রানিদেবী বাড়ি গেলেন। ৯ ডিসেম্বর এই মর্মে প্রকাশিত খবরটি কিন্তু আমাদের মধ্যে স্বস্তির সঞ্চার করে না। কারণ বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে বৃদ্ধ রানিদেবীকে যে ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হল তা আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভয়ের সঞ্চার করে, যা শীতল ও অমোঘ। কোনও এক সোনালি অতীতে রানিদেবীর সংসার ছিল সুখ ও সমৃদ্ধির, যার প্রায় সবটাই ধারাবাহিক দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে হারিয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু পরিচারিকার কাজ করা তাঁর ছোট মেয়ে ও এক জরাজীর্ণ বাড়ি। কিন্তু সেই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কেউ রানিদেবীকে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে ছেড়ে দিয়ে আসে। সেখানে অভুক্ত, অসহায় ভাবে কয়েক দিন ঘুরে বেড়ানোর পরে শুভানুধ্যায়ীদের প্রচেষ্টায় তিনি বাড়ি ফেরেন। প্রতিবেশীদের সন্দেহ, তাঁর জমি, বাড়ি হাতানোর জন্যই কেউ তাঁকে নিরুদ্দেশ করে দিতে চেয়েছিল।
রানিদেবীর বৃত্তান্ত বিচ্ছিন্ন নয়, অভিনবও নয়— অবহেলিত বার্ধক্য তো ইন্দির ঠাকরুনের সময়েও ছিল। কিন্তু সেখানেও একটা পরিবর্তন লক্ষণীয়। বিংশ শতাব্দীতে বৃদ্ধরা প্রান্তিক হয়ে পড়ছিলেন পরিবারের গণ্ডিতে, কিন্তু পরিবার তাঁদের বর্জন করেনি। একবিংশ শতাব্দীর পরিবারেরা কখনও আগ্রাসী হিংসায়, কখনও শীতল অবহেলায় দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে তাঁদের মুখের উপরে। আমাদের মতো দেশে সমস্যাটা আরও গভীর। পশ্চিমের দেশে পরিবারের জায়গাটা রাষ্ট্র নেয়, বৃদ্ধদের থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। অবস্থাপন্ন পরিবারের বৃদ্ধরা আর একটু বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতে পারেন বাজারের মাধ্যমে। এখানকার বৃদ্ধদের সঙ্কট আরও গভীর। পরিবারবিতাড়িত এই বৃদ্ধ মানুষদের জন্য না আছে রাষ্ট্র, না বাজার।
অপরাধীদের লক্ষ্য হয়ে উঠছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, এ কথা এক ভাবে মেনে নিয়েছে ভারতীয় রাষ্ট্রও— ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো (এনসিআরবি)-র প্রতিবেদনে তাঁদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অপরাধের আলাদা সারণি প্রকাশ করা হয়। ২০১৬ সালে সর্বভারতীয় স্তরে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের মোট সংখ্যা ২০৬৫৭, পশ্চিমবঙ্গে ১৮৪। রাজ্যগুলির তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান ২৮। কিন্তু এই পরিসংখ্যান বিশেষ স্বস্তি দেয় না। তার একটা কারণ, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বৃদ্ধদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অপরাধ দ্রুত হারে বেড়েছে। ২০১৫ সালে এই ধরনের অপরাধের বৃদ্ধিহার সারা দেশে ছিল ৯% এবং পশ্চিমবঙ্গে ৫.৬%। ২০১৬’তে সর্বভারতীয় বৃদ্ধিহার কমে দাঁড়ায় ৫.৯%, পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধিহার বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭%! অন্য ভাবে দেখলে, ২০১৬’তে পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের সংখ্যা ছিল ১৮৪। ওই বছর রাজ্যে খুন হয়েছিল ২০৪৪, পণের জন্য মৃত্যু ৫৩৫, যৌন নিগ্রহ ৬৬৩, নারী পাচার ১৩৩, ধর্ষণ ১১১০। মনে রাখতে হবে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের উপর নির্যাতন অনেকাংশেই ঘটে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা, বৃদ্ধরাও এ সব ঘটনা পুলিশে জানাতে খুব একটা আগ্রহী হন না। জাতীয় অপরাধ পরিসংখ্যান সংস্থার প্রতিবেদন পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি হয়, তাই বাস্তব ঘটনার সংখ্যা আরও বেশি হওয়াই সম্ভব। তবু বৃদ্ধদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধ সরকারি নীতি নির্ধারণের স্তরে অনেক কম গুরুত্ব পায়।
যদি চোখ রাখি সংবাদপত্রের পাতায়, ২০১৭ অগস্ট থেকে ২০১৮ জুলাই পর্যন্ত প্রকাশিত দু’টি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের হিসেব কষে দেখছি, এই এক বছরে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের উপর নির্যাতন সম্পর্কে খবরের সংখ্যা এনসিআরবি রিপোর্টে প্রকাশিত ২০১৬’তে ঘটে যাওয়া ঘটনার থেকে অনেক কম। লক্ষণীয়, এনসিআরবি-র তথ্য আসে পুলিশ রিপোর্ট থেকে। সংবাদপত্রের অপরাধ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের একটা বড় অংশ পুলিশ রিপোর্ট থেকে এলেও, অনেক প্রতিবেদন পুলিশের হিসেবে থাকে না। আবার সব পুলিশ রিপোর্ট সংবাদপত্রের প্রতিবেদন হয়ে ওঠে না। আমার সংগৃহীত প্রতিবেদনগুলির মধ্যেও একটি স্থানিক পক্ষপাত পরিষ্কার। সেগুলি বাংলা কাগজ থেকে সংগৃহীত, তাই দু’টি ছাড়া সব ঘটনাই পশ্চিমবঙ্গের। বস্তুত, ঘটনাগুলির বেশির ভাগই কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী হুগলি, নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার। এর দু’টি ব্যাখ্যা থাকতে পারে। হয় বৃদ্ধদের বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটানোর প্রবণতা কলকাতার আশেপাশের অঞ্চলে বেশি এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারণে, অথবা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন নির্মাণে স্থানিক পক্ষপাত রয়েছে। তবে যে তথ্যগুলি উঠে আসছে, তা-ও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এই অপরাধের কত অংশ পরিবারের লোকেরা করছে আর কতটাই বা পরিবারের বাইরের লোকেরা করছে, এনসিআরবি-র রিপোর্টে তার হিসেব থাকে না। আমার সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী মোট সংঘটিত অপরাধের ৫৬% পরিবারের লোকের দ্বারা সংঘটিত, বাকিটা বাইরের লোক। আত্মহত্যা অবশ্য এর বাইরে। সংবাদপত্রে পাওয়া ঘটনাগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: অবহেলা, সম্পত্তিজনিত অপরাধ এবং হিংসাত্মক অপরাধ যেমন খুন, চুরি-ডাকাতি, শারীরিক আক্রমণ। বিভিন্ন ধরনের অপরাধের মধ্যে সমাপতন থাকতেই পারে। যেমন, অবহেলা বা খুন, সম্পত্তির লোভে হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে আমি যে প্রতিবেদনটি থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি তার ওপরেই ভরসা রেখেছি। যেমন পূর্ব মেদিনীপুরে এক ছেলে তার বৌয়ের সাহায্যে বাবাকে খুন করে। কিন্তু প্রতিবেদনে এই খুনের উদ্দেশ্য হিসেবে সম্পত্তির উল্লেখ নেই, একে হিংসাত্মক ঘটনা হিসেবেই ধরা হয়েছে। তেমনই, অবহেলার অনেক ঘটনাই সম্পত্তি গ্রাসের উদ্দেশ্যে সংঘটিত। প্রতিবেদনে তার উল্লেখ থাকলে সে রকম ঘটনাকে সম্পত্তিমূলক অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে মানসিক অবসাদের কারণে আত্মহত্যার ঘটনাকে অবহেলার ঘটনা হিসেবে গণনা করা হয়েছে। একমাত্র একটি ঘটনা ছাড়া— নাগেরবাজারে এক বৃদ্ধার অস্বাভাবিক মৃত্যু— সব ঘটনাই এই তিনটি শ্রেণির একটিতে পড়ে। লক্ষণীয়, এই তিনটি শ্রেণির গুরুত্ব সমান সমান। অর্থাৎ, সংবাদপত্রে প্রকাশিত মোট অপরাধের এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তিমূলক, এক-তৃতীয়াংশ হিংসাত্মক আর এক তৃতীয়াংশ অবহেলামূলক।
সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, অবহেলামূলক অপরাধ কলকাতায় তার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির থেকে তিনগুণ বেশি। সাধারণত উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে এ ঘটনা বেশি দেখা যায়। তবে, অবহেলার ঘটনা প্রধানত সল্ট লেক, বালিগঞ্জ, নিউ আলিপুরের মতো জায়গায় হলেও, দমদম, বেহালা বা নেতাজিনগরের মতো মধ্যবিত্ত এলাকাও এই তালিকায় আছে। সম্পত্তিগত কারণে নির্যাতনের ঘটনায় কিন্তু কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলা সমান সমান। হাওড়া, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় নির্মাণশিল্পের প্রসার ঘটছে, আর তাই সম্পত্তির দামও বাড়ছে— সম্পত্তির জন্য নির্যাতনের ঘটনা কি সেই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের অবাঞ্ছিত সামাজিক প্রতিক্রিয়া? প্রাথমিক অনুসন্ধান তেমন সঙ্কেতই দেয়। তবে এ বিষয়ে আরও জমির দাম, পারিবারিক আয় ইত্যাদির বিস্তারিত তথ্যের ভিত্তিতে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। হিংসাত্মক অপরাধের সংখ্যা আবার কলকাতায় পার্শ্ববর্তী জেলার তিনগুণ। দূরের জেলা হিংসাত্মক অপরাধে পার্শ্ববর্তী জেলার থেকে এগিয়ে, কিন্তু কলকাতাই শীর্ষে। এরও একটা অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা সম্ভব: এমন হিংসার শিকার হন অবস্থাপন্ন কিন্তু একা বসবাসকারী বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। কলকাতায়, এঁদের সংখ্যা বেশি। কিন্তু এই প্রতিপাদ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
এ বড় সুখের সময় নয়। এক বছরের জমা করা প্রতিবেদন হয়তো সে কথাই বলছে। নব্বইয়ের দশক থেকে যে বাজার ঢুকে পড়ছে, তা যে শুধুই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অফিসে চাকরি আর ভোগ্যবস্তু শোভিত ছিমছাম দু’কামরার যাপন এনেছে তা তো নয়। অনেক পুরনো মূল্যবোধ, পরিবার সম্পর্কে অনেক ধারণা ভেঙে দিয়েছে। সে নিয়ে এমনিতে দুঃখের কিছু নেই, মূল্যবোধ পরিবর্তনশীল। পরিবারের ধারণা পশ্চিমেও পাল্টেছে বার বার। কিন্তু পরিবার তথা গোষ্ঠীর ধারণা যখন ভেঙেছে, তার জায়গা নিয়েছে রাষ্ট্র (বা বাজার)। আমাদের ধর্ম ছেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু জিরাফের দেখাও পাওয়া যাচ্ছে না। কোন পথে জিরাফ আসবে (অর্থাৎ রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে) তা খোঁজার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। তারও আগে প্রয়োজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ওপর বাড়তে থাকা হিংসাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। সমস্যাকে সমস্যা না ভাবলে সমাধান পাওয়া অসম্ভব।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy