আপাতত জাতীয় শিক্ষানীতি লইয়া দেশবাসী উত্তেজিত— কেহ অভিযোগে, কেহ সমর্থনে। বুঝিতে অসুবিধা নাই, দেশের সরকার আর একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ করিল। পদক্ষেপটি জটিল, বহুস্তরীয়। সমগ্র দেশ যখন শতাব্দীর ভয়ালতম অতিমারির সহিত যুঝিতেছে, অসুস্থতা ও মৃত্যু কোণে কোণে ছড়াইয়া পড়িতেছে, তখন এমন একটি বিরাট পরিবর্তন আনিবার দরকার কী ছিল— ইহাই প্রথম কথা। যে সময় সরকারের সমস্ত সম্পদ, সমস্ত ভাবনা-চিন্তা অতিমারিকে আটকাইবার, নাগরিককে প্রাণে বাঁচাইবার লক্ষ্যে নিবেদিত হইবার কথা, তেমন সময়ে হঠাৎ শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলিচা বদলই এত গুরুত্ব পাইল কেন, প্রশ্ন উঠিবেই। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার যদি এই প্রশ্নের সদুত্তর না দিতে পারে, তাহা হইলে বিরোধী মহলে গুঞ্জরিত, এমনকি ঘোষিত, অভিযোগটি স্বীকার করিয়া লওয়া ভিন্ন গত্যন্তর থাকে না। করোনা অতিমারির সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকার নিজের বিভিন্ন লক্ষ্য সাধন করিয়া লইবার ব্রত লইয়াছে, গণতান্ত্রিক দেশে যে সব লক্ষ্যের পূর্তি অন্য সময়ে তীব্র বিতর্ক ও সংঘর্ষের জন্ম দিতে পারিত। অভিযোগটি আরওই সঙ্গত এই জন্য যে, জাতীয় সংসদকে সম্পূর্ণ এড়াইয়া গিয়া মৌলিক একটি সংস্কার সাধিত হইল! অথচ গত বৎসর যখন শিক্ষানীতির প্রস্তাবটি পেশ হইয়াছিল, তখন সাংসদরা বহু প্রয়োজনীয় আলোচনা উত্থাপন করিয়াছিলেন, বিভিন্ন রাজ্যের পক্ষ হইতে অনেক জরুরি উদ্বেগ উঠিয়া আসিয়াছিল। এই সমস্ত কিছু উপেক্ষা করিয়া নরেন্দ্র মোদী সরকার একতরফা ভাবে সংস্কার ঘোষণা করিয়া দিল। সংসদে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও সংসদীয় আলোচনায় এত অনীহা কিসের? সংসদ কি অপ্রাসঙ্গিক হইয়া গিয়াছে? ভারতবর্ষের পরিচয় কি ইতিমধ্যেই গণতন্ত্র হইতে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে?
ইয়েচুরি, তারুর প্রমুখ বিরোধী নেতারা ঠিক বলিতেছেন, বিষয়টি গুরুতর, উদ্বেগজনক। কেবল এই একটি ক্ষেত্র নহে, বেশ কিছু ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীকরণ ও বেসরকারিকরণের কার্যক্রম এই সুযোগে জোরদার করিবার প্রবণতাটি গত কিছু কাল যাবৎ সংশয়াতীত ভাবে স্পষ্ট। অথচ শিক্ষা এমনই একটি বিষয় যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত রাজ্য সরকারেরও সমান অধিকার— সংবিধানে ইহা যুগ্ম তালিকাভুক্ত। তাহা ব্যতীত, শিক্ষার ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের, শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞ মহলের মতামতও বড় মাপের গুরুত্ব দাবি করে— রাজনৈতিক নেতাদের মত অপেক্ষাও বড়। তাঁহারা নিজেদের মতামত জানাইয়াছেনও বটে, কিন্তু তাহার কিছুই বিবেচনায় আনা হয় নাই। সুতরাং, নূতন শিক্ষানীতি কী বলিতেছে, যাহা বলিতেছে তাহা দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভাল না মন্দ, ইত্যাদি বিবেচনারও অনেক আগে আসে এই পদ্ধতিগত অনাচার। এখনই যদি এই অন্যায় কেন্দ্রীকরণ ও অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না হয়, বিপুল ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী।
কেন্দ্রীকরণ বিষয়ে একটি অন্য উদ্বেগের কথাও না বলিলেই নহে। বিজেপি সমর্থকরাও বোধকরি অস্বীকার করিবেন না যে এই নূতন শিক্ষানীতিতে তাঁহাদের কেন্দ্রীয় সংগঠনের ছাপটিও স্পষ্ট। বাস্তবিক, আরএসএস-এর একক রাশ এতখানি প্রোথিত করিবার চেষ্টা সাম্প্রতিক কালে আর কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায় নাই। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নাম পাল্টানো হইতে শুরু করিয়া সংস্কৃত ও ধ্রুপদী শিক্ষার উপর অত্যধিক জোর, একতা ও অখণ্ডতার উপর চোখ রাখিয়া সমগ্র পাঠ্যক্রম নির্ধারণের প্রয়াস, সবই সঙ্ঘীয় সুরটিকে দেশব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে গভীর ভাবে ছড়াইয়া দিবার বন্দোবস্ত। এই দিক দিয়া দেখিলে, প্রশ্নেরও বিশেষ অবকাশ নাই, পদ্ধতি ও প্রতিপাদ্য দুই দিক দিয়াই এই নূতন শিক্ষানীতি যথার্থই ভারতীয় সমাজের চরিত্র বদলাইবার অস্ত্রোপচার। করোনাকালের করাল ভবিতব্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy