পরিসংখ্যান বলবে, অতীতে ভারতীয় পরিবারের গড় আয়তন আজকের তুলনায় তেমন বেশি ছিল না। কিন্তু সাহিত্য বা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ থেকে অনেক বৃহদায়তন পরিবারের পরিচয় পাই। এই পরিবারগুলি সাধারণত অপেক্ষাকৃত বেশি সচ্ছল হত। দূর সম্পর্কের পিসির দেওরের মাসিশাশুড়িরও এ সব পরিবারে অনায়াসে স্থান জুটে যেত, যা হতদরিদ্র পরিবারে সম্ভব ছিল না। আর সেই ‘মাসি’র পরিচর্যায় ও ভালবাসায় পরিবারের বাচ্চাগুলো দিব্যি বড় হয়ে উঠত।
এই সব সুদূর-প্রসারিত (শুধু ‘এক্সটেন্ডেড’ বললে এর ব্যাপ্তিটি বোঝা যাবে না) যৌথ পরিবারগুলির সদস্যদের মধ্যে খটাখটি যে ছিল না, তা নয়, কিন্তু একে অন্যের কাছে কী প্রয়োজন সেটি তাঁরা সম্ভবত ঠিকঠাকই বুঝতেন। তার পর যখন অবস্থা পড়তে থাকে, এই হিসেবটা গোলমাল হতে থাকে। ভাঙতে থাকে পরিবার। মাসিরা পোঁটলা বেঁধে ছেলের হাত ধরে চোখের জল মুছতে মুছতে বিদায় নেন, পুরনো সিনেমায় যেমন দেখা যায়। মাসির বিদায়ের তাৎক্ষণিক কারণটি হয়তো কর্ত্রীর কোনও অপমানজনক উক্তি— ‘বসে বসে সব অন্ন ধ্বংস করছে’। কিন্তু গভীর কারণটি অর্থনৈতিক। কপালে ভাঁজ ফেলে আধো অন্ধকারে আরামকেদারায় আধশোয়া কর্তার ছবি দেখিয়েই পরিচালক সেটি বুঝিয়ে দেন। বোঝা যায় সব কিছু আর কর্তার নিয়ন্ত্রণে নেই।
তাই যখন প্রবল প্রতাপান্বিত গৃহকর্তারা ‘বহিরাগত’ খুঁজতে উঠে পড়ে লাগেন, সন্দেহ হয় তা হলে কি তাঁরা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনায় আর আস্থা রাখতে পারছেন না? এই সে দিন পর্যন্ত যে শুনতে পাচ্ছিলাম এই সরকার পাঁচ বছরে দেশের অর্থনীতিকে ঠেলে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বানিয়ে তুলবে?
ভারতের জাতীয় আয় এখন ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। পাঁচ ট্রিলিয়নে পৌঁছতে গেলে একে প্রতি বছরে অন্তত নয় শতাংশ হারে বাড়তে হবে। সাম্প্রতিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি দেখে অতি-আশাবাদীও এমন স্বপ্ন দেখবে না। বাজেটের দিনটি বাদ দিলে সরকারপক্ষের হাঁকডাকে ‘অর্থনীতি’ শব্দটি বেশ কিছু কাল তেমন কানে আসেনি। এই চার অক্ষরকে দূর করে দিয়েছে অন্য চার অক্ষর— ‘গোলি মারো’। কোথায় আমরা এক পরিবার বলে সবাইকে খাইয়ে পরিয়ে পারিবারিক ঐতিহ্য উচ্চাসনে রাখব, তা নয় নিজেদের মধ্যেই ‘গদ্দার’ খুঁজে বেড়াচ্ছি। এই কি আমাদের খানদান, ভাই? পড়তি অবস্থার বিপাকে পড়া সিনেমার কর্তার চিন্তাগ্রস্ত মুখে অন্তত গভীর বেদনার ছাপ দেখতাম। আমাদের গৃহকর্তার নীরবতায় অবশ্য স্বজন হারানোর বেদনা নেই। কারণ তিনি ও তাঁর সহযোগীরা তেমন বৃহৎ পারিবারিক ঐতিহ্যের শরিক নন, যে ঐতিহ্য সবাইকে এক-পরিবারভুক্ত মনে করে।
অন্যকে বিতাড়িত করতে পারলেই আমার অবস্থার উন্নতি হবে— এই মনোভাব যে চিন্তাকাঠামো থেকে আসে, তাকে বলে ‘জ়িরো-সাম গেম’। বাস্তবের যে কোনও খেলার কাঠামোটি এ রকমই। যেমন, তাসের জুয়া। দু’জনের মধ্যে এক জন যতটা জিতবে, অন্য জন ততটাই হারবে। অর্থাৎ হার-জিতের অঙ্ক যোগ করলে যোগফল হয় শূন্য। তাই জ়িরো-সাম। এই চিন্তাকাঠামো তাসের জুয়ায় উপযুক্ত হলেও সমাজ-অর্থনীতিতে একেবারেই নয়, কারণ সমাজে প্রগতি আছে, অর্থনীতিতে বৃদ্ধি আছে, যে বৃদ্ধিতে বা প্রগতিতে সকলেরই কম-বেশি অবদান আছে, যার সুফল সকলেরই কম-বেশি পাওয়ার কথা। এ কথাটা তখনকার যৌথ পরিবারগুলি জানলেও, অ্যাডাম স্মিথ থেকে শুরু করে তামাম অর্থশাস্ত্রীরা জানলেও, আমাদের দেশের বর্তমান কর্তারা জানেন না। বা জেনেও ক্ষুদ্র উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে জ়িরো-সামের জীবনদর্শনে চুবিয়ে রাখতে চাইছেন হিন্দুত্ববাদীদের।
তবে কি আত্মমর্যাদার ঘাটতিই সমস্যা? ঔদার্যের জন্যে প্রয়োজনীয় আত্মশক্তির অভাব? জ়িরো-সাম দর্শনের মর্মবস্তুটিই বোধ হয় এই আত্মমর্যাদার অভাব। দিল্লি থেকে মুম্বই রাজনীতির কারবারিরা যখন আমরা-ওরার বিষের কৌটো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, আস্তিনে থাকে এমনই জ়িরো-সামের আখ্যান। দিল্লি থেকে বাংলাদেশি তাড়ানোর নাম করে পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলমানদের উত্ত্যক্ত করা আর মুম্বইয়ে বিহারিদের— একই মুদ্রার এ দিক ও দিক।
এমআইটি-র অধ্যাপক লেসটার থারো ‘দ্য জ়িরো-সাম সোসাইটি’ নামে একটি চমৎকার বই লেখেন ১৯৮০ নাগাদ। থারো বলছেন, অধিকাংশ আমেরিকানই সমাজকে জ়িরো-সাম গেম হিসেবে দেখে। এই বিশ্বাসের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে থারো উপলব্ধি করলেন, অর্থনীতির যে কোনও নীতি প্রয়োগেরই ফলস্বরূপ দেখা যাবে, এক দলের লাভ হয়েছে আর এক দলের ক্ষতি। যদিও লাভের পরিমাণ যত, ক্ষতির ততটা নয়। তবু, ক্ষতিগ্রস্তরা মনে করছেন তাঁদের ক্ষতি করেই অন্যদের লাভ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অতএব নীতির বিরুদ্ধেই একটা জনমত তৈরি হয়ে উঠতে পারে এবং তার প্রয়োগ আটকে যেতে পারে। তাই থারোর পরামর্শ, অর্থনীতির প্রগতির স্বার্থে করব্যবস্থার এমন সংস্কার করতে হবে, যাতে ক্ষতিগ্রস্তদের যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়।
তবে মনগড়া ক্ষতিও আছে। অভিবাসনের ফলে স্থানীয়দের ক্ষতি হয়— এই বিশ্বাসটাই যেমন। এই ধারণাটির ব্যাপ্তি দেখলে অবাক হতে হয়। ইউরোপ বা আমেরিকার মানুষও এই ভ্রান্ত ধারণা লালন করেন। অভিবাসনের ফলে অভিবাসী ও স্থানীয় মানুষ— উভয়েরই আর্থিক অবস্থা আগের তুলনায় ভাল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এর একটা কারণ হল, অভিবাসীরা তাঁদের রোজগারের একটা অংশ সেখানেই খরচ করেন, ফলে জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়ে, সেগুলির উৎপাদন বাড়ে, ফলে কাজের সুযোগ বাড়ে। এ ছাড়া, যাঁদের কোনও বিশেষ দক্ষতা নেই, তেমন অভিবাসীরা সেই কাজগুলিতেই ভিড় করেন যেগুলোতে স্থানীয়েরা আগ্রহী নন, কারণ মজুরি কম। সে মজুরি যদিও অভিবাসীদের নিজের দেশের তুলনায় কিছুটা বেশি। ফলে অভিবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে সরাসরি প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা কম। অথচ বর্ডারে দেওয়াল তোলা থেকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ চিহ্নিত করে তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে চালান করা— এ রকম বিবিধ কর্মকাণ্ডকে পাখির চোখ করে ফেলেন জননেতারা।
তবে আশার কথা, ভারতে এখনও অন্তত এই জ়িরো-সাম দর্শন সর্বব্যাপী নয়। একটা উদাহরণ দিই। কেরলের তিরুঅনন্তপুরমের এক সকাল। রাস্তার ধারে অপেক্ষারত জনা কুড়ি বাঙালি পুরুষ। বয়স তাঁদের সতেরো-আঠারো থেকে পঞ্চাশের কোঠায়। একটি দ্বিচক্রযান এসে দাঁড়ায়, ছুটে যান কয়েক জন, কী যেন কথা হয়, সংক্ষিপ্ত। তার পরই উল্টো দিকের বাসস্টপে দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠে পড়েন ওই পাঁচ জন। এঁরা কাজ করতে গেলেন। পরিযায়ী শ্রমিক। প্রতি দিন সকালে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে এমন চলতে থাকে।
তাঁদেরই এক জন সুভাষচন্দ্র দে। বাড়ি কাঁথির কাছে, সেখানে মাছের কাজ দিয়ে শুরু। কিন্তু রোজগার হত সামান্য। সংসার চলত না। প্রায় আট বছর হল তিনি কেরলে আসছেন। বছরে বার দুয়েক বাড়ি যেতে পারেন। বেশ কিছু দিন কাটিয়ে আসেন। সেখানে ছেলেটা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছে, বাড়িটা পাকা করেছেন। ‘এখানে খরচ চালিয়ে এত কিছু পারছেন? কত পান দৈনিক’? ‘আটশো’। ‘কিন্তু রোজ তো সকলে কাজ পান না’। তা ঠিক। তবে বিশ-বাইশ দিন হয়ে যায়। অর্থাৎ মাসে ষোলো-সতেরো হাজার। দরকষাকষি নেই, গালিগালাজ নেই, গা-জোয়ারি নেই।
এই পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা ভাবার জন্যে রয়েছে কেরল সরকার। স্বাস্থ্যকার্ড রয়েছে সকলের। কার্ড দেখিয়ে সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকেই একটু একটু করে বাঙালিরা আসতে শুরু করেন কেরলে মূলত অদক্ষ কাজে। এখন এঁরা প্রায় পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি। বিহার, ওড়িশা, অসম, উত্তরপ্রদেশ থেকেও এসেছেন দলে দলে। এখন সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ লক্ষ ভিন রাজ্যের মানুষ কাজ করছেন কেরলে। ‘রোশনি’ নামে একটি অভিনব প্রকল্প এর্নাকুলাম জেলা কর্তৃপক্ষ অন্যদের সঙ্গে মিলে চালু করেছেন, যা অভিবাসী পরিবারের ছেলেমেয়েদের ভাষাশিক্ষার সমস্যার কথা ভেবে বিশেষ ভাবে তাদের জন্যে করা হয়েছে। আত্মমর্যাদায় ভরপুর কেরলের মানুষ ভাবতেই পারেন না সুভাষ-আমিনুলেরা তাঁদের রুজি ছিনিয়ে নিতে এসেছেন।
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy