দিল্লির দ্বারকায় ভোট-প্রচারে মোদী। বুধবার। ছবি: পিটিআই।
ভুলেও এখানে পা ফেলতে দেখা যায়নি নরেন্দ্র মোদীকে। গেরুয়া পতাকা অথবা রামমন্দির নির্মাণের কোনও গৌরবচিহ্ন রাস্তায় দেখা যায় না, যেমনটি চোখে পড়ে রাজধানীর আবাসন বা অন্যান্য মাঝারি মাপের বাজার বিপণিতে। এমনকি, এখানকার বিজেপি প্রার্থী সুষমা স্বরাজের কন্যা বাঁশুরি স্বরাজের ছবি-সহ কোনও প্রচার পোস্টারও (সেই অর্থে অন্য কোনও দলেরও) চোখে পড়বে না। তবু দিল্লির অভিজাততন্ত্রের বিলাস ও বিপণি-মৃগয়ার কেন্দ্র এই খান মার্কেট রাজধানীর ভোটের চার দিন আগে শুধুমাত্র মোদীতেই মুগ্ধ!
গত লোকসভা নির্বাচনের আগে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী ‘খান মার্কেট গ্যাং’-এর বিরুদ্ধে কটু কথা বলায় তৈরি হয়েছিল আলোড়ন। প্রশ্ন উঠেছিল, তা হলে কি লাটিয়ানস দিল্লির অভিজাত শ্রেণিকেই নিশানা করতে চাইছেন ‘গরিবের সন্তান’ মোদী? যুগপৎ আশঙ্কিত এবং মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন খান মার্কেটের দোকানদার, কর্মচারি, ব্যবসায়ীরা। এ বার সেই মেঘ কেটে গিয়ে জ্যৈষ্ঠের দুপুরে প্রখর রোদে ভাসছে খান মার্কেটের গহনা, জুতো, বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য, লাউঞ্জ বার, কাফে বই বিপণি, বুটিক, মহার্ঘ পার্লার।
“মোদীজি কিন্তু একেবারেই খান মার্কেটের দোকানদার বা সাধারণ ক্রেতাদের উদ্দেশে ওই কথা বলেননি। এখানেই একটি কাফেতে সে সময় কিছু বখতিয়ার খিলজি এসে বড় বড় কথা বলছিলেন! তাঁদের সরব দাবি ছিল, সুযোগ এলেই নাকি মোদীকে হটিয়ে দেওয়া হবে। সেখানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক জনের কানে বিষয়টি যায়। তারপরই মোদীর এই প্রতিক্রিয়া”, দাবি খান মার্কেট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের গত ২৬ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব মেহরার। তাঁদের পারিবারিক ৭টি দোকানও রয়েছে এখানে। “মোদীজি-র ওই বক্তব্যের পর দিনই আমি সংবাদমাধ্যমকে জানাই, আমরা কী অপরাধ করেছি, যে এ কথা উনি বললেন? এরপরই ঘরোয়া ভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাদের এই কথাগুলি জানানো হয়েছিল।”
এ বারের লোকসভা ভোট নিয়ে কী ভাবছে খান মার্কেট? “ভাবার তো বিশেষ কিছু নেই, এটা দেশের ভোট, কোনও স্থানীয় সমস্যা সমাধানের জন্য পুরসভা বা বিধানসভার তো নয়। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার পোকা যদি না কাটে, তা হলে মানুষ দেশকেই আগে রাখবেন। এবং নরেন্দ্র মোদীর মতো দূরদৃষ্টি আর কার আছে। যিনি ২০৪৭ পর্যন্ত ভেবে রেখেছেন দেশের উন্নয়নের কথা,” দাবি সঞ্জীবের।
‘খান মার্কেট গ্যাং’-এর কথা প্রথম রসিকতার ছলে বলেছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। অভিজাত পরিবার থেকে আসা এক ঝাঁক অল্পবয়সি সাংসদ সে সময়ে মধ্যাহ্নভোজের সময় চলে আসতেন এখানকার রেস্তরাঁগুলিতে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুপ্রিয়া সুলে, মানবেন্দ্র সিংহ, জিতিন প্রসাদ, মিলিন্দ দেওরারা। পরে যোগ দিয়েছিলেন কানিমোঝি এবং কে কবিতাও। তবে এঁরা নন, খান মার্কেট বললেই যে পরিবারটির ছবি বারবার সামনে চলে আসে তা সনিয়া-রাহুল–প্রিয়ঙ্কার। সনিয়া গান্ধীর পছন্দ এখানকার টাউন হলের স্যামন এবং টুনার সুশি, রাহুল-প্রিয়ঙ্কা বারবার আসেন ‘স্মোক হাউস’-এ।
প্রিয়ঙ্কা সম্প্রতি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমি মোটেই লাটিয়ানস দিল্লির অভিজাত নই। বিদেশে পড়তে যাইনি। পড়েছি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেসাস অ্যান্ড মেরি কলেজে। আমার বন্ধুরাও সবাই সাধারণ পরিবারের। সে যাই হোক, খান মার্কেট একেবারেই খারাপ জায়গা নয়, আমি তো প্রায়ই যাই সেখানে।”
মেহরার কথায়, “ওঁদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আজও রয়েছে। ১০, জনপথের ফল, ফুল সব এখানকার একটি দোকান থেকে আজও যায়, আমরাই তার দেখভাল করি। রবার্ট ব্যক্তিগত স্তরে বন্ধুও। কিন্তু সে সব আর দেশের উন্নতি এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন এক নয়। কংগ্রেসকে ষাট বছর দিয়ে দেখা গিয়েছে, এখন আর মানুষের মন
ওদের সঙ্গে নেই। অন্তত খান মার্কেটের ব্যবসায়ী ও অধিকাংশ ক্রেতার মধ্যে নেই।”
‘স্মোক হাউস’-এর কর্মী যতীন পাণ্ডে (নাম পরিবর্তিত) বলেন, “এখানে এলে রাহুলজি স্মোকড চিকেন্ বার্গারটাই খেতে পছন্দ করেন। তারপর বড় কাপে কালো কফি।” তবে তাঁরও দাবি, রাহুল-প্রিয়ঙ্কা এখানে খেতে এলে তাঁদের সঙ্গে নিজস্বী তোলার ঢেউ ওঠে ঠিকই, কিন্তু দেশ চালনার ব্যাপারে মোদীজিকেই এখানে সবাই আগে রাখেন। তাঁর কথায়, “কেজরীওয়াল মহল্লা ক্লিনিক করে গরিবদের সুবিধা করেছেন, সরকারি স্কুলের ভোল বদলে দিয়েছেন। কিন্তু এখানে গ্রিন পার্ক, লোধি রোড, হাউস খাস, গ্রেটার কৈলাস থেকে খদ্দেররা আসেন। তাঁরা সমাজের এতটাই উঁচু তলার বাসিন্দা যে সরকারি স্কুল বা সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা, কোনওটাই দরকার পড়ে না। বরং মোদীজির জন্য বিদেশেও ভারতের নাম উজ্জ্বল হচ্ছে, এটাই গর্ব করে আলোচনা করতে শুনি।”
খান মার্কেটের জনপ্রিয় দোকান ‘খান চাচা’য় রোল খেতে এসেছেন গুলমোহর পার্ক থেকে সপরিবার হরপ্রতাপ সিংহ। ডিজাইনার বুটিকের মালিক, দিল্লিতে গোটা চারেক দোকান, রফতানিও করেন এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে। নিজের রাজ্য পঞ্জাবের কৃষক আন্দোলনের সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই তাঁর। দাবি করছেন, “জিনিসের দাম বেড়েছে, এটা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মনমোহন সিংহের সরকারে দশ বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ১০০ শতাংশ। আর মোদীজি আসার পর দশ বছরে বেড়েছে ৪০ শতাংশ। কোনও পাঁচতারা হোটেল, বিমান খালি যাচ্ছে নাকি? লোকের হাতে টাকা না থাকলে এটা হত?”
‘মিয়া মো ডিনার’-এ খেতে আসা সুশীল নেগি কেন্দ্রীয় সরকারের এক উচ্চপদস্থ প্রবীণ আমলা। এখানে সপ্তাহে এ কদিন আসেন প্রিয় পদ ওয়াইল্ড মাশরুম আর সি ফুড রিসোতো খেতে। বলছেন, “আগে তো একটা দাঁতের খড়কেও বাইরে থেকে আনতে হত। কংগ্রেস নিজেই সব শিল্প এখানে হয় তুলে দিয়েছে নয়তো সে ভাবে তৈরি করেনি। এ বার তৃতীয় মোদী সরকার হতে চলেছে। দেখবেন, চিন থেকে খেলনা আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে, গ্রেটার নয়ডায় সুবিশাল খেলনা পার্ক, খেলনা উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে উঠছে। দিল্লি ছেড়ে দিন, কোনও বড় সাম্প্রদায়িক অশান্তি, জঙ্গি আক্রমণ দেখেছেন গত দশ বছরে? পাকিস্তান ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে”, একটানা বলে রিসোতোয় মন দিলেন নেগি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy