মতুয়া ভোট এ বার কোন দিকে?
কেন্দ্র সিএএ কার্যকর করার বিজ্ঞপ্তি জারি করার পর থেকেই বনগাঁ লোকসভা আসনকে নিয়ে এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। বিজেপি ও তৃণমূল দু’পক্ষই দাবি করছে, সিএএ নিয়ে বিজ্ঞপ্তি আখেরে ভোট বাক্সে তাদেরই সুফল দেবে।
বনগাঁ লোকসভা আসনে মতুয়া ভোটারের সংখ্যা ঠিক কত শতাংশ, তা নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ তথা অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি মমতা ঠাকুরের দাবি, বনগাঁ লোকসভা এলাকায় মতুয়া ভোটার প্রায় ৩২ শতাংশ। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুরের দাবি, এই লোকসভায় মতুয়া ভোটার প্রায় ৪২ শতাংশ। মতুয়া ভোটারের সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে দ্বিমত থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলি এ বিষয়ে একমত যে, এই লোকসভা আসনে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে মতুয়ারা নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়ে থাকেন। আর সে কারণেই সিএএ কার্যকর হওয়ার বিজ্ঞপ্তির পর মতুয়ারা কোন দিকে ঝুঁকে পড়েন, সে দিকেই তাকিয়ে তৃণমূল ও বিজেপির নেতারা।
২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে এ তল্লাটে বেশিরভাগ মতুয়া সমাজের মানুষের সমর্থন পেয়ে এসেছিল তৃণমূল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে পর্যন্ত সেই সমর্থন অটুট ছিল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের সময় থেকেই বেশিরভাগ মতুয়াদের সমর্থন বিজেপির দিকে ঘুরে যায়। ওই বছর বনগাঁ লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর জয়ী হয়েছিলেন ১,০৯,৮৫৫ ভোটের ব্যবধানে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বনগাঁ লোকসভা অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬টিতেই তৃণমূল পিছিয়ে ছিল।
বিজেপি লিড পেয়েছিল বাগদা, বনগাঁ উত্তর, বনগাঁ দক্ষিণ, গাইঘাটা, কল্যাণী ও হরিণঘাটা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। একমাত্র স্বরূপনগর বিধানসভা থেকে তৃণমূল প্রার্থী লিড পেয়েছিলেন। তৃণমূলের এই পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে অনেকেই মনে করেন, বামেদের বেশির ভাগ ভোট বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। মতুয়া ভোটও ধরে রাখতে পারেনি তৃণমূল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আরও মনে করেন, গত লোকসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে এসে সভা করে মতুয়াদের নাগরিকত্বের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তাতেই বিজেপি বাজিমাত করে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও এই লোকসভার সাতটি আসনের মধ্যে ৬টিতে বিজেপি জয়লাভ করেছিল।
মতুয়াদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল, সিএএ কার্যকর করে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু এখন মতুয়ারা অনেকেই এ বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত। তাঁদের অনেকে চেয়েছিলেন, আবেদনের ভিত্তিতে নয়, নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেওয়া হোক। অভিযোগ, সিএএ-তে নিঃশর্ত নাগরিকত্বের ব্যবস্থা নেই। আবেদন করে নাগরিকত্ব নিতে হবে। তা অনেকে চান না। অনেক মতুয়া ভক্ত মনে করছেন, তাঁদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড আছে। তাঁরা নাগরিক। খামোখা আবার আবেদন করে নাগরিকত্ব নেবেন কেন! আবেদন করলে যদি ক্ষতি হয়, এই আশঙ্কা কাজ করছে এঁদের মনে। মূলত ওপার বাংলা থেকে আসা মানুষ, যাঁদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড নেই, সিএএ তে তাঁদের সুবিধা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁরা নাগরিকত্ব পেয়ে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড পাবেন।
শান্তনু জানিয়েছেন, রাজ্যে এমন মতুয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষের উপর। সেই সব মানুষের এ বার অন্তত ভোট দেওয়া সুযোগ নেই। ফলে ওই অংশের মানুষের সমর্থন এখনই কোনও রাজনৈতিক দল পাচ্ছে না।
মতুয়াদের সমর্থন পাওয়া নিয়ে শান্তনু ঠাকুর বলেন, ‘‘সিএএ নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ায় গত লোকসভা ভোটের থেকেও এ বার আমার জয়ের ব্যবধান আরও বাড়বে। মতুয়াদের নাগরিকত্বের স্বপ্নপূরণ হওয়ায় তাঁরা আরও বেশি করে বিজেপিকে সমর্থন করবেন।’’ যদিও তৃণমূল নেত্রী মমতা ঠাকুর বলেন, ‘‘সিএএ কার্যকর করার বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ায় বনগাঁ লোকসভা আসনে মতুয়াদের বেশি করে সমর্থন আমরা পাব। তার কারণ, মতুয়ারা চেয়েছিলেন নিঃশর্ত নাগরিকত্ব। সিএএ-তে সেই বিষয়টি নেই। আবেদনপত্র পূরণ করে নাগরিক হতে হবে। মতুয়ারা তা মেনে নিচ্ছেন না। তাঁরা ক্ষুব্ধ। দু’এক দিনের মধ্যেই মতুয়ারা সিএএ বাতিলের দাবিতে এবং নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবিতে রাস্তায় নামছেন।’’
সব মিলিয়ে এখন মতুয়াদের মন মাপতে ব্যস্ত যুযুধান দুই শিবিরের নেতৃত্ব।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)