গ তুলতেই বৃদ্ধ উত্তেজিত, ‘‘সেই ছোটবেলায় বাবা-মায়ের হাত ধরে ভিটেবাড়ি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে এ দেশে চলে এসেছিলাম। এখানেই পড়াশোনা, কাজকর্ম। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সবই আছে। নিয়মিত ভোট দিচ্ছি। এর পরও কি আমি এ দেশের নাগরিক নই? মরার আগে শেষে এই অপবাদ জুটবে না তো?’’
মতুয়া ও উদ্বাস্তু প্রধান বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে এখন ওই বৃদ্ধের প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র।
এখানকার মানুষ ঠাকুরবাড়ি বলতে বোঝেন গাইঘাটার ঠাকুরনগরে শ্রীধাম ঠাকুরবাড়িকে। তৃণমূল-বিজেপির ভোট প্রচারও আবর্তিত হচ্ছে ওই ঠাকুরবাড়িকে ঘিরেই। তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে অন্দরমহলের টানাপড়েন। কখনও টানাটানি হচ্ছে প্রয়াত বড়মা বীণাপানি দেবীর ঘর নিয়েও। এই ঘটনায় অনেক মতুয়া ভক্তই তিতিবিরক্ত। তাঁরা বলছেন, ঠাকুরবাড়িকে রাজনীতি মুক্ত করা হোক।
মতুয়া উদ্বাস্তুদের বরং অনেক বেশি চর্চার বিষয় সিএএ এবং নাগরিকত্ব। পাঁচ বছর আগে এই নাগরিকত্বের দাবিতে বিজেপিকে ভোটে ভরিয়ে দিয়েছিল তারা। এ বারে লোকসভা ভোট ঘোষণার ঠিক আগে কেন্দ্র সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন)-এর বিধি কার্যকর করার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি জারির পরে মতুয়া-উদ্বাস্তু সমাজ কার্যত দু’ভাগে বিভক্ত। এক দিকে বলা হচ্ছে, সিএএ হয়েছে, এ বারে নাগরিকত্বও দেওয়া হবে। অন্য দিকের দাবি, আবেদন করে নাগরিকত্ব তাঁরা চান না।
তৃণমূল ও বিজেপি, দু’পক্ষের প্রচারেই ঘুরেফিরে আসছে বিষয়টি। তৃণমূল সাবধান করে দিচ্ছে, কেউ আবেদন করবেন না। এক বার আবেদন করলে আর আপনি নাগরিক থাকবেন না। আবেদন গ্রাহ্য না হলে সোজা ডিটেনশন ক্যাম্প। উল্টো দিকে, খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যাখ্যা দিয়েছেন, আবেদন খারিজ হওয়ার অর্থ, আপনি ইতিমধ্যেই নাগরিক।
বনগাঁ শহরে মতিগঞ্জ এলাকায় একটি চায়ের দোকানে বসে বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর বলছিলেন, ‘‘সিএএ নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারিতে আমার কী লাভ হয়েছে, জানি না। তবে উদ্বাস্তু
মানুষদের স্বপ পূরণ হয়েছে। তাঁরা নাগরিকত্ব পাচ্ছেন।’’ গাইঘাটায় মিছিলের ফাঁকে তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস বললেন, ‘‘নাগরিকত্ব নিয়ে বিজেপির ভাঁওতাবাজি মতুয়ারা ধরে ফেলেছেন। এর প্রভাব ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হবেই।’’ সবই শুনছেন মতুয়া ভক্তেরা। গাইঘাটার বাসিন্দা, মতুয়া ভক্ত বিনয় বিশ্বাস বলছিলেন, ‘‘নাগরিকত্ব নিয়ে প্রচার, পাল্টা প্রচারে আমরা, উদ্বাস্তু মানুষেরা বিভ্রান্ত। উদ্বিগ্ন।’’
তবে সিএএ-ই সব নয়। দু’দলের আছে গোষ্ঠীকোন্দল। যা নিয়ে দু’দলেরই শীর্ষ নেতৃত্বকেই এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। বিজেপির অন্দরে গুঞ্জন, বিজেপি নেতৃত্ব এবং প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর চেষ্টা করেও দলের সবাইকে সক্রিয় ভাবে মাঠে নামাতে পারেননি। কেউ কেউ আবার প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভায় যাচ্ছেন, কিন্তু এলাকায় বার হচ্ছেন না। কোন্দল মেটাতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে আসতে হয়েছিল বলে দলীয় সূত্রের খবর।
বিজেপি অস্বস্তির আরও একটি কারণ, দলের বিধায়কদের ‘অনুপস্থিতি’। বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক স্বপন মজুমদার বারাসতে এবং হরিণঘাটার বিধায়ক অসীম সরকার পূর্ব বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্রে দলের প্রার্থী। ফলে বিধায়কের অভাবে এই দুই বিধানসভা কেন্দ্রে প্রচারে গতি নেই। শুধু বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবদাস মণ্ডল দিনরাত এক করে খাটছেন।
তৃণমূলকে ভরসা দিচ্ছে গত পঞ্চায়েত ভোটের ফল। লোকসভার অন্তর্গত ৭০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৬৩টি তৃণমূল দখল করেছিলে। সেই সাফল্য ধরে রাখতে চাইছে তৃণমূল। আবার উল্টো দিকে, কল্যাণী এবং হরিণঘাটা এলাকায় গোষ্ঠীকোন্দল ভোগাতে পারে তৃণমূলকে। কল্যাণীর এক প্রবীণ তৃণমূল কর্মী বলছিলেন, ‘‘দলের নেতারা একসঙ্গে, মঞ্চে হাসি মুখে, পাশাপাশি বসে রয়েছেন। কিন্তু মঞ্চ থেকে নামলেই তাঁরা আলাদা।’’ যদিও তৃণমূলের নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘আমরা এ বারে ঐক্যবদ্ধ।’’
কাঁটার কিন্তু অভাব নেই। এমনকি পুরসভা এলাকাতেও ভোট দিতে না পারার ক্ষোভ রয়েছে মানুষের মধ্যে। আছে তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাসের
দল বদল নিয়ে ক্ষোভও। বাগদায় এক প্রবীণ বলছিলেন, ‘‘যাঁকে ভোট দিয়ে বিধায়ক করেছিলাম, তিনি জিতে তৃণমূলে ফিরে গেলেন। ভোটের পর বিজেপিতে ফিরবেন না, এই নিশ্চয়তা কোথায়?’’
২০১১ সালের পর থেকে সিপিএম এখানে ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। দলের বহু কর্মী বিজেপি-তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন। সেই রক্তক্ষরণ এখনও অব্যাহত। কংগ্রেসের অবস্থা আরও খারাপ। সর্বত্র কর্মী খুঁজে পেতে কালঘাম ছুটছে। এ বার বাম-কংগ্রেসের জোট প্রার্থী, কংগ্রেসের প্রদীপ বিশ্বাস। তিনি নিজে মতুয়া সমাজের মানুষ। এ বারে অবশ্য মিছিলে ভিড় হচ্ছে। পুরনো কর্মীদের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে তরুণদেরও। করোনার সময়ে বামেরা যে ভাবে মানুষের পাশে থেকেছেন, সেই প্রসঙ্গ তুলছেন অনেকেই। তবে সংশয়, তা ভোটবাক্সে যাবে? ২০১৯ সালের ভোটে সিপিএম ও কংগ্রেস এখানে আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল। সিপিএম ৬.৪০ শতাংশ ভোট পায়, কংগ্রেস ১.৬১ শতাংশ। এক সিপিএম সমর্থক অবশ্য বললেন, ‘‘সেই দলকেই এ বারে ভোট দেব, যে দল জিতবে।’’ তার পরে রেখে গেলেন একটি অর্থপূর্ণ হাসি।
চড়া রোদে প্রচারে বেরিয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী। তাঁর কথায়, ‘‘সিএএ নিয়ে নরেন্দ্র মোদী কতটা ভাঁওতা দিয়েছেন, তাই বোঝাচ্ছি মানুষকে।’’ তিনি আশাবাদী মতুয়া ভোট পাওয়া নিয়ে।
তিন প্রধান ছাড়াও প্রার্থী আছেন। যেমন শ্রীশ্রী শাম্ভিহরি গুরুচাঁদ মতুয়া ফাউন্ডেশনের সুমিতা পোদ্দার নির্দল প্রার্থী। তাঁর মুখেও সিএএ। বললেন, ‘‘সিএএ তো নিঃশর্ত নাগরিকত্ব নয়। আমরা এই আইন বাতিলের দাবি করেছি।’’ আছেন আইএসএফ প্রার্থী দীপক মজুমদার। কিন্তু তাঁকে সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না। দীপকের কথায়, ‘‘পুরোদস্তুর প্রচার শুরু করিনি এখনও।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy