ইস্কুলে যখন ছোট ক্লাসে পড়ি, ঠাকুমাকে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলতে শুনতাম, “এর চেয়ে ব্রিটিশ আমলই ভাল ছিল!” দুঃখ পেতাম কথাটা শুনে। রুশদি-বর্ণিত আধুনিক ভারতের ইতিহাসের সেই ঐতিহাসিক মধ্যরাতের প্রজন্ম আমরা। লেখাপড়া শেখার সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামের গল্প শুনছি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ তখন প্রণম্য মানুষ। ক্ষুদিরামের, মাতঙ্গিনী হাজরার, দেশবন্ধুর, মাস্টারদা’র, শান্তি-সুনীতির, নেতাজির সাহসী আত্মত্যাগের কাহিনি পড়ছি। বিবেকানন্দের বিশ্বজয়ের গল্পে, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলালের দেশাত্মবোধক গানে-কবিতায়, নজরুলের জ্বালাময়ী গানে তখন আমাদের মন উজ্জীবিত। তার ওপরে শুনতাম নেহরু, ভগৎ সিংহ, লালা লাজপত রাই, টিলক, গোখলে, রানাডের কথা। আর শুনতাম এক আশ্চর্য মানুষ গাঁধীর গল্প— তাঁকে নিয়ে তর্ক ছিল বাঙালির, কিন্তু শ্রদ্ধা-ভালবাসাও ছিল। মোট কথা, ব্রিটিশ আমল যে আমাদের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়, এ নিয়ে তখন আমাদের মনে কোনও সন্দেহের অবকাশই ছিল না। তাই ঠাকুমার কথায় ব্যথিত ও আশ্চর্য হতাম। স্বাধীনতা বস্তুটির যে একটি কোনও নির্দিষ্ট অর্থ নেই, বিভিন্ন প্রজন্মের অভিজ্ঞতায় যে কথাটির অর্থের পরিবর্তন হয়, পরস্পরের সমসাময়িক মানুষও কথাটির ভিন্ন ভিন্ন, এমনকি পরস্পরবিরোধী অর্থও করতে পারেন, সে সব জটিলতা বোঝার বয়স তখনও হয়নি। দেশভাগ হয়েছে। তার দুঃখকষ্ট সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের মনের ভাব তখন, “গিয়াছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ’”। আমরা, বাঙালি ইস্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তখন সেই আদর্শবাদিতায় উদ্বুদ্ধ।
একটু বড় হতে হতে এই সব গল্পের কাঠামোয় চিড় ধরল। শুনলাম ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’-এর কথা। দারিদ্রের কথা, দেশভাগপ্রসূত শরণার্থীদের দুঃখের কাহিনি, দেশময় নেতাদের চুরির, ভ্রষ্টাচারের কথা। ‘ও আমার দেশের মাটি’, বা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ শুনলে তখনও চোখ ভেজে, গলার মধ্যে একদলা কান্নাও উঠে আসে, কিন্তু— অথবা সেই কান্নার নিষ্ফলতার কারণেই— মনের মধ্যে তখন যেন নানান অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাগ-ক্ষোভের বারুদও জমা হয়। এক দিন হঠাৎ যুবামানুষের সেই সব পুঞ্জীভূত বারুদকে হাতিয়ার করে প্রথমে বামপন্থী-তথা-কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পরে নকশাল আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের বুকে ফেটে পড়ল। স্বাধীনতার মানে আবার অনেক তরুণ মানুষ নতুন করে ভাবলেন— নইলে কি তাঁরা বলতে পারতেন যে ১৯৭০ হবে ‘মুক্তির দশক’? বাংলাদেশের মানুষ ’৭১ সালে এক অর্থে মুক্তি পেলেন ঠিকই, কিন্তু ভারতে মুক্তির সেই কল্পিত দশক তো এলই না, বরং যা এল তা ১৯৭৫-এর শ্রীমতী গাঁধী-ঘোষিত জরুরি অবস্থা। কৃষকের অভ্যুত্থান তখন দূর অস্ত্। আমরা ক্রমশ বুঝতে শুরু করেছি, মানুষের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক অধিকারও তাঁর স্বাধীনতারই অংশ। স্বাধীনতার মানে কেবল রাজা-বদল বা শাসকশ্রেণির পরিবর্তন বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপ্লবী সংস্কার নয়। স্বাধীনতা শব্দটি যেন ‘অধিকার’ শব্দটির সঙ্গে মিশে গেল। অমর্ত্য সেন তাঁর নানান কাজেকর্মে পৃথিবীর মানুষকে একটি খুব জরুরি কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন: অধিকার শুধু খাতায়-কলমে থাকলেই চলে না, অধিকার সত্যিকারের ব্যবহার করার ক্ষমতাও থাকা চাই মানুষের, ও তার জন্য প্রয়োজন কিছু ন্যূনতম ব্যবস্থা— স্বাস্থ্যের, শিক্ষার, বাসস্থানের।
কথাগুলো ভারতীয় জনজীবনে পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা থেকে আসেনি, এসেছে নানান আন্দোলন, অশান্তি ও সংঘাত থেকে। ১৯৭০-এর দশক থেকে নারীবাদী আন্দোলন, দলিত মানুষের বিদ্রোহ, প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ, পরিবেশবাদী আন্দোলন, এই সমস্ত সংগ্রাম আমাদের যেমন এই ভূখণ্ডের ইতিহাস নতুন করে পড়তে শিখিয়েছে, তেমনি আমাদের জীবনে ‘স্বাধীনতা’ কথাটিকেও অনেক বিচিত্র ও নতুন দ্যোতনায় ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে সম্প্রসারিত করে গিয়েছে। এক বার যখন এ কথা বুঝতে পারি যে মানুষের ব্যক্তিগত ‘অধিকার’, রাষ্ট্রিক ক্ষমতা ও দেশের স্বাধীনতা কোনও এক অদৃশ্য কিন্তু জটিল সুতোয় বাঁধা, তখন রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জ্যোতিরাও ফুলে, পেরিয়ার রামস্বামী, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখকে আমাদের স্বাধীনতা-অর্জনের বহুমাত্রিক, বহুমুখী কাহিনির বাইরে রাখি কী ভাবে? আমাদের স্বাধীনতার গণতান্ত্রিক চেতনা এ-ভাবেই এগিয়েছে, নানান তাত্ত্বিকের হাত ধরে নয়, বরং নানান বিদ্রোহ, অশান্তি, ও সংগ্রামের পথ ধরে। এই কারণেই ভারতীয় গণতন্ত্রের চরিত্র নির্ধারণ করতে গিয়ে লেখক ভি এস নইপল একদা বলেছিলেন, ‘আ মিলিয়ন মিউটিনিজ় নাও’। ভারতের যে কোনও সময় যেন লক্ষ লক্ষ বিদ্রোহের সমষ্টি।
এ কথা বলে ‘বিদ্রোহ’কে রোম্যান্টিক দৃষ্টিতে দেখতে চাই না। মানুষের বিদ্রোহের পিছনে থাকে নানা অপ্রাপ্তি ও অভিযোগ। ১৯৪৭ সালে ভারত যেখানে ছিল, তার থেকে আজ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। দারিদ্ররেখার নীচে থাকা মানুষের হার কমেছে, জাতীয় আয় অনেক বেড়েছে, প্রযুক্তির চর্চা ও ব্যবহারে ভারতের উন্নতি সর্বস্বীকৃত। সবচেয়ে বড় কথা: ১৯৪৭-এর কাছাকাছি সময়ে যে সকল দেশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিল, তার মধ্যে অতি অল্প কয়েকটি দেশই আজ না-ভেঙে তাদের ভৌগোলিক ঐক্য ও অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। আমাদের সমস্ত অভ্যন্তরীণ কোঁদল ও বিবদমানতা সত্ত্বেও আমরা সত্তর বছর ধরে কিছু কাজ নিশ্চয়ই ঠিক ভাবে করতে পেরেছি যার ফলে এই বহুভাষী, বহুধর্মের দেশ খণ্ডিত হয়ে যায়নি।
এই অসামান্য সাফল্যের একটি সূত্র নিশ্চয়ই এইখানে যে ভারতীয় গণতন্ত্র শুধুমাত্র ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার যন্ত্রমাত্র নয়। ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি বিশিষ্ট চরিত্র আছে। এটি বহুস্বরের গণতন্ত্র। রাষ্ট্র কোনও দিন স্টিম রোলারের মতো কাজ করেনি। আমাদের স্বাধীনতা বহুস্বর বজায় রাখার স্বাধীনতা।
কিন্তু এ স্বাধীনতার ওপর চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। ’৪৭-এর পর জনসংখ্যা বেড়েছে চারগুণ। তাঁরা অনেকেই বয়সে তরুণ। সেই পরিমাণে কর্মসংস্থান হয়নি। শহরের বহর বাড়ছে হিসেব-ছাড়া ভাবে। চাষিদের দুর্ভোগের কথা আমরা জানি। মধ্যবিত্তের জীবনও প্রতিযোগিতার চাপে দুর্বিষহ। পরিবেশগত সঙ্কটের কথা বাদই দিলাম। জল, বায়ু, বালি, পাথর, আবহাওয়া, পাহাড়, বনানী, জন্তুজানোয়ার, সমুদ্র, কোথায় সঙ্কট নেই? এক দিকে ক্রমবর্ধমান জাতীয় আয়, প্রযুক্তির গৌরব, বিশ্বে এক অন্যতম শক্তিশালী দেশ হওয়ার স্বপ্ন, মিডিয়ার দৌলতে পশ্চিমি তথা গ্লোবাল দুনিয়ার হাতছানি; অন্য দিকে দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের ফেটে-পড়া নানান বিক্ষোভ।
ভারতের রাজনীতির মূলস্রোতের গতিবিধি দেখলে মনে হয় যেন এই রকম দু’মুখী চাপের মুখে পড়ে কিছু নেতৃস্থানীয় ও ক্ষমতাশালী মানুষ আর তাঁদের প্রভাব এবং মদতে পুষ্ট মিডিয়া ও সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভারতের প্রয়োজন একটা কড়া হাতের শাসন। বিরোধী-মতেরই তাঁরা বিরোধী। তাঁরা মনে করছেন এই পদ্ধতিতেই ভারতকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র করা যাবে। এর জন্য তাঁরা এক দিকে যেমন কেন্দ্রীয় সরকার নানান ব্যবস্থা করে দিল্লির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করছে দেখলেও বিচলিত না হয়ে তাকেই সমর্থন করেন, তেমনই অন্য দিকে নানান ক্ষেত্রে একটি আগ্রাসী ‘হিন্দু’ জাতীয়তাবাদের সদর্প পদচারণা দেখেও তাঁরা তার জয়ধ্বনি দেন। ভারতে গণতান্ত্রিক ভোটাভুটি বহাল আছে ঠিকই, কিন্তু বেশ কিছু গণতান্ত্রিক অধিকার আজ বিপন্ন।
দেশের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা খর্ব করেই ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে কি না সে কথার উত্তর দেওয়ার মালিক ভারতের জনগণ। ভারতের ভবিষ্যতের নিয়ন্তা তাঁরাই। আমি যে জাতীয়তাবাদের ছায়ায় বড় হয়েছিলাম, সেখানে ভারতীয় প্রার্থনায় ঈপ্সিত যে স্বর্গ, তার একটি, কেবল একটিই, গ্রহণযোগ্য বর্ণনা ছিল: “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির।” পৃথিবীর নানান দেশে মানুষের ভবিষ্যতের নানান আলোচনা শুনি। কিন্তু শুধু ভারত নয়, যে কোনও মানুষের ভবিষ্যতের কথা ভাবি যখন, ফিরে আসি ওই কবিতাটিতেই। ওই কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে স্বাধীনতার যে আদর্শ ঝঙ্কৃত হয়েছে, আজও তাকেই আমার মানুষের আরাধ্য মনে হয়।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy