Advertisement
E-Paper

ভোট মিটতেই হিংসা বঙ্গে! নদিয়ায় যুবক খুন, তাপসের এজেন্টকে মার, ব্যারাকপুর ও সন্দেশখালিও বাদ নেই

নির্বাচন কমিশন অবশ্য ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’র বিষয়টি নজরে রেখে পদক্ষেপ করছে। রবিবার তারা জানিয়েছে, আগামী ১৯ জুন পর্যন্ত বাংলায় ৪০০কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকবে।

—ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২৪ ২৩:২৫
Share
Save

বাসস্ট্যান্ড ধরে গ্রামের দিকে এগোলেই পর পর দোকানের শাটার নামানো। বেলা ১২টাতেও তালা খোলেনি। যেন অঘোষিত বন্‌ধ চলছে! গ্রামে ঢুকে রাস্তায় দু’এক জন প্রৌঢ় ছাড়া কোনও পুরুষের দেখা মেলেনি। শনিবার সন্ধ্যায় যুবককে গুলি করে কুপিয়ে খুনের ঘটনার পর থেকেই থমথমে গোটা গ্রাম। দুপুরের রোদে পথচলতি অচেনা মানুষ দেখে বেড়ার ফাঁক দিয়ে কৌতূহলী চোখে দু’-এক জন মহিলা উঁকিঝুঁকি দিলেন বটে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কথা বলতে এগিয়ে এলেন না কেউই। বরং পাছে কথা বলতে হয়, সেই ভেবে ঘুরে তাকানো মাত্র সরে গেলেন। ফাঁকা রাস্তায় ঘুরছে শুধু পুলিশের গাড়ি। কোথাও কোথাও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের জটলা! রবিবার সকাল থেকে নদিয়ার কালীগঞ্জের ছোট্ট গঞ্জ পচা চাঁদপুরে ঠিক এই ছবিই দেখা গেল।

শনিবার সন্ধ্যায় বা়ড়ির কাছেই খুন হন পচা চাঁদপুরের রেললাইন পাড়ার বাসিন্দা হাফিজুর শেখ (৩৫)। হাফিজুরের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও তাঁকে নিজেদের দলের কর্মী বলে দাবি করে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। এই ঘটনায় শাসকদলের বিরুদ্ধে ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’র অভিযোগ তুলে সব বিরোধী পক্ষই সরব হয়েছে। শুধু নদিয়াই নয়, উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরেও সন্ত্রাস ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। শনিবার রাতে পর পর বোমা বিস্ফোরণে তপ্ত হয়েছে ভাটপাড়া ও নৈহাটি। ভোটের পর সন্দেশখালির কিছু জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। অন্য দিকে, কলকাতা উত্তরের বিজেপি প্রার্থী তাপস রায়ের পোলিং এজেন্টকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শাসকদল অবশ্য সেই অভিযোগ অস্বীকারই করেছে।

ভোটের পর পশ্চিমবঙ্গে হিংসার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। গত বিধানসভা ভোটের পর বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের খুন, বাড়িছাড়া করার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। কোথাও কোথাও শাসকদলের নেতা-কর্মীরাও হিংসার শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ। তা নিয়ে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য-রাজনীতি। শনিবার লোকসভা নির্বাচনের শেষ অর্থাৎ সপ্তম দফার ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরেই চাঁদপুরে যুবক খুনের ঘটনায় আবার সেই অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে বিরোধীরা। স্থানীয় সূত্রে খবর, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ক্যারম খেলার সময় কয়েক জন দুষ্কৃতী এসে হাফিজুলকে গুলি করে। পরে তাঁকে কুপিয়ে খুন করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি, আততায়ীরা কেউ-কেউ পুলিশের মতো খাকি পোশাক পরে এসেছিল!

ভোট গণনার তিন দিন আগে এই খুনের ঘটনায় দাবি-পাল্টা দাবি ঘিরে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে। পরিবারের একাংশের দাবি, হাফিজুল সিপিএম সমর্থক। আবার অনেকের দাবি, পঞ্চায়েত ভোটের সময় সিপিএমের সঙ্গে থাকলেও লোকসভা ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন হাফিজুল। সেই কারণেই খুন করেছে তৃণমূল। পুলিশের অবশ্য দাবি, এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরেই এই হামলা হয়েছে। কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) উত্তমকুমার ঘোষ বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’’

ভোট মিটতে বোমাবাজি ঘিরে উত্তপ্ত হয় ব্যারাকপুরও। শনিবার মধ্যরাতে ভাটপাড়ায় বোমা পড়ে। ব্যারাকপুরের বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিংহের নির্বাচনী এজেন্ট প্রিয়াঙ্কু পাণ্ডের বাড়ির পাশের মাঠে কেউ বা কারা বোমা ফেলে চলে যান বলে অভিযোগ। সিসিটিভি ফুটেজেও সেই ছবি ধরা পড়েছে। ঘটনায় বিজেপির অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। অভিযোগ, ভোট শেষ হতেই এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করছে শাসকদল। প্রিয়াঙ্কু বলেন, ‘‘রাতে আমরা ভোট নিয়ে আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ ফোন আসে যে, আমার বাড়ির পাশে কেউ বাইকে করে এসে বোমা ফেলে চলে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে থানায় ফোন করে বিষয়টি জানাই। এসে দেখি মাঠে বোমা পড়ে আছে। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘বাংলার সংস্কৃতি এখন এটাই হয়ে গিয়েছে। বোমা, গুলি ছাড়া কিছু চলছে না। ভাবছে, এ সব করে আমাদের ভয় দেখাবে। আমি ভয় পাওয়ার লোক নই। তাই এ সব করে লাভ হবে না। আসলে বুথফেরত সমীক্ষা দেখে তৃণমূল ভয় পেয়ে গিয়েছে। তাই এ সব করছে। এলাকায় যত্রতত্র বোমা, গুলি ছড়িয়ে আছে। প্রশাসন কিছু করছে না।’’ অর্জুনও বলেন, ‘‘আমি তৃণমূলকে কিছু বলব না, পুলিশকে বলব। ওরা ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? সিসিটিভি ফুটেজও রয়েছে। ব্যারাকপুরের এ ভাবে বদনাম করা হচ্ছে। এখনও গ্রেফতার করা হল না কাউকে। পুলিশের কাছে আমার অনুরোধ, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করুক।’’

একই ভাবে শনিবার রাতে উত্তেজনা ছড়ায় নৈহাটিতেও। সেখানে সাত নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ের সামনে বোমা পড়ে। সিসি ক্যামেরার সেই ফুটেজ প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, রাতের নিস্তব্ধ রাস্তায় বোমা ফাটছে। ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে গোটা রাস্তা। এই ঘটনায় বিজেপির দিকে আঙুল তুলেছে তৃণমূল। ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রঞ্জন কর্মকার বলেন, ‘‘ভোট শেষ হতে না হতেই ওরা ২০১৯ মনে করাতে চাইছে। সবাইকে ভয় দেখিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। আমরা ঘরে ঢোকার লোক নই। আমরা ময়দানে নেমে পার্থ ভৌমিকের সঙ্গে গুন্ডাদমন করব। পুলিশ এসেছে। ফুটেজ দেওয়া হয়েছে তাদের। বিষয়টি প্রশাসন খতিয়ে দেখছে।’’ তৃণমূল নেতা সোমনাথ শ্যাম বলেন, ‘‘নৈহাটিতে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ের সামনে ওরা বোমা ফেলেছে। তার পর গোটা বিষয়টিতে ভারসাম্য আনতে ভাটপাড়ায় ছোট্ট করে বিজেপি কর্মীর বাড়ির সামনেও বোমা ফেলা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দোষী গ্রেফতার হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয়। ব্যারাকপুর মানেই যে হেতু বোমা, গুলি, তাই পরিবেশটাকে নষ্ট করার জন্য এটা করা হচ্ছে। এখানে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। এটা ২০১৯ নয়।’’

নির্বাচন কমিশন অবশ্য ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’র বিষয়টি নজরে রেখে পদক্ষেপ করছে। কমিশন আগেই জানিয়েছিল, ৪ জুন, মঙ্গলবার ভোটের ফল ঘোষণার পর ৬ জুন পর্যন্ত রাজ্যে ৪০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকবে। রবিবার অবস্থান বদলে সেই সময়সীমা বৃদ্ধ করেছে কমিশন। তারা জানিয়েছে, আগামী ১৯ জুন পর্যন্ত বাংলায় ৪০০কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকবে।

তাপসের এজেন্টকে মার

কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী তাপস রায়ের পোলিং এজেন্টকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বিজেপির অভিযোগ, ভোট মিটে যাওয়ার পর শনিবার গভীর রাতে রমেশ সাউ নামে দলীয় এক কর্মীকে মারধর করে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। রমেশ বেলেঘাটায় ২৮৩ নম্বর বুথে তাপসের পোলিং এজেন্ট ছিলেন। কলকাতা পুরসভার ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ওই বিজেপি কর্মীর অভিযোগ, ভোট শেষে তাঁকে ধাপা এলাকায় তুলে নিয়ে যান তৃণমূলের লোকজন। সেখানে তাঁর উপর অত্যাচার চলে বুথে বসার ‘শাস্তি’ হিসাবে। বিজেপির অভিযোগ, তাদের কর্মীকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টাও করা হয়েছিল। হামলার নেপথ্যে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা রয়েছে বলে বিজেপির দাবি। আহত কর্মীকে রাতেই নিয়ে যাওয়া হয় ট্যাংরা থানায়। সেখানে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, যিনি এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত, তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি। এখনও এই ঘটনায় মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়নি বলেই বিজেপির দাবি। কলকাতা উত্তরের বিজেপি সভাপতি তমোঘ্ন ঘোষ বলেন, ‘‘স্থানীয় তৃণমূল নেতা শেখ দৌলতের নেতৃত্বে তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী আমাদের কর্মীদের রক্তাক্ত করেছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। পুলিশ ব্যবস্থা না নিলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে যাব।’’ ঘটনার কথা জানতে পেরে আহত ওই কর্মীর খোঁজখবর নেন বিজেপি প্রার্থী তাপসও। তবে তৃণমূলের তরফে ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জীবন সাহা বলেন, ‘‘ভোটগ্রহণের সময় কিছু হল না, শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের লোকেরা ওদের পোলিং এজেন্টকে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধোর করল! এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন। এই ঘটনার সঙ্গে আমাদের কোনও যোগ নেই। পুলিশ তদন্ত করে প্রকৃত দোষীকে শাস্তি দিক। আমরা এই দাবি করেছি।’’ অন্য দিকে, শনিবার গভীর রাতে ফুলবাগান এলাকায় তাঁদের বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে থানার সামনে অবস্থান বিক্ষোভ দেখিয়েছেন তমোঘ্ন-সহ বিজেপি কর্মীরা।

সন্দেশখালির পরিস্থিতি

শনিবার সপ্তম দফায় বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সন্দেশখালিতে বিক্ষিপ্ত অশান্তি ঘটনা ঘটেছিল। ভোটের পরের দিনই এই দ্বীপ এলাকার কিছু জায়গায় জারি হল ১৪৪ ধারা। রবিবার থেকে ভোটের ফল বেরোনোর দিন অর্থাৎ, আগামী ৪ জুন পর্যন্ত ন্যাজাট থানা এলাকার সরবেড়িয়া থেকে বয়ারমারি পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করল পুলিশ প্রশাসন। রবিবার এই ঘোষণা করেছেন বসিরহাট পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার হোসেন মেহেন্দি রহমান। ভোটের দিন দফায় দফায় অগ্নিগর্ভ হয়েছিল বেড়মজুর, বয়ারমারি, আগারহাটি, কানমারি এলাকা। বয়ারমারিতে বিজেপির ক্যাম্প অফিসে হামলার অভিযোগ উঠেছিল। তাতে চঞ্চল খাটুয়া নামে এক বিজেপি কর্মীর মাথা ফাটে। ঠেলাঠেলি, মারধর, পুলিশের লাঠিচার্জ হয়। সন্দেশখালির ঘটনায় ‘অ্যাকশন টেকেন’ রিপোর্টও চেয়েছিল নির্বাচন কমিশন। ন্যাজাট থানার অন্তর্গত বয়ারমারিতে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছোড়া, পুলিশকে হেনস্থা করা, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া-সহ একাধিক অভিযোগে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

Post Poll Violence

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}