Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

দিল্লিকে দেখেও কি আমাদের হুঁশ ফিরবে না

যে ভাবে খড় পোড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে, তাতে বায়ু দূষণের নিরিখে খুব শীঘ্রই আমরা দিল্লিকে ছুঁয়ে ফেলব। এত ধোঁয়াশা সত্ত্বেও এটা কিন্তু বেশ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।

সৌমেন জানা
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৫৫
Share: Save:

চারদিকে আবছায়া। দিন না রাত, ঠিক ঠাহর করা যায় না। ধোঁয়াশার চাদরে মোড়া সব কিছু।ঠিক যেন শীতের সকাল! হেডলাইটের তীব্র আলোও আধো অন্ধকারের দেওয়াল সরাতে ব্যর্থ। চারপাশে সব যেন বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি। দু’হাত দূরের জিনিসও নজরে আসে না। গাড়ি চালকেরা অতি সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়াও মুশকিল। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হাঁফ ধরছে! দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। স্বস্তির সামান্য নিঃশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। যেন ‘গ্যাস চেম্বার’। বিষাক্ত পরিবেশ। নাগাড়ে একদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। চোখ জ্বালা করছে। মাথার একটা পাশ দপদপ করছে। রাস্তায় চলাফেরা করা কার্যত প্রাণ হাতে নিয়ে ঘোরার শামিল। ভারতের রাজধানী দিল্লির অবস্থা এখন এমনটাই!

এই পরিস্থিতি সবাইকে হিটলারের ভয়াবহ ‘গ্যাস চেম্বার’-এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যাঁদেরকে এই গ্যাস চেম্বারে ভরা হত, তাঁরা ছটফট করে মারা যেতেন। আজ হিটলার বেঁচে থাকলে খুশিই হতেন। কারণ, এক দিন যে কাজের জন্য তিনি বদনাম কুড়িয়ে ছিলেন আজ মানুষ স্বেচ্ছায় একটা গোটা শহরকেই গ্যাস চেম্বারে পরিণত করে ফেলেছে।

কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের মতে, বাতাসের গুণমান সূচক অর্থাৎ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI)) ০-৫০ ভাল। ৫১-১০০ সন্তোষজনক, ১০১-২০০ মোটামুটি, ২০১-৩০০ খারাপ, ৩০১-৪০০ খুব খারাপ, ৪০১-৫০০ ভয়াবহ এবং ৫০০-র মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেই সেটা জরুরি অবস্থা বলে চিহ্নিত করা হয়। দিল্লিতে একিউআই-এর মাত্রা কোথাও ৯০০ তো কোথাও তা ১৬০০ ছুঁয়েছে। ভাবতে পারেন! যার ফলে দিল্লিতে এখন জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা (পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি) চলছে।

দিল্লিতে আপাতত কিছু দিন সমস্ত রকম নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গোটা শীতকালে কোথাও বাজি পোড়ানো যাবে না। এমনকি স্কুলেও সাময়িক ভাবে ছুটি দেওয়া হয়েছে। শিশুদের কথা ভেবে স্কুলগুলোকে ‘মাস্ক’ দেওয়া হয়েছে। এ দিকে হাসপাতালে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা নিয়ে রোগী ভর্তির সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। বহু মানুষ চোখের সমস্যা নিয়েও হাসপাতালে যাচ্ছেন। এই সমস্যাগুলি হচ্ছে ধোঁয়াশার জেরে।

দূষণের জন্য স্বর্ণপদকের ব্যবস্থা থাকলে দিল্লিকে হারানো কঠিন হত! কী ভাবে এই দূষণ হলো? বিজ্ঞানীদের মতে, এর মূল কারণ নাড়া পোড়ানো। নাড়া অর্থাৎ ফসল কাটার পরে জমিতে ধান বা গম গাছের গোড়ার যে অংশ অবশিষ্ট থাকে। দিল্লির বাতাসে বিষ ছড়িয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছে পার্শ্ববর্তী রাজ্য পঞ্জাব, হরিয়ানার খেতে নাড়া পোড়ানো। পুড়ছে খেত। ধোঁয়ায় ঢাকছে আকাশ। শুধু দিল্লিতে নয়, বাস্তবে এই পরিস্থিতি আমার আপনার সবার চারপাশেই।

পরিবেশ গবেষণা সংস্থাগুলি বলছে, বাতাসে ভাসমান ধুলিকণার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের মহানগর ও শহরতলিগুলির বাতাস যথেষ্ট দূষিত। শ্বাসনালী, ফুসফুসের ক্যানসার, হাঁপানির সমস্যায় ভুগতে শুরু করেছেন অনেকে। পরিবেশ আদালতও বিষয়টি নিয়ে সচেতন করেছে। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি সে ভাবে বদলায়নি। এই অবস্থায় কোনও কোনও বিজ্ঞ ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন যে, এক বিশাল যজ্ঞ করে ইন্দ্রদেবকে খুশি করতে পারলে তিনিই সব ঠিক করে দেবেন। এই নিদানে কাজ হবে কি না জানি না তবে যে ভাবে খড় পোড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে, তাতে বায়ু দূষণের নিরিখে খুব তাড়াতাড়িই আমরা দিল্লিকে ছুঁয়ে ফেলব। এত ধোঁয়াশা সত্ত্বেও সেটা কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

কয়েক বছর আগে তো পরিস্থিতি এমন ছিল না। গ্রামীণ জীবনে খড়ের চাহিদা দীর্ঘ দিনের। গরুর খাদ্য হিসাবে খড় একটি অন্যতম উপাদান। এ ছাড়াও গ্রামাঞ্চলে কেউ কেউ খড়ের ছাউনি করেন। তা হলে আজ চাষি খড় পোড়াচ্ছেন কেন? রকেট সায়েন্সের যুগে গোপালনের প্রবণতা কমেছে। খড়ের চাহিদা কমেছে। ধান কাটার কাজে হারভেস্টার মেশিনের ব্যবহার বেড়েছে। কারণ, গত কয়েক বছর ধরেই একশো দিনের কাজের প্রকল্প-সহ নানা কারণেই জনমজুরের আকাল দেখা দিয়েছে। জমি থেকে ধান কাটা, তার পরে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সময় সাপেক্ষ। ঝক্কির কাজ। প্রায় নব্বই শতাংশ চাষিই মজুরের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখন ধান কাটার মজুরের যে বড়ই অভাব! এই জন্যই হারভেস্টার মেশিনের রমরমা।

হারভেস্টার যন্ত্র ধান গাছকে টুকরো টুকরো করে দেয়। ফলে খড় বলে কোনও ব্যাপারই থাকে না। আর জমিতে পড়ে থাকা টুকরোগুলো অন্য কোন কাজেও আসে না। তাই জমি ফাঁকা করতে ইদানিং সেই সব পোড়ানোর প্রবণতা শুরু হয়েছে। তা ছাড়া দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নির্দেশিত পথে ফসল বা খড় নষ্ট করতে হলে কুইন্টাল প্রতি শ’খানেক টাকা খরচ। সেই খরচের দায় কেউ নেবে না। অনেকের মতে, ওই পোড়া খড় দিয়ে আবার সার তৈরি হয়। কিন্তু সেটা সঠিক নয়। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। উল্টে এর ফলে চাষের উপযোগী পোকা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে মাটির উর্বরতা। মারা পড়ছে মাটিতে থাকা বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, উপকারী জীবাণু। তার জেরে চাষিকে রাসায়নিক সারের উপর ভরসা করতে হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য। খড় পোড়ানোর ফলে বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইডের মতো গ্যাস উৎপন্ন হয়। পাশাপাশি নির্গত হয় বিস্তর পোড়া কার্বন কণা, যা কিনা বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ায়। পরিনাম স্বরূপ সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা।

নানা আর্থ-সামাজিক কারণের সঙ্গে আছে কথা ও কাজের সমন্বয় করার ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। সেই কারণেই বায়ু দূষণ ঠেকানো যাচ্ছে না। তা হলে কি বিষ-বাষ্পে শ্বাস নেওয়াটাই ভবিতব্য? খড় পোড়ানোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার বিকল্প উপায় কী? এখন খড় থেকে হ্যান্ডমেড পেপার তৈরি করা হচ্ছে। খড় না পুড়িয়ে এরকম ভাবেও তার ব্যবহার হতে পারে। আবার সরকারি ভাবে কৃষিমেলার সময় খড় না পোড়ানোর বিষয়ে সচেতন করা যায়। চাষিদের মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে প্রচার চালানো গেলেও অনেকটাই কাজ হয়। তদের ভুল ধারণাগুলোও ভাঙা যায়।

কৃষির উন্নতির জন্য যেমন প্রয়োজন হয়েছিল সবুজ বিপ্লবের ঠিক তেমনই এ বারের বিপ্লব হতে হবে সচেতনার। সেটা যত দিন পর্যন্ত না হবে তত দিন আমাদের ধোঁয়াশার কবল থেকে মুক্তি নেই। খড় পোড়ানো বন্ধ করতে গেলে প্রয়োজন নিয়মিত নজরদারি। সরকারি খাতায়-কলমে হয়ত নজরদারি আছে। কিন্তু বাস্তবে ‘সেই নজরদারির’র কাজটা ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, সে দিকে কে নজর রাখবে? সদুত্তর নেই।

লেখক শিক্ষক, বাগডাঙা রামেন্দ্রসুন্দর স্মৃতি বিদ্যাপীঠ

অন্য বিষয়গুলি:

Delhi Pollution Pollution Stubble burning
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy