Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

কিন্তু যোগ্যরা সবাই নোবেল পেলেন কি

রসায়নে এ বার যাঁরা নোবেল পেয়েছেন, তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু বাকি রয়ে গেলেন এমন কেউ কেউ, যাঁদের কৃতি কোনও অংশে কম বলা শক্ত।রসায়নে এ বার যাঁরা নোবেল পেয়েছেন, তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু বাকি রয়ে গেলেন এমন কেউ কেউ, যাঁদের কৃতি কোনও অংশে কম বলা শক্ত।

যাঁরা পেলেন। (বাঁ দিক থেকে) স্টেফান হেল, উইলিয়াম মোয়েরনার, এরিক বেৎজিগ

যাঁরা পেলেন। (বাঁ দিক থেকে) স্টেফান হেল, উইলিয়াম মোয়েরনার, এরিক বেৎজিগ

অরিজিৎ কুমার দে
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

অত্যাধুনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র উদ্ভাবন করে সাধারণ মাইক্রোস্কোপে দেখা যায় না, এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু সহজে দেখার পথ বাতলে এ বার রসায়নে নোবেল পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড হিউজ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটের এরিক বেৎজিগ, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যান্ক ইনস্টিটিউটের স্টেফান হেল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উইলিয়াম মোয়েরনার।

পুরস্কৃত অণুবীক্ষণ পদ্ধতিটির পোশাকি নাম সুপার রেজলিউশন মাইক্রোস্কোপি। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের গুণগত মানের একটি মাপকাঠি হল ‘রেজলিউশন’। ধরা যাক, নির্দিষ্ট দূরত্বে দু’টি আলোকিত বিন্দু আছে, যাদের পৃথক ভাবে শনাক্ত করা যায়। বিন্দু দু’টিকে কাছাকাছি আনতে থাকলে এক সময় এমন এক দূরত্ব আসবে, যার কম দূরত্ব হলে আমরা তাদের, আলাদা ভাবে নয়, একটি বিন্দু হিসেবে শনাক্ত করব। রেজলিউশন হল এই ন্যূনতম দূরত্বের মাপকাঠি। খালি চোখে আমরা বড় জোর একটি চুলের ব্যাসের সমান দূরত্ব অর্থাৎ প্রায় ১০০ মাইক্রোমিটার (১ মাইক্রোমিটার=১ মিলিমিটারের ১০০০ ভাগের ১ ভাগ) দূরত্বের দু’টি বিন্দুকে স্পষ্ট দেখতে পাই, তার কম হলে প্রয়োজন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের।

অতিক্ষুদ্র বস্তু দেখার চেষ্টা শুরু হয় একাদশ শতাব্দী নাগাদ চশমা জাতীয় বস্তু আবিষ্কার দিয়ে। সতেরো শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট হুক এবং ডাচ বিজ্ঞানী অ্যান্টন লিভেনহিক পরীক্ষা করলেন নানা ধরনের জীবিত ও মৃত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু, যাদের আকার মোটামুটি ১০০ থেকে ১ মাইক্রোমিটারের মধ্যে। কিন্তু প্রশ্ন হল, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা আছে কি? ১৮৭৩ সালে জার্মান বিজ্ঞানী আর্নস্ট অ্যাবে তাত্ত্বিক ভাবে প্রমাণ করলেন, আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অর্ধেকের কম আকারের কিছুই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা সম্ভব নয়। সাধারণ দৃশ্যমান আলোর মধ্যে ক্ষুদ্রতম তরঙ্গদৈর্ঘ্য মোটামুটি ৪০০ ন্যানোমিটার (১ ন্যানোমিটার = ১ মিলিমিটারের ১,০০০,০০০ ভাগের ১ ভাগ)। ৪০০ ন্যানোমিটারের নীল আলো ব্যবহার করে ২০০ ন্যানোমিটার আকারের নমুনা দেখা যায়। অর্থাৎ জীবিত কোষের নিউক্লিয়াস, মাইটোকনড্রিয়া ইত্যাদি অঙ্গাণু দেখা সম্ভব, কিন্তু অঙ্গাণুর ভিতর ডিএনএ বা প্রোটিন অণু দেখা অসম্ভব। অবশ্য দৃশ্যমান আলোর চেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বা অন্য কোনও তরঙ্গ, যেমন এক্স-রে বা ইলেকট্রন, বা বিশেষ উপায়ে অপ্টিক্যাল ফাইবার ব্যবহার করে অণুর গতিবিধি দেখা সম্ভব, কিন্তু জীবন্ত নমুনা দেখতে হলে এক্স-রে বা ইলেকট্রন ব্যবহার করা যাবে না। তা হলে উপায়?

১৯৯৪ সালে প্রথম সমাধানসূত্র বের করলেন স্টেফান হেল। একটি চক্রাকার আলোকরশ্মির সঙ্গে একটি ‘ডোনাট’ আকৃতির (চক্রাকার, যার মাঝখানে গর্ত) আলোকরশ্মি মিশিয়ে কোনও বস্তুকে আলোকিত করলে শুধু ডোনাট আকৃতির মাঝের অংশটুকুই আলোকিত হবে; এ যেন দু’টি রশ্মির কাটাকুটিতে ভিতরের অংশটুকু পড়ে থাকা। ২০০০ সালে পরীক্ষানিরীক্ষা করে হেল দেখালেন বাস্তবে দৃশ্যমান আলো ব্যবহার করেও ২০০ ন্যানোমিটার ছোট জিনিস দেখা সম্ভব।

দ্বিতীয় উপায় বাতলালেন এরিক বেৎজিগ। ধরা যাক একটি আলোকিত অংশে অসংখ্য অণু এত কাছাকাছি আছে যে, সবাই একসঙ্গে আলো বিচ্ছুরণ করলে তাদের আলাদা করা অসম্ভব। অথচ কোনও বিশেষ উপায়ে যদি কোনও মুহূর্তে কয়েকটি মাত্র অণু আলো বিচ্ছুরণ করে, তবে তাদের আলাদা করা সম্ভব। যেন অন্ধকারে এক ঝাঁক জোনাকি। যখন একটি-দু’টি জ্বলে ওঠে, সেই মুহূর্তে বাকিরা নিবে থাকলে প্রতিটির স্বতন্ত্র অবস্থান নির্ণয় সম্ভব। অণুর আকার কয়েক ন্যানোমিটার, তাই এ পদ্ধতিতে দেখা যায় কয়েক ন্যানোমিটার আকারের বস্তুও। একই রকম ধারণা ব্যবহার করে উইলিয়াম মোয়েরনার এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিয়াওয়েই চুয়াং নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। সুতরাং, সুপার রেজলিউশন মাইক্রোস্কোপ বলতে সামগ্রিক ভাবে বিভিন্ন পদ্ধতিকে বোঝায়, যেগুলির প্রত্যেকটি দৃশ্যমান আলোকরশ্মি ব্যবহার করেও ২০০ ন্যানোমিটারের কম আকারের নমুনাকে স্পষ্টত দৃশ্যমান করতে পারে। স্টেফান হেলের উদ্ভাবিত স্টিমুলেটেড এমিশন ডিপ্লিশন (স্টেড), বেৎজিগের উদ্ভাবিত ফটোঅ্যাক্টিভাইজড লোকালাইজেশন মাইক্রোস্কোপি (পালম) ও চুয়াং-এর স্টোকাস্টিক অপ্টিকাল রিকনস্ট্রাকশন মাইক্রোস্কোপি (স্টর্ম) অন্য অনেক পদ্ধতির তুলনায় বিজ্ঞানী মহলে বেশি প্রচলিত। লক্ষণীয়, মোয়েরনার উদ্ভাবিত সিঙ্গল মলিকিউল অ্যাক্টিভ কনট্রোল মাইক্রোস্কোপি (স্ম্যাকম) তুলনায় কম আলোচিত, যদিও তিনটি পদ্ধতিই উদ্ভাবিত হয়েছে মোটামুটি একই সময়ে, ’০৫/০৬ নাগাদ।

একক ভাবে একটিমাত্র অণু পর্যবেক্ষণের পদ্ধতি উদ্ভাবনের কাহিনি সুপার রেজলিউশন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। ১৯৮৯ সালে মোয়েরনার ও মাইকেল অরিট দেখান কী ভাবে কেবলমাত্র একটি অণু’কে নিরীক্ষণ করা সম্ভব। তাঁদের দেখানো পথ ধরে গত ২৫ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন কোষের মধ্যে প্রোটিনের হাঁটাচলা থেকে শুরু করে ভাইরাসের শরীরে ডিএনএ-র কারিকুরির রহস্য, ব্যবহারিক জীবনে, বিশেষত চিকিৎসা বিজ্ঞানে যার গুরুত্ব বিপুল। মোয়েরনার-অরিট বহুদিন ধরেই নোবেল প্রাইজের যোগ্য দাবিদার। তবে কিনা বিজ্ঞান হল একই লক্ষ্যে বহু গবেষকের দৌড়। প্রায়শ আপন আপন কায়দায়। যেমন একেবারে শুরুর দিকে সুপার রেজলিউশন মাইক্রোস্কোপের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির রিচার্ড জ্যারে। সুতরাং, এ ব্যাপারে পুরোধা যে একা মোয়েরনার, এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।

গত ক’বছর ধরে নোবেল প্রাইজের সম্ভাব্য প্রাপকদের নামের তালিকা নিয়ে মোটামুটি নির্ভুল ভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছে একটি ওয়েবসাইট (blog.chembark.com)। তারা এ বছর শীর্ষে রেখেছিল মোয়েরনার, অরিট এবং জ্যারে’কে। মোয়েরনার-কে নোবেল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রশ্নও উঠে গেল যে, তা হলে কি সিঙ্গল মলিকিউল মাইক্রোস্কোপি-র আলাদা করে আর কোনও কৃতিত্বের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই? নোবেল কমিটির বক্তব্যেও বার বার সিঙ্গল মলিকিউল মাইক্রোস্কোপি-র উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে চুয়াং-এর নোবেল বঞ্চনা নিঃসন্দেহে যোগ করল নতুন বিতর্ক।

গত প্রায় আট বছর ধরে চুয়াং এবং তাঁর সহকারী বিজ্ঞানীরা স্টর্ম পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে কোষের মধ্যে অণুর সুস্পষ্ট ত্রিমাত্রিক ছবি তুলেছেন প্রায় ২০ ন্যানোমিটার রেজলিউশনের সাহায্যে, যা সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তুলনায় দশ গুণ শক্তিশালী। মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি-র প্রাক্তন সেক্রেটারি তথা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী চিনা-আমেরিকান বিজ্ঞানী স্টিভেন চু-র গবেষণাগারের প্রাক্তন কর্মী শিয়াওয়েই চুয়াং নোবেল না-পাওয়ায় তাই বিজ্ঞানীমহলে বিতর্ক উঠেছে। যার আঁচ পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশেষ করে চিনা ওয়েবসাইটগুলি এই নিয়ে সরব হয়েছে। বলা হচ্ছে, স্টর্ম নোবেল না পেলেও, বিতর্কের ঝড় (storm) তুলেছে। কেউ কেউ সরাসরি লিঙ্গ-বৈষম্য ও জাতি-বৈষম্যের অভিযোগ এনেছেন।

তবে সব বিতর্ক সরিয়ে রেখে এখন সময় এই তিন বিজ্ঞানীর অসাধ্য সাধনকে কুর্নিশ করা। নিজেদের উদ্ভাবিত শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে তাঁরা মানব কল্যাণে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যবহারিক প্রয়োগ করেছেন। হেল দেখিয়েছেন, কী ভাবে মস্তিষ্কের মধ্যে স্নায়ুর সংযোগস্থল বা সাইন্যাপস-এর কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা যায়। মোয়েরনার মারাত্মক ব্যাধি হান্টিংটন-এর জন্য দায়ী প্রোটিনকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর বেৎজিগ ভ্রূণের মধ্যে কোষ বিভাজন চাক্ষুষ করেছেন। নোবেল যোগ্য ব্যক্তির হাতেই উঠেছে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বার্কলি)-এর গবেষক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy