(বাঁ দিকে) অধীর চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীকে ‘বার্তা’ কেন? সোমবার লোকসভায় কংগ্রেসের আরও সাংসদ ছিলেন। ছিলেন স্বয়ং সনিয়া গান্ধীও। কংগ্রেস ছাড়াও অন্যান্য দলের সাংসদও ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বেছে নিয়েছেন ‘অধীরবাবু’কে।
কেন্দ্রীয় বাজেটের উপর আলোচনা করতে গিয়ে সোমবার সংসদে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেই বক্তৃতায় কংগ্রেসকে আক্রমণ করেছেন তিনি। ‘পরিবারতন্ত্র’-সহ নানা বিষয়ে শতাব্দীপ্রাচীন দলকে কাঠগড়ায় তুলেছেন মোদী। কিন্তু লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরীর উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছেন বিদ্রুপ, টিপ্পনি এবং কিঞ্চিৎ খোঁচা। বহরমপুরের অধীরের বিরুদ্ধে বারাণসীর মোদীর খোঁচা কি নিছক কাকতালীয়, নাকি পরিকল্পিত এবং সুচিন্তিত বার্তা?
ঘটনাক্রম বলছে, কংগ্রেসের মধ্যে যে সমস্ত নেতার সঙ্গে হাইকমান্ড বা অন্য নেতাদের সংঘাত রয়েছে, মোদী বারবার তাঁদের উদ্দেশে নানা মন্তব্য করে ঘোলাজল আরও ঘোলা করে দিতে চেয়েছেন। কখনও নাম করে, কখনও নাম না করে। এক দিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে তাঁদের ‘লজ্জা’ দিতে চেয়েছেন ধুরন্ধর রাজনীতিক মোদী। আবার সমান্তরাল ভাবে সেই নেতাদের সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলে কংগ্রেসের মধ্যেও অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করতে চেয়েছেন। অধীরের উদ্দেশে মোদীর সোমবারের বাক্যবাণ সেই ধারাবাহিকতারই অংশ বলে মনে করছেন অনেকে। রাজনীতি-অভিজ্ঞেরা বলছেন, যাঁদের সঙ্গেই কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের মান-অভিমান বা মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাঁদের সকলকেই মোদী এমন ‘বার্তা’ পাঠিয়েছেন। যে বার্তার নিহিতার্থ— বেরিয়ে এলে জায়গা তৈরি আছে।
অধীরের উদ্দেশে সোমবার মোদী বলেছেন, ‘‘অধীরবাবুকে দেখে কষ্ট হয়! তাঁকে পরিবারতন্ত্রের পুজো করতে হয়। আপনার কী যে হল দাদা!’’ মোদী আরও বলেছেন, ‘‘শক্তিশালী বিপক্ষ খুব জরুরি। কিন্তু এখানে (কংগ্রেসে) পরিবারবাদ প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখুন অধীর চৌধুরীর অবস্থা!’’ ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের পরে অধীরকে ‘লড়াকু’ আখ্যা দিয়েছিলেন মোদী। আর একটি লোকসভা নির্বাচনের আগে সেই অধীরকে তিনি এমন ভাবে বিঁধলেন, যার অর্থ দাঁড়ায়, অধীরের মতো ‘লড়াকু’কেও ‘কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্র’-এর সামনে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। ঘটনাচক্রে, এমন সময়ে কংগ্রেস হাইকমান্ডকে জড়িয়ে অধীরের উদ্দেশে মোদী কটাক্ষ ছুড়ে দিয়েছেন, যখন বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে জোট নিয়ে দিল্লির সঙ্গে বহরমপুরের সাংসদের ‘ঠান্ডা লড়াই’ চলছে। প্রতিদিন রাহুল গান্ধী, জয়রাম রমেশরা তৃণমূলের প্রতি ‘নরম’ মনোভাব দেখাচ্ছেন। আর অধীর ততটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তাঁর দলের বিরুদ্ধে কড়া কড়া শব্দ বলছেন। ঘোষিত ‘তৃণমূল বিরোধী’ অধীরকেও গত কয়েক মাস আগে তৃণমূলের সঙ্গে জোট নিয়ে পুকুর ও সমুদ্রের তত্ত্ব বলতে হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। ঠিক সেই সময়েই মোদী কটাক্ষে অধীরকে বিঁধলেন, যা কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।
অতীতেও মোদী একই ‘কৌশল’ নিয়েছিলেন। কংগ্রেস নেতা তথা তিরুঅনন্তপুরমের সাংসদ শশী তারুরকে ২০২০ সালের ৯ মার্চ তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাও আবার শুদ্ধ মালয়ালি ভাষায়। সাহিত্য, ভাষা ইত্যাদির বিষয়ে শশী বেশ ‘নাকউঁচু’ বলেই পরিচিত। মোদীর শুভেচ্ছাবার্তা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে শশী লিখেছিলেন, ‘‘শুদ্ধ সাহিত্য-ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবার্তা আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছে।’’ সে ক্ষেত্রেও সময়টা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই অন্য অনেক নেতার মতো সনিয়া গান্ধীর ‘নেতৃত্ব’ নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরে প্রশ্ন তুলেছিলেন শশী। শুধু তা-ই নয়। শশীই কংগ্রেসের প্রথম নেতা, যিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘‘দলে পূর্ণসময়ের সভাপতি চাই। যিনি সক্রিয় হবেন। সর্বোচ্চ পদে বসে যদি কেউ নিষ্ক্রিয় থাকেন, তা হলে তা সর্বত্র সংক্রমিত হয় সর্বত্র।’’ তখন অন্তর্বর্তী কংগ্রেস সভানেত্রী ছিলেন সনিয়া। সন্দেহ নেই, কংগ্রেসি রাজনীতচির নিরিখে শশীর সেই বক্তব্য কিছুটা ‘দুঃসাহসিক’ই ছিল। তবে শশীও তেমনই ধুরন্ধর। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনের ঠিক আগে মোদীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর হাতে নিজের লেখা বই তুলে দিয়েছিলেন শশী। যে বইয়ের নাম ‘অ্যান এরা অফ ডার্কনেস’। তার সেই ছবি পোস্ট করে মোদীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন তিরুঅনন্তপুরমের কংগ্রেস সাংসদ। ২০২২ সালে শশী কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে মল্লিকার্জুন খড়্গের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু যে সময়ে হাইকমান্ড তথা গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধঘোষণা করেছিলেন শশী, মোদী ঠিক সেই সময়েই তাঁর ‘মন ছুঁয়ে যাওয়া’ শুভেচ্ছাবার্তাটি পাঠিয়েছিলেন। যদিও শশী এখনও কংগ্রেসেই আছেন। মোদীর ‘বার্তা’ পাওয়ার পরেও। তিনি সৌজন্যকে রাজনীতিতে পর্যবসিত হতে দেননি। এখনও পর্যন্ত।
আবার ২০২২ সালের নভেম্বরে যখন রাজস্থান কংগ্রেসে অশোক গহলৌত-সচিন পাইলটের দ্বন্দ্ব মরুঝড়ের আকার নিয়েছে, তখনই জয়পুরে গিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন মোদী। বলেছিলেন, ‘‘আমাদের দেশকে ৫০ বছর পিছিয়ে দিয়েছে একটি দলের পরিবারবাদ। তারা এখন নিজের দলের তরুণ নেতাদেরও রেয়াত করছে না। এটাই পরিবারতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।’’ মোদী সেদিন কংগ্রেস বা সচিনের নাম নেননি। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয়নি রাজস্থান কংগ্রেসের তৎকালীন পরিস্থিতিতে মোদীর ওই কথা বলার উদ্দেশ্য কে বা কী।
অধীর সেই ‘কৌশল’-এরই অঙ্গ বলে মনে করছেন কংগ্রেসের অনেকে। তাঁদের মতে, মোদীর অধীরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, তাঁর মতো ‘লড়াকু’ নেতার গান্ধী পরিবারের অনুবর্তী হওয়ার প্রয়োজন নেই। মোদীর সেই কটাক্ষের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতে ‘হাত’ ছেড়ে আসার হাতছানি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy