(বাঁ দিকে) অধীর চৌধুরী, ইউসুফ পাঠান এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
যত দিন খেলেছেন, ‘স্ট্রাইক রেট’ ছিল চমকে দেওয়ার মতো। নজরকাড়া ছিল স্লগ ওভারে তাঁর ঝোড়ো ব্যাটিং। কলকাতা নাইট রাইডার্স তো বটেই, দেশের হয়েও বেশ কয়েক বার হারের মুখ থেকে ম্যাচ জিতিয়ে এনেছেন। ২২ গজের সেই ইউসুফ পাঠানকে অধীর চৌধুরীর গড় বহরমপুরে প্রার্থী করে চমক দিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অধীর বহরমপুরের পাঁচ বারের সাংসদ। তাঁর ‘দুর্গ’ দখল করতে বাংলার শাসকদল তৃণমূল এমন একজনকে প্রার্থী করল, ঘটনাচক্রে যিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাতের বরোদার বাসিন্দা।
আসন্ন লোকসভা ভোটে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কেন্দ্রের প্রার্থী হিসাবে ইউসুফের নাম ঘোষণা হওয়ার পর অধীর আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘ভালই হল। আমি এ বার সেলিব্রিটি হলাম। বাকিটা তো মানুষ বলবেন।’’ বহরমপুরে এ বার নির্মল সাহাকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। নির্মল বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীজির সবকা সাথ সবকা বিকাশে ভর করেই গোটা দেশে ভোট হবে। বহরমপুরে জয় আরও সহজ হল।’’
রাজ্য-রাজনীতিতে মমতা-অধীর বিবাদ সর্বজনবিদিত। জাতীয় স্তরে বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ তৈরি হলেও বঙ্গে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরের নেতৃত্বে বাংলার কংগ্রেস নেতাদের তৃণমূলের সঙ্গে আসনরফা নিয়ে অনীহা এবং পরে তৃণমূলও পিছিয়ে যাওয়ায় জোট ভেস্তে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনেই রবিবার প্রার্থী ঘোষণা করে দিল শাসকদল। সেই প্রার্থিতালিকায় অন্যতম চমক হলেন ইউসুফ।
রবিবার ব্রিগেড মঞ্চে প্রার্থী হিসাবে ইউসুফের নাম ঘোষণা করে তৃণমূল। তৃণমূল সূত্রে খবর, ব্রিগেড সমাবেশের পর যখন মধ্যাহ্নভোজ সারছিলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার, সেই সময় তাঁকে ফোন করেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার সচিন তেন্ডুলকর। সূত্র জানিয়েছে, সচিন ইউসুফকে বলেছেন, ‘‘মিঁয়া ময়দান মে উতর গয়ে হো তো আব যাও ছক্কে মারো।’’ এখন শ্রীলঙ্কায় একটি ঘরোয়া লিগ খেলছেন ইউসুফ। রবিবার সেখান থেকেই ব্রিগেডের ময়দানে এসেছিলেন তিনি। আবার রাতেই শ্রীলঙ্কা ফিরে যাওয়ার কথা তাঁর। প্রার্থী হওয়ার পর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে ইউসুফ লিখেছেন, ‘‘আমি চিরকালের জন্য শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে কৃতজ্ঞ, যিনি আমাকে তৃণমূল পরিবারে স্বাগত জানিয়েছেন এবং সংসদে জনগণের কণ্ঠস্বর হওয়ার দায়িত্বে আমার প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন। জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে, দরিদ্র ও বঞ্চিতদের উন্নতি সাধন আমাদের কর্তব্য। আশা করি, আমি সেটা অর্জন করতে পারব।’’
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বহরমপুর দখল করতে মমতা পাঠিয়েছিলেন গায়ক ইন্দ্রনীল সেনকে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। প্রায় তিন লক্ষ ৫৬ হাজার ভোটে জিতেছিলেন অধীর। পরে অধীরের জেলায় কংগ্রেসের দুর্ভেদ্য দুর্গ ভাঙতে মমতা পাঠিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারীকে। শুভেন্দু এখন বিজেপিতে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে শুভেন্দুর ‘ছোঁয়াতেই’ প্রথম বার মুর্শিদাবাদ থেকে দু’টি লোকসভা আসন জেতে তৃণমূল— মুর্শিদাবাদ ও জঙ্গিপুর। কিন্তু অধীরকে হারানো যায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেস থেকে আসা অপূর্ব সরকারকে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। তাতে ব্যবধানও অনেক কমেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহরমপুর ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন অধীর। সেই জায়গায় কেন এ বার ইউসুফের মতো একেবারে ‘অরাজনৈতিক’ চরিত্রকে প্রার্থী করল তৃণমূল, তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে। এর তিন সম্ভাব্য কারণ খুঁজে পেল আননন্দবাজার অনলাইন।
তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, ইউসুফকে প্রার্থীকে করার নেপথ্যে সব চেয়ে বড় কারণ হল গোষ্ঠীকোন্দল এড়ানো। জেলা সভানেত্রীর পদ যাওয়ার পরেই শাওনি সিংহ রায়কে লোকসভা ভোটের প্রার্থী করার দাবি দলের অন্দরে তুলছিলেন তাঁর অনুগামীরা। গতবারের প্রার্থী তথা বর্তমান জেলা সভাপতি অপূর্বও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কারও কারও দাবি, বহরমপুর পুরসভার চেয়ারম্যান নাড়ুগোপাল মুখোপাধ্যায়ও বহরমপুর কেন্দ্রের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। জেলার এক নেতা বলেন, ‘‘এঁদের কোনও এক জন টিকিট পেলেই বাকিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিতেন! সেটা সামলানো মুশকিল হয়ে যেত। কিন্তু সেখানে অন্য জায়গায় এক জন প্রার্থী হওয়ায় এ বার গোটা দল ঝাঁপিয়ে পড়বে।’’ মুর্শিদাবাদ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি অপূর্বও বলেন, ‘‘ভাল মনে করেছে বলেই ইউসুফকে প্রার্থী করেছে দল। আমাদের কর্মী-সমর্থকদের কাজ, তাঁর জয় ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করা।’’
এর সঙ্গেই সম্পৃক্ত আর একটি কারণ হল— ইউসুফ যদি জেতেন, তা হলে তৃণমূল জিতবে। কিন্তু ইউসুফ হারলে তৃণমূল হারবে না! এ ক্ষেত্রে অনেকেই মনে করাচ্ছেন ২০০১ সালের বিধানসভা ভোটের কথা। যে বার যাদবপুর কেন্দ্রে মমতা অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়কে প্রার্থী করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে। সেই ভোটে মাধবী হেরেছিলেন ২৯ হাজার ২৮১ ভোটে। তখন তৃণমূলের অনেককেই গোপনে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘তৃণমূল তো হারেনি, মাধবী হেরেছেন!’’
বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে বহরমপুর, বেলডাঙা, নওদা, রেজিনগর, কান্দি, ভরতপুর ও বড়ঞা বিধানসভার আসন পড়ে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুর, কান্দি ও বড়ঞা বিধানসভা আসনে লিড পেয়েছিলেন অধীর। তৃণমূল প্রার্থী অপূর্ব লিড পেয়েছিলেন বাকি নওদা, বেলডাঙা, ভরতপুর ও রেজিনগরে। তা সত্ত্বেও অধীর জিতেছিলেন। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ হল, প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভোটের ব্যবধান এক লাফে কমে ৮০ হাজার ৬৯৬ ভোটে ঠেকেছিল। সেই জয়ের পরেও তেমন খুশি দেখায়নি অধীরকে। মন ছিল না বিজয় উল্লাসে। চোখে-মুখে চেনা উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। ভোটারদের একটি অংশ ‘ভুল’ বুঝেছে বলে দুঃখপ্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এর পর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বহরমপুর লোকসভার সাতটি বিধানসভার মধ্যে বহরমপুর কেন্দ্রে বিজেপি এবং বাকি ছ’টি কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীরা জয়ী হন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও এই লোকসভার আওতায় থাকা ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের অধিকাংশ তৃণমূলের দখলে গিয়েছে। তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে পারলেই বহরমপুর দখল করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যেই ইউসুফকে প্রার্থী করা হয়েছে।
কিন্তু এই কৌশলে খানিক শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে শাসকদলের অন্দরে। অনেকের মত, সংখ্যালঘু ভোট কাটাকাটি হলে বিজেপির সুবিধা হয়ে যেতে পারে। এই অঙ্কে জয়ের আশা দেখতে শুরু করেছেন বিজেপি প্রার্থী নির্মল। তাঁর এক অনুগামী বলেন, ‘‘৩০ শতাংশেরও বেশি ভোটার রয়েছে আমাদের। মোদীজির আশ্বাস ও আমাদের চিকিৎসকপ্রার্থীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে একটু ভাল ফল করতে পারলেই বহরমপুরে পদ্ম ফোটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।’’
তৃণমূলের একটি অংশের মত, ২০১৯ সালে অধীরের জয়ের নেপথ্যে অন্যতম কারণ ছিল তাঁর ‘ব্যক্তিগত ক্যারিশমা’। বহরমপুরে অধীরের ভাবমূর্তিকে টক্কর দেওয়ার মতো দলীয় নেতা জেলায় নেই! সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ইউসুফ জাতীয় মুখ। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি এবং ২০১১ সালে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন। তিনি সম্পর্কে প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার ইরফান পাঠানের দাদা। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়েও ২০১৮ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ইউসুফ। আইপিএলের প্রথম তিনটি মরসুমে খেলেছিলেন রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে। সেটা ২০০৮, ২০০৮ ও ২০১০ সাল। ২০১১ সালে তাঁকে কিনে নেয় শাহরুখ খানের দল। এর পর কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে ২০১২ এবং ২০১৪ সালে আইপিএলও জিতেছেন। ২০১২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে শেষ বার ভারতের হয়ে একদিনের ম্যাচে দেখা গিয়েছিল ইউসুফকে। শাসকদলের এক জেলা নেতার কথায়, ‘‘আমাদের দেশে ক্রিকেটারদের জনপ্রিয়তার কোনও তুলনাই হয় না। ইউসুফ পাঠান দীর্ঘদিন কলকাতার হয়ে খেলেছেন। উনি ব্যাট হাতে যখন নামতেন, আমরা ছক্কা দেখার জন্য বসে থাকতাম। তা ছাড়া উনি সংখ্যালঘু মুখ। যা বহরমপুরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’
কিন্তু এ ক্ষেত্রে ‘বহিরাগত’ অস্ত্রে শান দিতে পারেন বিরোধীরা। কংগ্রেসের নেতাদের বক্তব্য, বহরমপুরের মতো কেন্দ্রে বাইরের রাজ্যের এ রকম ‘অরাজনৈতিক’ ও ‘বহিরাগত’ মুখের কোনও প্রভাবই থাকবে না। তৃণমূল অবশ্য এ সবে গুরুত্ব দিতে নারাজ। শাসকদলের একাংশের দাবি, বিরোধীরা যদি ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা করে, তা হলে তারাই বিপদে পড়বে! এক নেতার কথায়, ‘‘ইউসুফ এক জন দেশের হয়ে খেলা ক্রিকেটার। তাঁর বাংলা-যোগও রয়েছে। কলকাতার হয়ে দীর্ঘ দিন আইপিএল খেলেছেন। তাঁকে বহিরাগত বলে দেওয়া অতটা সহজ হবে না। বিজেপি যদি বহিরাগত নিয়ে কিছু বলতে চায়, তা হলে তাদের জানিয়ে রাখি, ইউসুফ পাঠান মোদীরাজ্যের বাসিন্দা। যদি ইউসুফ বহিরাগত হন, তা হলে মোদীজিও বহিরাগত হয়ে যাবেন!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy