Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

কত জনকে মুছে দেবেন

শ্মশানে বুড়ির মুখাগ্নি করল নাতিই। ডাক্তারের হাতে লেখা ডেথ সার্টিফিকেটটা জমা নিয়ে রসিদ দিয়ে শ্মশানের লোকটি বলল, ‘‘এক মাস পরে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে নেবেন।’’

সীমান্ত গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

চমৎকার বিশ্বাস গত মাসে মারা গেল। বয়স হয়েছিল নব্বই বছর। কিংবা কে জানে, হয়তো বা তার থেকেও কিছু বেশি। বয়সের তো কোনো গাছ-পাথর ছিল না বুড়ির। শেষ ছ’মাস বিছানার সঙ্গে একেবারে লেপ্টে গিয়েছিল শরীরটা। তার আগে, যতদিন পেরেছে কুঁজো হয়ে থাকা শরীরটা নিয়ে নারকেল পাতার ‘বাগো’ খুঁজে বেরিয়েছে, পেলেই টানতে টানতে নিয়ে ফেলেছে নিজের উঠোনে, তার পর সারা দুপুর সেই নারকেল পাতা চিরে ঝাঁটার কাঠির শলা বার করেছে। ওই এক নেশা ছিল বুড়ির, নারকেল পাতার ঝাঁটা বানানো। বুড়িকে দেখতে ছিল টকটকে ফরসা। কে জানে, জন্মমুহূর্তে তার সেই গাত্রবর্ণই হয়তো তার বাবা-মাকে প্ররোচিত করেছিল এমন অদ্ভুত নাম দিতে। তা সে যা-ই হোক, সাবেক পূর্ববঙ্গের যশোর জেলার কোনও এক গ্রামের মাঝবয়সি বিধবা চমৎকার বিশ্বাস একাত্তর সালে তার সোমত্থ পুত্রবধুর সঙ্গে বসিরহাটের সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছিল ‘এপারে’। সেই পুত্রবধুর কোলে তখন একটি বছর চারেকের ছেলে।

চমৎকারের একমাত্র পুত্র পেশায় ছিল মাঝি, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা খানসেনারা তাকে তার নৌকোসহ ডুবিয়ে দিয়েছিল ভৈরব নদীতে। সেই খবর পেয়ে রাতের অন্ধকারে এক বস্ত্রে ঘর ছেড়েছিল চমৎকার বিশ্বাস, পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে। সীমান্ত পেরিয়ে এসে উঠেছিল শহরতলির রেললাইন ঘেঁষা বস্তির এক চিলতে ঘরে। চার দশক ধরে চমৎকার বিশ্বাস আর তার পুত্রবধূর জীবন কেটেছে বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে, ঘর মুছে। এই করেই ছেলেটিকে প্রথমে স্কুলে, তার পর কলেজে পড়িয়েছে তারা, গ্র্যাজুয়েট বানিয়েছে। সেই ছেলেটি আজ একটি মশলা কোম্পানির সেলসম্যান। তার রোজগারে ইদানীং একটু শ্রী ফিরেছে সংসারে। ছিটে বেড়ার দেওয়াল পাকা হয়েছে, টালির চালের জায়গায় উঠেছে অ্যাসবেসটাস, ঘরে এসেছে রঙিন টিভি সেটও। সেই ঘরেই শেষ নিঃশ্বাস পড়ল তার।

শ্মশানে বুড়ির মুখাগ্নি করল নাতিই। ডাক্তারের হাতে লেখা ডেথ সার্টিফিকেটটা জমা নিয়ে রসিদ দিয়ে শ্মশানের লোকটি বলল, ‘‘এক মাস পরে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে নেবেন।’’ কী হবে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে? ঠাকুমার না আছে কোনও বিষয়সম্পত্তি, না পাবে পেনশন। ‘‘তার ডেথ সার্টিফিকেট আমার কী কাজে লাগবে?’

সে দিন, চমৎকার বিশ্বাসের নশ্বর দেহ যখন ছাই হয়ে যাচ্ছিল ইলেকট্রিক চুল্লিতে, নদীর ধারে বসে চোখের জল মুছতে মুছতে অদ্ভুত এক গল্প শুনিয়েছিল তার সেই নাতি। বুড়ি নাকি আসলে তার কেউ নয়। কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই তাদের মধ্যে। নেহাতই এক গ্রামের বাসিন্দা ছিল তার মা আর এই বুড়ি। দুই জনেরই তিন কুলে কেউ ছিল না। বিপদের মুখে তাই তারা পরস্পরকে আত্মীয় বানিয়েই সীমান্ত পার করে এ দেশে এসেছিল এবং সেই ভাবেই পার করে দিয়েছিল একটা গোটা জীবন। পাড়া প্রতিবেশী, সমাজের কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে তারা আসল শাশুড়ি-বউমা নয়। এ দেশে যথাসময়ে তাদের রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড আধার কার্ডও তো হয়েছিল সেই শাশুড়ি আর পুত্রবধূর পরিচয়েই।

বুড়ি তো মরে গিয়ে বেঁচে গেল। জীবিতাবস্থায় তার কাছে কেউ ‘লিগ্যাসি ডেটা’ চায়নি। ভাবছিলাম, সেই সমস্ত চমৎকার বিশ্বাসদের কী হবে, যাঁরা বেঁচে আছেন এ রাজ্যের হাজার হাজার রেলবস্তিতে, উদ্বাস্তু কলোনির অন্ধকার ঘুপচি কুঠুরিতে, আলোকোজ্জ্বল কলকাতা শহরের নীচের তলায়? যাঁদের কেউ স্বাধীনতার পরে, কেউ বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়, কেউ বা তারও পরে শুধুমাত্র একটু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার আশায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে চলে এসেছেন এ দেশে? এনআরসি কড়া নাড়ছে তাঁদের দরজায়। এত দিন ধরে রাষ্ট্রের চোখে নেই-হয়ে-থাকা সেই মানুষগুলিকে এ বার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে হবে! তাঁরা কি নিজেরাই ছাই জানেন যে তাঁরা কারা, কোনটা তাঁদের দেশ, কোনটা বৈধ-উত্তরাধিকার? তাঁদেরও কি তবে ‘মরিয়াই প্রমাণ করিতে হইবে’ যে তাঁরা ‘বেঁচে ছিলেন’? কাদম্বিনীর মতো?

যেমন প্রমাণ দিলেন ময়নাগুড়ির বাসিন্দা অন্নদা রায়। পৈতৃক জমিজমার কাগজ খুঁজে না পেয়ে গত সপ্তাহে আত্মহত্যা করলেন তিনি। এ বার তাঁর ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি হবে। অতঃপর তিনি যে আমার দেশের নাগরিক ছিলেন এই মর্মে আর কোনও সংশয়ই অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষটি নেই তো কি হল, নাগরিকত্ব তো প্রমাণিত হল তাঁর!

বলিউডি ছবিতে দেখা সেই গল্পটা মনে পড়ে। জালিয়াতি করে এক গ্রাম্য বৃদ্ধকে ‘মৃত’ সাব্যস্ত করে তাঁর আত্মীয়। দখল করে নেয় তাঁর জমিজমা। বৃদ্ধ আদালতে যান। কিন্তু ‘অরিজিনাল ডেথ সার্টিফিকেট’ দাখিল করে বিবাদী পক্ষ। বৃদ্ধ কিছুতেই প্রমাণ করতে পারছিলেন না তিনি জীবিত। শেষে ‘দুষ্টু’ উকিলের পরামর্শ জজসাহেবের সামনেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার ‘চেষ্টা’ করলেন সেই বৃদ্ধ। আত্মহত্যা আইনের চোখে অপরাধ, তাই জজসাহেব তাঁকে তিন মাসের জেলের সাজা দিলেন। সরকারি কাগজে ‘সাজাপ্রাপ্ত আসামি’ হিসেবে নাম উঠল তাঁর, প্রমাণ হল তিনি ‘বেঁচে আছেন’।

এ রাজ্যেরও কয়েক লক্ষ মানুষকে কি তবে এ বার শ্মশানে, জেলে, ডিটেনশন ক্যাম্পে গিয়ে প্রমাণ করতে হবে, তাঁরা আসলে ছিলেন? শুধুমাত্র ‘সসম্মানে বেঁচে থাকার অধিকার’টুকু আদায় করতে আর কত সম্মান হারাতে হবে তাঁদের? এই পৃথিবীর এত বড় মানচিত্রে তাঁদের ‘অস্তিত্বের অধিকারটুকু’ও জুটবে না?

আর, এই সত্য তো মনে রাখতেই হবে যে, এ ভাবেই এই মুহূর্তে বেঁচে আছেন পৃথিবীর অগণিত মানুষ। তাঁরা কোনও না কোনও ভাবে শরণার্থী, অভিবাসী, বাস্তুচ্যুত। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর সব থেকে বড় সমস্যার নাম শরণার্থী সমস্যা।

আসলে, আমরা সবাই এক এক জন চমৎকার বিশ্বাস। কত জনকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরবেন, কত জনকে ঘাড় ধরে ঠেলে দেবেন সীমান্তের ও পারে? কত জনকে বাধ্য করবেন আত্মহত্যা করতে? ক’জায়গায় দুর্ভেদ্য পাঁচিল তুলবেন? পারবেন মুছে দিতে এই ভাবে আমাদের, পৃথিবীর মানচিত্র থেকে, ইতিহাস থেকে?

অন্য বিষয়গুলি:

NRC Assam Detention Camp
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy