Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

প্রতিশোধ, প্রতিশোধ

আদিত্যনাথ তো বলিয়াই দিয়াছেন, নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করিয়াছিলেন যাঁহারা, তিনি তাঁহাদের বিরুদ্ধে বদলা লইবেন।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

দৃশ্যত, যোগী আদিত্যনাথের কথার দাম আছে। গত কয়েক দিনে উত্তরপ্রদেশে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা কি মুখ্যমন্ত্রী-ঘোষিত ‘বদলা’ই নহে? মুজফ্ফরনগর হইতে আলিগড়, সর্বত্রই পুলিশ ও প্রশাসন যে ভঙ্গিতে দমননীতি গ্রহণ করিয়াছে, তাহা শীর্ষ স্তরের রাজনৈতিক নির্দেশ ভিন্ন অসম্ভব। অবশ্য, আদিত্যনাথের রাজ্যে সেই আদেশ লইয়া জল্পনা-কল্পনার তেমন প্রয়োজন নাই— আদিত্যনাথ তো বলিয়াই দিয়াছেন, নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করিয়াছিলেন যাঁহারা, তিনি তাঁহাদের বিরুদ্ধে বদলা লইবেন। অতএব, মুজফ্ফরনগরে বাছিয়া বাছিয়া নাগরিকদের বাড়িতে পুলিশ লুটপাট চালাইয়াছে বলিয়া প্রবল অভিযোগ। অভিযোগ, রাজ্য জুড়িয়া পুলিশ ‘শত্রুপক্ষ’কে বিশেষ ভাবে নিশানা করিতেছে। নিশানা কেবল ধর্মপরিচয়-ভিত্তিক নহে, যাহারাই প্রতিবাদী তাহারাই শত্রু বলিয়া গণ্য। অতএব আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে মোমবাতি হাতে মিছিল করিবার অপরাধেও ১২০০ ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হইয়াছে— সেই উত্তরপ্রদেশে, যেখানে খুন বা ধর্ষণের অভিযোগ নথিভুক্ত করাইতেও নাগরিকের কালঘাম ছুটিয়া যায়।

বারাণসীতে ‘দাঙ্গা’য় অভিযুক্তদের ছবিসমেত পোস্টার লাগাইয়াছে পুলিশ, খবর দিলে ইনাম মিলিবে। কানপুর আইআইটিতে কর্তৃপক্ষ নোটিস দিয়াছে, কোনও ছাত্র ক্যাম্পাসে তো বটেই, এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়ার পরিসরেও কোনও রকম রাজনৈতিক দ্বিমত প্রকাশ করিতে পারিবে না— করিলেই শাস্তি। বিরুদ্ধতার আগুন যে ভাবে এক ক্যাম্পাস হইতে অন্য ক্যাম্পাসে ছড়াইয়া পড়িতেছে, আদিত্যনাথ স্পষ্টতই তাহার মূলোচ্ছেদ করিতে ব্যাকুল। তাঁহাদের নিকট গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রত্যাশা নাই। কিন্তু, আদিত্যনাথ তাঁহার দমননীতিকে যে বীভৎসতায় লইয়া গেলেন, তাহাতে আশঙ্কা হয়, তিনি হয়তো পরবর্তী ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ হইয়া উঠিতে বর্তমান অশান্ত সময়টিকেই সেরা সুযোগ ঠাহরাইয়াছেন। হয়তো ভাবিতেছেন, ২০০২-এর গুজরাতে যাহা সম্ভব হইয়াছিল, ২০১৯-এর উত্তরপ্রদেশেও তাহা সম্ভব।

বদলা লওয়া যে প্রশাসকের কাজ হইতে পারে না, এই কথাটি আদিত্যনাথদের বুঝাইয়া বলা হয়তো অসম্ভব। কারণ, নির্বাচনে জিতিয়া তাঁহারা শীর্ষাসনে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের পাঠ পান নাই। যে পাঠশালায় তাঁহাদের হাতেখড়ি, সেখানে বদলাই মূল উপজীব্য— প্রকৃত, অথবা কাল্পনিক, ঘটনার বদলা। বদলা লইতে ক্ষমতার প্রয়োজন। অতএব, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বদলা লইতে নামিয়াছে। ইহার প্রকৃত নাম গুন্ডারাজ— যেখানে গুন্ডারা রাজত্ব করে। মুজফ্ফরনগরে পুলিশ যাহা করিয়াছে, কোনও সভ্য দেশে তাহা কল্পনাতীত। বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষ আক্রান্ত হইলে পুলিশ সচরাচর নিরাপত্তা দেয় না, অভিযুক্তদের দেখিয়াও চোখ ফিরাইয়া রাখে, এই কথাগুলিতে ক্রমশ অভ্যস্ত হইয়া উঠা উত্তরপ্রদেশ দেখিল, পুলিশ আরও এক ধাপ অগ্রসর হইয়া একেবারে আক্রমণকারী এবং লুটেরা হইয়া উঠিল। ঘোষণা করিয়া দিল, ‘অবাঞ্ছিত’দের গন্তব্য দুইটি: হয় পাকিস্তান, নয় কবরিস্তান। পুলিশকে দলীয় গুন্ডায় পরিণত করিবার কাজটি কতখানি লজ্জার, তাহা বুঝিবার সামর্থ্যটুকুও এই নায়কদের আছে কি না, সংশয় হয়। এবং, ইহারাই গণতন্ত্রের শীর্ষে অধিষ্ঠিত— ইহা অপেক্ষা দুর্ভাগ্যের এবং দুশ্চিন্তার আর কী থাকিতে পারে? ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব বলিয়াছেন, পরাধীন ভারতেও পুলিশ এতখানি নিষ্ঠুর হইত না। সত্য হইল, ভারত নামক ধারণাটি ফের পরাধীন হইয়াছে— সেই উদার, প্রগতিশীল ধারণাটির সহিত যাঁহাদের বিরোধ একেবারে মজ্জাগত, এই মুহূর্তে তাঁহারাই দেশ শাসন করিতেছেন। সেই উদার ভারতের বিরুদ্ধে তাঁহারা ‘বদলা’ লইবেন, ইহাতে হয়তো আশ্চর্য হইবার কারণ নাই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy