Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

দুনিয়া জুড়ে যে মেয়েরা অ-সম্ভবের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন

দু’দিন আগে নারী দিবস উদযাপিত হল। বছরের প্রত্যেকটা দিন দুনিয়া জুড়ে মেয়েদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে শরিক হওয়া আমাদের দায়িত্ব। লিখছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব।প্রতিদিন আমরা দুনিয়া জুড়ে মেয়েদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ হিংসার বিবরণ পড়তে এবং দেখতে বাধ্য হচ্ছি। ইরাকে, সিরিয়ায়, নাইজেরিয়ায়, আরও নানা জায়গায় অগণিত নারী মধ্যযুগীয় হিংস্রতার শিকার হচ্ছেন। এই ঘৃণ্য হিংসা প্রতিরোধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করার দায় আমাদের প্রত্যেকের।

সংগ্রামী। আরবানা খারা (বাঁ দিকে) ও মারি ক্লেয়ার চেকোলা।

সংগ্রামী। আরবানা খারা (বাঁ দিকে) ও মারি ক্লেয়ার চেকোলা।

জন কেরি
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

প্রতিদিন আমরা দুনিয়া জুড়ে মেয়েদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ হিংসার বিবরণ পড়তে এবং দেখতে বাধ্য হচ্ছি। ইরাকে, সিরিয়ায়, নাইজেরিয়ায়, আরও নানা জায়গায় অগণিত নারী মধ্যযুগীয় হিংস্রতার শিকার হচ্ছেন। এই ঘৃণ্য হিংসা প্রতিরোধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করার দায় আমাদের প্রত্যেকের।

কিন্তু এটা মেয়েদের অবস্থার একটা ছবি মাত্র। আমি একটা অন্য ছবি আঁকার, একটা অন্য শিরোনাম নির্মাণের চেষ্টা করব। বহু মেয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন সমস্যাগুলির সঙ্গে লড়াই করছেন। নিজেরা খুব বড় ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা দারিদ্র, বৈষম্য এবং হিংসার মোকাবিলা করছেন, যাতে তাঁদের পরিবার, সমাজ এবং দেশ আর একটু ভাল ভাবে বাঁচতে পারে। তাঁদের কথা হয়তো সংবাদের শিরোনামে আসে না, কিন্তু তাঁদের কাজ অতি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব হিসেবে আমি যে দেশে যখন যাই, মেয়েদের শক্তি দেখতে পাই— সে আফগানিস্তানই হোক, যেখানে তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মের সামর্থ্য তৈরি করছেন, বা লাইবেরিয়া, যেখানে প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ গণতন্ত্রের ভিত নির্মাণ করছেন।

গত শুক্রবার মার্কিন বিদেশ দফতর এমন দশ জন নারীকে ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ সম্মানে ভূষিত করেছে। দুনিয়া জুড়ে যে মেয়েরা শান্তি, নিরাপত্তা এবং লিঙ্গসাম্যের প্রসারে ব্রতী, এই দশ জন সংখ্যার বিচারে তাঁদের একটি ছোট্ট অংশ, কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত সাহসের কাহিনিগুলি বলে দেয়, সামর্থ্য অর্জন করতে পারলে মেয়েরা সমাজে কতটা ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারেন।

কসোভোতে আরবানা খারা নামে এক সাংবাদিক সে দেশে ধর্মাশ্রিত উগ্রপন্থার কারবারিদের নিয়ে পর পর কয়েকটি অন্তর্তদন্তভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরি করেন। তাঁর অক্লান্ত উদ্যোগের ফলে বিদেশি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে কসোভোর জঙ্গিদের যোগাযোগ উদ্ঘাটিত হয়েছে এবং এই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের সাহায্য করেছে। তাঁর দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে কসোভোর মতো একটি নবীন গণতান্ত্রিক দেশে নতুন প্রজন্মের বেশ কিছু সাংবাদিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন।

সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধ এবং মানুষের বিপুল সংকট সমস্ত অঞ্চলটির স্থিতি বিপর্যস্ত করে চলেছে। মাজ্দ চওরবাজি বন্দিদের পক্ষে সওয়াল করে চলেছেন, তাঁদের মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। বাশার আল আসাদ-এর সরকার তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছিল, কিন্তু মাজ্দ খেলাটা উল্টে দেন, কারাবন্দি মেয়েদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর চেষ্টার পরিণামে তিরাশি জন নারী কারাগার থেকে মুক্তি পান। এখন তিনি লেবাননে, ‘উইমেন নাউ ফর ডেভেলপমেন্ট’ সংগঠনের কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে সিরিয়ার উদ্বাস্তু মেয়েদের জন্য কাজ করছেন, স্থানীয় এবং জাতীয় স্তরে শান্তি ফিরিয়ে আনার কাজে তাঁরা যাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সে জন্য তাঁদের সাহায্য করছেন এবং এই ভাবেই ওই মেয়েদের আর্থিক ও সামাজিক স্থিতি খুঁজে নিতে সাহায্য করছেন। এটা খুব বড় কাজ।

অন্য দিকে আফ্রিকার গিনিতে মারি ক্লেয়ার চেকোলা-র মতো মেয়েরা একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে ইবোলা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। গিনির রাজধানী কনাক্রি’তে ডংকা হসপিটালে আপৎকালীন বিভাগে নার্সের কাজ করেন মারি ক্লেয়ার। দস্তানার মতো প্রাথমিক প্রতিরক্ষাটুকুও ছিল না, সেই অবস্থাতেই তিনি ইবোলায় আক্রান্তদের শুশ্রূষায় যোগ দেন। নিজে সংক্রমণের শিকার হন, সুস্থ হয়ে আবার কাজে নামেন। গিনির ইবোলা সারভাইভারস অ্যাসোসিয়েশন-এর নেত্রী হিসেবে তিনি কাজ করে চলেছেন: এক দিকে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা প্রসারের কাজ, অন্য দিকে যে রোগীরা সেরে উঠেছেন তাঁদের অচ্ছুত করে রাখার সামাজিক কুসংস্কার দূর করা।

দশ জনের মধ্যে এখানে তিন জনের কথা বললাম। এই তিন নারী তাঁদের নিজের নিজের জায়গায় আলাদা আলাদা কাজ করছেন, আলাদা আলাদা লড়াই তাঁদের। কিন্তু তাঁরা, এবং— আফগানিস্তানে, বাংলাদেশে, বলিভিয়ায়, বার্মায়, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক-এ, জাপানে ও পাকিস্তানে— এ বারের সম্মান প্রাপক অন্য সংগ্রামী মেয়েরাও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার একটা পথ খুঁজে পেয়েছেন, পরিবর্তনের পথিকৃৎ হয়ে উঠেছেন।

আন্তর্জাতিক পরিসরে আমরা যে সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সেগুলি মোকাবিলার জন্য মেয়েদের সামর্থ্য ও সম্ভাবনা কাজে লাগানো জরুরি। তার প্রমাণ আমাদের চোখের সামনে ছড়ানো আছে। বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা যখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ পান, তখন তাঁদের পরিবার, সমাজ এবং দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়ে, তারা সমৃদ্ধ হয়। আবার উল্টোটাও সত্য। মেয়েরা বঞ্চিত হলে, সমাজ ও অর্থনীতি থেকে তাদের বাইরে রাখা হলে সমাজের বিপুল ক্ষতি হয়।

মেয়েদের যারা সমাজের প্রান্তে নির্বাসিত করতে চায়, তাঁদের জীবনকে খর্বিত করতে চায়, তাদের সামনে আমরা মাথা নত করব না। ধর্ষণকে সংঘর্ষের পরিণাম বলে আমরা মেনে নেব না। অল্প বয়সে মেয়েদের জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, এই অন্যায়কে সামাজিক রীতি বলে স্বীকার করব না। যে মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রাখা হয়েছে বা হচ্ছে, তাঁদের কথাও আমরা ভুলে যেতে প্রস্তুত নই। বস্তুত, পৈশাচিকতা এবং আতঙ্কের মুখে দাঁড়িয়ে যে মেয়েরা প্রবল সাহসের পরিচয় দিচ্ছেন বা দিয়েছেন, আমরা তাঁদের সম্মান জানাই।

দু’দিন আগে নারী দিবস উদযাপিত হল। কিন্তু বছরের প্রত্যেকটা দিন দুনিয়া জুড়ে মেয়েদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব। তাঁরা যাতে পরিপূর্ণ, স্বাস্থ্যবান ও সার্থক জীবন যাপন করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরই।

অন্য বিষয়গুলি:

john kerry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE