গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব তথা সমাজবাদী পার্টির উত্থানকে অনেকে ‘আগুনপাখি’ আখ্যা দিয়েছেন। বিবিধ চাপের মধ্যেও তামিলনাড়ুতে সাফল্য ধরে রেখেছেন এমকে স্ট্যালিন। ভাঙাগড়ার খেলার মধ্যে চোয়াল শক্ত করে বিহারে লড়ে গিয়েছেন তেজস্বী যাদব। প্রবল গর্জনে ভোটের আকাশ-বাতাস মুখরিত হলেও বাংলায় তৃণমূলের থেকে অনেকটা পিছিয়ে বিজেপি। সৌজন্যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরেও লড়াই করে মহাজোটকে এগিয়ে দিয়েছেন। মরাঠা মুলুকে ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি তথা এনডিএ। বিজেপি তথা এনডিএ শিবিরে জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে, জিতিন প্রসাদ, জয়ন্ত চৌধরি, লোকেশ নারারাও সাফল্য পেয়েছেন।
এ বারের লোকসভা ভোটে উত্তর থেকে দক্ষিণ— আঞ্চলিক দলগুলির দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিকদের সাফল্য দেখল দেশ। কোথাও কোথাও জুড়ে গেল তৃতীয় প্রজন্মও।
অখিলেশের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টি উত্তরপ্রদেশে যে ফল করেছে, অনেকের মতে তা এই লোকসভা ভোটে সবচেয়ে বেশি ‘রাজনৈতিক তাৎপর্য’ তৈরি করে দিয়েছে। খোদ ‘রামরাজ্যে’ রামধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। পদ্মশিবিরকে পরাস্ত হতে হয়েছে ফৈজাবাদে। যে লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে অযোধ্যায় মহা ধুমধামে নির্মিত হয়েছিল রামন্দির। পিতা মুলায়ম সিংহ যাদবের পর অখিলেশ এসপি-র দায়িত্ব নিয়েছিলেন। শেষ জীবনে মুলায়মের সঙ্গে অবশ্য পুত্রের সংঘাত বেধেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত নানা বাঁক পেরিয়ে অখিলেশ এই সাফল্যে পৌঁছেছেন। মুখ্যমন্ত্রী এবং অধুনা বিরোধী দলনেতা হয়েছেন। গোটা উত্তরপ্রদেশ চষে বেড়িয়ে সংগঠনের নবনির্মাণ করেছেন। ফলপ্রকাশের পর বলেছেন, ‘‘অনেকে বিশ্বাস করতে পারতেন না উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে হারানো সম্ভব। রামমন্দিরের পর তো আরওই না। এখন তাঁরাও বিশ্বাস করছেন। কারণ, আমরা সেই নজির তৈরি করতে পেরেছি।’’
উত্তরপ্রদেশ থেকে দাক্ষিণাত্যে। এম করুণানিধির পর ডিএমকে-র হাল ধরেছিলেন তাঁর পুত্র স্ট্যালিন। তামিলনাড়ুকে এ বারও তিনি বিজেপি-শূন্য রাখতে সক্ষম। দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে তামিলভূমেই সবচেয়ে বেশি বার গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যার শুরুটা হয়েছিল গত বছর নতুন সংসদ ভবনে ‘সেঙ্গল’ প্রতিস্থাপনের মধ্যে দিয়ে। যে ‘সেঙ্গল’ আসলে দ্রাবিড় ভাবাবেগের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা গেল, নিজের রাজ্যকে বিজেপি-মুক্ত রাখতে পেরেছেন স্ট্যালিন। স্ট্যালিন যদি দ্বিতীয় প্রজন্মের হন, তা হলে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন তাঁর পুত্র উদয়নিধি স্ট্যালিন। অর্থাৎ, তৃতীয় প্রজন্ম। উদয়নিধি তামিলনাড়ুর মন্ত্রী। বাবার মন্ত্রিসভার সদস্যও বটে। সংগঠনে বড় দায়িত্বে তিনি নেই। তবে পেশাদার সংস্থার ব্যবহার, সমাজমাধ্যমের প্রচার-সহ বিষয় তদারক করেন উদয়নিধিই।
দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিক হিসেবে দাগ কেটেছেন লালু-তনয় তেজস্বীও। বিহারের রাজনীতিতে লালুপ্রসাদ যাদবের পরে তেজস্বীর শুরুর দিক তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। অনেকে বলতেন, সুনীল গাওস্করের পর তাঁর পুত্র রোহনের ক্রিকেটের মতো। তুলনা করতে যাওয়াই অর্থহীন। ঘটনাচক্রে, তেজস্বীও ক্রিকেট খেলতেন। তবে ২২ গজের পাট চুকিয়ে রাজনীতিকেই নিজের মাঠ করেছেন তিনি। গত কয়েক বছরে সেই তেজস্বীও ‘পরিণত’। ছিলেন বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী। নীতীশ কুমার ডিগবাজি দেওয়ার পর তিনি বিরোধী দলনেতা। সেই তিনি বিহারে চারটি আসন জিতেছেন এ বারের লোকসভায়। সংখ্যার নিরিখে তা বিরাট কিছু নয়। তবে একক দল হিসেবে তেজস্বীর রাষ্ট্রীয় জনতা দল সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে। ২২.১৪ শতাংশ। অনেকের মতে, এর মধ্যে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে। ভোট সমীকরণ তেমনই বলছে।
মহারাষ্ট্রেও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের নেতারা সফল। বালাসাহেব ঠাকরের তৈরি শিবসেনা টুকরো হয়েছে গত বছর। ছেলে উদ্ধব লড়ে গিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরতে হয়েছে ‘অন্তর্ঘাতে’। দল ভেঙেছে। তিনি ভাঙেননি। উদ্ধবের সঙ্গে জুড়ে রয়েছেন তাঁর পুত্র আদিত্য। যিনি তৃতীয় প্রজন্মের। যিনি দলীয় কাজে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার দেখভাল করেন। সারা বছর ‘ওয়ার রুম’ চালান। মহারাষ্ট্রে উদ্ধবের দল কংগ্রেস এবং এনসিপি-র সঙ্গে জোট করে লড়ে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করেছে। এনসিপি-তেও ভাঙন হয়েছে। শরদ পওয়ারের হাত থেকে দলের নাম-প্রতীক কেড়ে নিয়েছেন ভাইপো অজিত। তবে মেয়ে সুপ্রিয়া সুলেকে নিয়ে ‘মরাঠা স্ট্রং ম্যান’ ২০২৪ সালের লোকসভাতেও দেখিয়ে দিয়েছেন, এ ভাবেও লড়ে নেওয়া যায়।
আর ঘরের কাছের বাংলায় মমতার ‘ভাইপো’ থেকে অভিষেক হয়ে উঠেছেন তৃণমূলের ‘সেনাপতি’। এই লোকসভা ভোটে সংগঠনে এবং প্রচারে তিনি যে ভূমিকা নিয়েছেন, তা সর্বজনবিদিত। ভোটের ফলপ্রকাশের পরে মমতা বলেছেন, ‘‘অভিষেকই ম্যান অফ দ্য লোকসভা ভোট।’’ সংগঠন, প্রচারের নকশা আঁকা, পেশাদার সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে সংগঠনকে পরিচালনা করা— সব করেছেন তিনিই। ২০২১ সালের বিধানসভার পর ২০২৪ সালেও। সন্দেহ নেই, বিবিধ দুর্নীতির অভিযোগে লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূল বিড়ম্বিত ছিল। ঘরোয়া আলোচনায় নেতারাও মানতেন সে কথা। তবে ‘বিপরীত আখ্যান’ তৈরি করে অভিষেক পদ্মশিবিরকে আগের থেকে নীচে নামিয়ে দিতে পেরেছেন। ভোট এবং আসন— দুই-ই বেড়েছে তৃণমূলের।
বস্তুত, বিজেপি বা এনডিএ শিবিরেও দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের রাজনীতিকেরা রয়েছেন। লোকসভা ভোটে তাঁরাও নিজেদের মতো করে ‘সফল’। যেমন, মধ্যপ্রদেশের জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে। প্রয়াত কংগ্রেস নেতা মাধবরাও শিন্ডের ছেলে কংগ্রেস শুধু ছাড়েননি, বিধায়ক ভাঙিয়ে মধ্যপ্রদেশে কমলনাথ সরকার ফেলে দিয়েছিলেন। তার পরে ভোপালের কুর্সি দখল করেছে বিজেপি। সে রাজ্যে এ বার লোকসভায় সব আসন জিতেছে পদ্মশিবির। জিতেছেন জ্যোতিরাদিত্য নিজেও। দ্বিতীয় মোদী সরকারের মধ্য মেয়াদে তাঁকে কেন্দ্রে মন্ত্রী করেছিল বিজেপি। জ্যোতিরাদিত্যের বাবা এক সময়ে ছিলেন অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী। প্রথমে পুত্রকেও সেই মন্ত্রকই দেওয়া হয়েছিল। এ বার তাঁকে টেলিযোগাযোগ এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রক দেওয়া হয়েছে।
কংগ্রেসি পিতার পুত্র আরও এক জন এ বার ঠাঁই পেয়েছেন নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভায়। তিনি প্রয়াত জিতেন্দ্র প্রসাদের ছেলে জিতিন প্রসাদ। জিতিন উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ইস্তফা দিয়ে এ বার কেন্দ্রে প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। জিতিনের বাবা প্রাক্তন দুই প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এবং নরসিংহ রাওয়ের প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন। ২০০০ সালে সনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাস্ত হন। সেই সূত্রেই পুত্র জিতিনের রাজনীতিতে আসা। একটা সময়ে রাহুল গান্ধীকে ঘিরে যে তরুণ রাজনীতিকদের বলয় তৈরি হয়েছিল, তার অন্যতম ছিলেন জিতিন। দ্বিতীয় মনমোহন সিংহ সরকারে প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। উত্তরপ্রদেশের গত বিধানসভা ভোটের আগে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন তিনি।
গরিষ্ঠতা না-পাওয়ায় নরেন্দ্র মোদীকে এ বার ‘পরনির্ভর’ সরকার গঠন করতে হয়েছে। শরিকদের দাবিদাওয়া মানতে হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে উত্তরপ্রদেশ থেকে এনডিএ শরিক হিসেবে মাত্র দু’টি আসন জেতা আরএলডি-র প্রধান জয়ন্তকে কেন্দ্রে প্রতিমন্ত্রী করতে হয়েছে। তিনি অবশ্য রাজ্যসভার সাংসদ। জয়ন্ত তৃতীয় প্রজন্মের রাজনীতিক। তাঁর ঠাকুরদা চৌধুরি চরণ সিংহ দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। বাবা অজিত সিংও মনমোহন জমানায় কেন্দ্রে মন্ত্রী থেকেছেন।
উত্তরপ্রদেশে যেমন অখিলেশ ‘খেলা’ দেখিয়েছেন, তেমনই অন্ধ্রে ‘পুনরুত্থান’ হয়েছে চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলগু দেশম পার্টির। রাজ্যে সরকার গড়ার পাশাপাশিই লোকসভায় অন্ধ্রের ২৫টির মধ্যে একাই ১৬টি জিতেছে টিডিপি। এনডিএ-র অন্যতম বড় শরিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন চন্দ্রবাবু। রাজ্যে মন্ত্রিসভায় জায়গায় পেয়েছেন চন্দ্রবাবুর ছেলে লোকেশ নারা। আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পড়ে এসেছেন লোকেশ। কয়েক মাস আগে দুর্নীতি মামলায় জেল খেটে আসা চন্দ্রবাবুর পুনরুত্থানে ছেলে লোকেশের বড় ভূমিকা রয়েছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিক হিসেবে তিনিও পেশাদার সংস্থাকে ব্যবহার করেছিলেন সংগঠনে-প্রচারে। ফল মিলেছে। অন্ধ্রে চন্দ্রবাবুর ‘প্রত্যাবর্তন’-এর পাশাপাশি পুত্র তথা দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিভূ লোকেশের ‘উত্থান’ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিকদের এই উত্থান ‘স্বাভাবিক’ বলছেন অনেকে। কারও কারও মতে আবার এই সাফল্য দীর্ঘমেয়াদি না-ও হতে পারে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান প্রশান্ত রায়ের কথায়, ‘‘স্ট্যালিন, উদ্ধব, অখিলেশ বা অভিষেকের সাফল্য বা উঠে আসা আমার কাছে অস্বাভাবিক নয়। কারণ, তাঁরা রক্তের সম্পর্কের জন্যই সেই জায়গা পেয়েছেন। আমার কাছে আগ্রহের বিষয় প্রথম প্রজন্মের রাজনীতিকেরা। যাঁদের পরিবারের তিন কূলে কেউ কখনও রাজনীতি করেননি।’’ এই প্রসঙ্গে তিনি বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের নাম করেছেন। প্রশান্ত এ-ও বলেছেন, ‘‘বামদল বা কমিউনিস্ট পার্টিতে দ্বিতীয় প্রজন্মের কারা রাজনীতি করছেন, সেটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেখানে পারিবারিক পরিচয়ে নেতৃত্বে ওঠা যায় না।’’ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান প্রতীপ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে দ্বিতীয় প্রজন্মের সাফল্য দীর্ঘমেয়াদি না-ও হতে পারে। অচিরেই তাঁরা ব্যর্থ হতে পারেন। কারণ, বংশপরম্পরায় দলের নেতৃত্ব ঠিক হওয়া গণতান্ত্রিক লক্ষণ নয়।’’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেসে রাহুল গান্ধীর বদলে যদি কানহাইয়া কুমার বড় নেতা হন, তা আমার কাছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে অনেক আশাব্যঞ্জক।’’
অনেকের মতে, প্রথম প্রজন্মের সঙ্গে দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের রাজনীতিকদের দলগত মতৈক্য বা ফারাক থাকলেও ভাষা, কৌশল, রাজনীতি করার ধরনের ফারাক রয়েছে। প্রশান্ত বলছেন, ‘‘মমতা যে ভাষায় বক্তৃতা করেন, অভিষেক তা করেন না। মমতার ভাষা প্রান্তিক অংশকে ছুঁয়ে যায়। আর অভিষেক অনেক পরিশীলিত। সাবলীল ইংরেজি বলতে পারেন। মমতার রাজনীতির ভিত ছিল আন্দোলন। অভিষেকের তা নয়। ক্ষমতা দিয়েই শুরু।’’ তবে পেশাদার সংস্থার ব্যবহার, প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদিতে এখনকার তরুণ নেতাদের ঝোঁক রয়েছে বলেই মত অনেকের। তাঁরা আবেগের বদলে প্রযুক্তি দিয়ে রাজনীতি বেশি করেন। সেটাই রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথ বেঁধে দেবে কি না, জনতা তাকিয়ে সেই দিকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy