দৃশ্যের জন্ম হয়। অনুব্রত মণ্ডল ও হৃদয় ঘোষ। বীরভূম। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
র বীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘...সত্যকে দাস করিয়া আমরা মিথ্যার দাসত্বে রত হইলাম, দাসত্ব হইতে গুরুতর দাসত্বে উত্তরোত্তর নামিতে লাগিলাম।’ বাইশে শ্রাবণের আবেশে নয়, কথাটা মনে এল রাজ্য-রাজনীতির দু’টি বহুচর্চিত ঘটনার সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি দেখে। প্রথমটি বীরভূমের পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষ হত্যা-মামলা। দ্বিতীয়টি সাত্তোরের নির্যাতিতার বয়ান বদল।
২০১৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে পাড়ুইয়ের কসবা পঞ্চায়েতে নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাড়িতে ঢুকে তাঁর বাবা সাগর ঘোষকে খুন করে দুষ্কৃতীরা। দিনটা ছিল ২১ জুলাই, তৃণমূল যে দিনটিকে পালন করে ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে। সে সময়ে হৃদয় ছিলেন বীরভূম জেলা তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরোধী গোষ্ঠীতে। রাজ্য জুড়ে তোলপাড় হয়ে যাওয়া সেই হত্যাকাণ্ডে অনুব্রত, তাঁর ঘনিষ্ঠ জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী-সহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে দায়ের হয় খুনের অভিযোগ। রাজ্য সরকার বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করলেও সিবিআই তদন্ত দাবি করে হাইকোর্ট, সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্টেও যান হৃদয়বাবু ও তাঁর পরিবার।
কিন্তু তার পর? যে দাবি নিয়ে প্রবল চাপের মুখেও দাঁতে দাঁত চেপে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গেলেন হৃদয়, সেই দাবি থেকেই সম্প্রতি সরে এলেন তিনি। জানালেন, আর সিবিআই তদন্ত চান না তাঁরা! এ কথা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনও জানিয়েছেন তিনি। কেন এ মত বদল?
তাঁর নিজের দেওয়া উত্তর থেকেও কি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সব? হৃদয় ঘোষ প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, মামলা চালানোর ব্যাপারে বহু আশ্বাস তিনি অনেকের থেকে পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই আশ্বাস কতখানি কার্যকর, তা নিয়ে তাঁর মনে ধন্দ তৈরি হয়েছে। মামলা চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতিও তাঁর নেই। বাড়ির লোক ও আত্মীয়দের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
ধন্দটা আসলে কার? তাঁর নিজের না আমাদের মতো আমজনতার, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি-বুদ্ধিসুদ্ধি যাঁদের বড় একটা নেই। আমরা তো শুধু দেখি, দেখতেই থাকি— টেলিভিশন সিরিয়াল, প্রভাবশালীদের মেগাসিরিয়ালের মতো মেগা-অসুস্থতা, বন্যাত্রাণে তারকাদের ভিড়, বাহুবলীদের হুঙ্কার, কলেজে ঢুকে পিটিয়ে ছাত্রহত্যা— দেখার কি আর শেষ আছে!
কিন্তু তাতেও কি ধন্দ কাটে? নির্বাচনের আগের রাতে যে ‘নির্দল’ প্রার্থীর বাড়ি ঢুকে তাঁর বাবাকে হত্যা করা হল, যে হত্যাকাণ্ডের তদন্তের শেষ দেখবেন বলে সর্বস্ব পণ করলেন হৃদয় ঘোষ ও তাঁর পরিবার, প্রভাবশালী অভিযুক্তের চোখে চোখ রেখে, পুলিশ-প্রশাসনের নিরন্তর চাপ সহ্য করে, নিত্য প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যিনি প্রত্যন্ত পাড়ুই থেকে পা দিয়েছিলেন শাহি দিল্লির রাজপথে, সেই হৃদয়কে কি কেড়ে নেওয়া হল? যদি তা হয়, তবে কাড়ল কে বা কারা?
হৃদয়বাবু অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁর এই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও রাজনৈতিক চাপ নেই! সাত্তোরের সেই নির্যাতিতার উপরেও কি চাপ নেই? মাত্র কয়েক দিন আগেই ওই গৃহবধূ, তাঁর স্বামী, শাশুড়ি-সহ ছ’জনকে জামিন অযোগ্য নানা ধারায় গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মীকে বাধাদান ও বিস্ফোরক আইনের দু’টি জামিন-অযোগ্য ধারাও দেয় পুলিশ। তাঁর চার বছরের শিশুপুত্রকে নিয়েই জেল হেফাজতে যেতে হয় ওই নির্যাতিতাকে। পাঁচ দিন জেলে কাটানোর পরে জামিন পান তিনি ও তাঁর শাশুড়ি। জামিনের বিরোধিতা করতে গিয়ে সরকারি কৌঁসুলি আদালতে বলেছিলেন, ‘ওই দুই মহিলা অত্যন্ত ডেঞ্জারাস ও প্রভাবশালী।... খাগড়াগড়ে আমরা দেখেছি, কী ভাবে বিস্ফোরক তৈরিতে মহিলারা সাহায্য করেছেন। এমনকী শিশু কোলে জেলে গিয়েছেন।’
গত জানুয়ারিতে পুলিশ এবং তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের হাতে বীরভূমের পাড়ুইয়ের ওই বধূ নিগৃহীত হওয়ার পরে অজয় দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। থেমে থাকেনি ঘোলা জলে রাজনীতির মাছ ধরাও! ওই নির্যাতিতা যোগ দিয়েছিলেন যে বিজেপি-তে, সেই বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধেই তোপ দাগতে শুরু করেন তিনি। ইঙ্গিতও মেলে তাঁর শিবির বদলের। আবার বিজেপি-র কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের সঙ্গে কথা বলার পরে তিনি জানিয়েছেন, এই মামলার শেষ দেখেই তিনি ছাড়বেন। তা হলে কি আর তৃণমূলে যাওয়া হচ্ছে না তাঁর? জবাব মিলেছে, ‘আমাকে ছেড়ে দিন। আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।’
কেন এ ভাবে সব কিছু ‘ছেড়ে’ দিতে হয়? যাঁরা নানা অবিচারের সুবিচার চেয়ে সর্বস্ব পণ করেন, সেই তাঁরাই যখন ‘সব ঠিক হ্যায়’ বলে লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েন কিংবা ছাড়তে বাধ্য হন, তখন গোটা বিষয়টার মধ্যে কি কোনও অনৈতিকতার আভাস মেলে না? সন্দেহ হয়, কোথাও কেউ বা কারা বলছে না তো, ‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি!’
এ সবের মধ্যেই সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় অসামান্য ফ্রেম: বোলপুরে তৃণমূলের কার্যালয়ে হৃদয় ঘোষের ঝুঁকে পড়া মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন স্বয়ং অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর দৃষ্টি যেন কোন সুদূরে প্রসারিত (আপাতত বোধহয় ২০১৬’য়)। হৃদয়ের সঙ্গেই ফের তৃণমূলে যোগ দিলেন তাঁরই মতো একদা আর এক বিক্ষুব্ধ দলীয় নেতা নিমাই দাস। তাঁদের হাতে ফুলের তোড়া! সেই ফুলও হয়তো বা এত ক্ষণে প্রসাদী হয়ে গিয়েছে! ‘ঘরে ফিরে’ই বাবার হত্যাকাণ্ডে ‘সিপিএমের হাত’ও দেখতে পেয়েছেন হৃদয়!
‘প্রভাবশালী’দের চোখে চোখ রেখে যাঁরা এত কাল মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলেছেন, প্রশ্নটা তাঁদের নৈতিকতা নিয়ে নয়। বরং এই নৈতিকতা প্রসঙ্গে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভূমিকা ঠিক কী, প্রশ্ন তোলা যেতে পারে তা নিয়েই। এই ব্যর্থতা সেই রাষ্ট্রনেতাদের, যাঁরা পেিশশক্তির কুৎসিত প্রদর্শনীর বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী নাগরিকদের পিঠে ভরসার হাত রাখতে পারেন না। ব্যর্থতা সেই প্রশাসনের, সেই পুলিশের, সেই বিচারব্যবস্থার, যারা মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলতে চাওয়া নাগরিকের দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়ায় না।
নৈতিকতা অবশ্য অনেক বড় কথা। সহমর্মিতার ব্যাপ্তি বোঝানো আরও কঠিন কাজ। তবে এই গণতন্ত্রে সহমর্মিতা বোঝানোর একটা চটজলদি রাস্তা আছে! যেমন, রাজ্য প্রশাসনের সর্বময় কর্ত্রী অবলীলায় বলতে পারেন, ‘কেষ্টর (অনুব্রত) জন্য শেষ শক্তি পর্যন্ত থাকব।’ সহজপাঠ-এর দ্বিতীয় ভাগের ভাষা খানিকটা বদলে নিয়ে বলতে গেলে, আজ ‘পরিবর্তন’ বার, আজ ‘সহমর্মিতা’ দেখানোর দিন!
তা হলে, হৃদয়দের সহমর্মিতা দেখাবেন কে? কে আবার? সেই অনুব্রতরা! কারণ, হৃদয়ের আর্জি সুপ্রিম কোর্ট মেনে নিলে অনুব্রতর স্বস্তি সব থেকে বেশি। এই মামলায় সিবিআই তাঁকে আর টানাটানি করবে না। অনুব্রত তাই বলতে পারছেন, ‘পরিবারে মতানৈক্য থাকতেই পারে। অতীতে আমরা একসঙ্গে দল করেছি। হৃদয়রা ঘরের ছেলে, ঘরে ফিরেছে!’ সহমর্মিতার বোধহয় একটা বিনিময়-মূল্য আছে, মিটিয়ে দিলে সে জিনিস হাতে গরম পাওয়া যেতে পারে।
‘ঘরের ছেলে’ হয়েছেন হৃদয়, হয়তো বা ‘ঘরের বধূ’ হবেন সাত্তোরের সেই নির্যাতিতাও। ‘অত্যন্ত ডেঞ্জারাস ও প্রভাবশালী’ হওয়া সত্ত্বেও!
সাত্তোরের সেই নারীর হৃদয়েও কি পরিবর্তন আসতে চলেছে? অনুব্রতের শান্ত উত্তর: ‘‘বিষয়টা হৃদয়-নিমাই দেখছে। তারাই বলতে পারবে।’’
অনুব্রত বলছেন, তিনি আইনকে শ্রদ্ধা করেন, ভক্তি করেন। আইন আইনের পথে চলবে। গণতন্ত্রও নিশ্চয়ই চলবে তার পথে! যেমন, ধন্দও থেকে যাবে তার নিজের মতো করে, আমজনতার ফিসফিসানির বৃত্তে!
কী ভাবে, কোথা থেকে, কোন পন্থায় হৃদয়রা নিজেদের ‘ভুল’ বুঝে ঠিক পথে ‘ফিরতে’ পারেন, অনুচ্চারিত থেকে যাবে সেই সব প্রশ্ন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy