পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক দুর্দিনের সময় নতুন করে কেন্দ্র ও রাজ্যের আর্থিক সম্পর্ক নিয়ে দু’-চার কথা বলা প্রয়োজন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, সে বিষয়েও কতগুলো কথা স্পষ্ট করে বলার দরকার আছে। বিশেষ করে তাদের অর্থনৈতিক এবং নীতিগত পদক্ষেপের যৌক্তিকতা পরিষ্কার হওয়া উচিত।
সংবিধান অনুসারে ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কেন্দ্র হয়ে উঠছে রাজ্যগুলোর মহাজন। কোভিড-১৯ হোক বা আমপান, যে কোনও প্রশ্নেই রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রের সামনে হাত পেতে দাঁড়াতে হচ্ছে। একাধিক রাজ্য এই বিষয়টি নিয়ে আপত্তি করেছে, কিন্তু কেন্দ্রের কোনও হেলদোল নেই।
সমস্যাটির একেবারে সহজ ও সর্বজনবোধ্য চেহারাটি খানিকটা এই রকম— কেন শুধু কেন্দ্রের সরকার টাকা ছাপাতে পারে কিন্তু রাজ্য সরকার তা পারে না? যদি কেন্দ্রের সরকার ১০০টি নতুন টাকা ছাপাতে পারে, তা হলে রাজ্যগুলোর সে টাকার ভাগ পাওয়া উচিত। রাজ্যগুলো অন্য দেশের অংশ নয়। অর্থনীতির ভাষায় এর মানে হল যে, রাজ্যগুলো প্রয়োজনে সরাসরি আরবিআই থেকে ধার করতে পারে। নতুন বন্ড বা ঋণপত্র দিয়ে। এর পরিবর্তে আরবিআই নতুন নগদ টাকায় ধার দেবে, ঠিক যেমন ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়। সেটা এখন হয় না। অর্থাৎ রাজ্যগুলো নতুন টাকা পেতে পারে না, কেন্দ্রীয় সরকার পারে। এই ক্ষমতাটা আকস্মিক মহাবিপদের সময় রাজ্যগুলোর হাতেও থাকা উচিত। কেন্দ্র বেশি বুদ্ধিমান তাই ঠিক করে ছাপানো টাকা ব্যবহার করতে পারে, আর রাজ্যগুলো বোকা ও দুষ্ট ছোট ভাই বলে সেটা পারে না, এ রকম একটা খেলো যুক্তি আশা করি কেউ দেবেন না।
কেন্দ্র সম্প্রতি ‘স্টেট ডিজ়াস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ তহবিল থেকে রাজ্যগুলোকে ১১,০০০ কোটি টাকা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, টাকাটা এল কোথা থেকে? কেন্দ্র কী ভাবে ২০ লক্ষ কোটির আর্থিক প্যাকেজের টাকা জোগাচ্ছে? কোথা থেকে টাকাটা জোগানো হচ্ছে? কেন্দ্রের রোজগারে নিশ্চিত ভাটা পড়েছে— তা হলে কী ভাবে রাজকোষ ঘাটতি সামাল দিচ্ছে? কী অর্থে কেন্দ্র আর্থিক ভাবে আত্মনির্ভর? সেটা কখনও কোনও ধরনের কেন্দ্রীয় প্রতিবেদনে উঠে আসে না। কেউ আজ অবধি বলেননি যে আর্থিক ক্ষমতায় একটি বামনসম দেশ হয়েও আমরা কী ভাবে আমেরিকা আর জাপানের মতো জাতীয় আয়ের সমান সমান অনুপাত করোনা মোকাবিলায় খরচ করছি। সেটা কেউ বোঝাতে চান না বা পারেন না। কেন্দ্রের খরচার জন্য হাতে যে টাকা থাকা উচিত, তার উৎসমুখ ঠিক কোথায়?
এ রাজ্যের অর্থমন্ত্রী বলছেন কেন্দ্রের প্যাকেজের মধ্যে ১০ লক্ষ কোটি টাকা পুরনো হিসেবের টাকা। তার সত্যাসত্য গভীর ভাবে বিশ্লেষণ না করেও বলা যায় যে নিশ্চয় নতুন টাকা ছাপানো হচ্ছে। অনেক আলোচনায় এটাই বলা হচ্ছে। সেই সিদ্ধান্তের ইতিবাচক দিকও বিলক্ষণ আছে। আপত্তি সেখানে নয়। প্রশ্ন হল, কেন্দ্র যদি আরবিআই থেকে সরাসরি ধার করতে পারে অর্থাৎ আরবিআই-সৃষ্ট নতুন টাকার জোগান কেন্দ্রের কাছে আসে, তা হলে রাজ্য সরকারও যাতে সেটা করতে পারে সেটাও দেখা উচিত। কেন্দ্র দাতা আর রাজ্য সরকার গ্রহীতা— আমাদের সংবিধান মানতে হলে এই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন।
কিন্তু রাজ্যগুলোর সেই ক্ষমতা নেই বলে তাদের শুধু বেশি করে ধার করতে বলা হয়েছে। অথচ হিসেব বলছে, জিএসটি বাবদ ৩০,০০০ কোটি টাকা রাজ্যগুলো এখনও কেন্দ্রের কাছ থেকে পায়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও দায় নেই নতুন ছাপানো টাকা দিয়ে রাজ্যগুলোর ঘাটতি মেটানোর। কিন্তু সময় বুঝে তারা সেটা করতে পারে নিজেদের জন্য, এবং এখন করছে বলেই মনে হয়। ফলে, কেন্দ্রের আত্মনির্ভর হওয়ার সমস্যা নেই, রাজ্যগুলোর আছে।
অর্থনীতির অনেক সাধারণ যুক্তি গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। রাজ্যগুলোকে কেন্দ্র আরও ধার করতে বলেছে, আবার ‘কস্ট কাটিং’-এর কথাও বলেছে। কোন খরচাটা কেন্দ্র কমাচ্ছে আর কোন খরচাটাই বা রাজ্যগুলো এই কালবেলায় কমাতে পারে? বাজারে বন্ড ছাড়লে কেন লোকে এখন তা কিনবে? যে দেশের এখন কোনও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই, সেখানে কেন আমি বিনিয়োগ করব? ফলে আকাশছোঁয়া সুদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে সেই বন্ডগুলোতে, আর তাই হচ্ছে। কেরল আগেই এই সমস্যার কথা বলেছে। এখন বাংলা নতুন ধার করে আমপান আর করোনার খরচ মেটাবে? মেটাবেই বা কী করে? যত দিনের মধ্যে ধার শোধ দিতে হবে, তার মধ্যে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর নিশ্চয়তা নেই।
কেন্দ্রের সরকার টাকা ছাপিয়ে খরচ করবে, কাকে কত দেবে সেটা ঠিক করতে হয়তো রাজনীতিও করবে। মনে রাখা ভাল যে বিষয়টি কেন্দ্রে বা রাজ্যে কোন দল সরকারে আছে, তার উপর নির্ভর করে না। যিনিই কেন্দ্রে থাকুন তিনি খবরদারি করবেন এটাই স্বাভাবিক, কারণ তেমন ভাবেই নিয়মকানুন বেঁধে দিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু দুটোই তো এ দেশের সরকার। অনেক দিন হয়েছে, এ বার এ সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত।
আরও একটা প্রশ্ন আছে। যে সময় কোনও কর আদায় হয় না, কোনও সরকার তেমন আয় করে না, সে ধরনের বিপদকালে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে কী ভাবে খরচের ক্ষমতা ভাগ করা হবে, তা নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তার সময় এখন। রাজ্যের প্রাপ্য টাকা রাজ্যকে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বাহাদুরি দেখাবে, এই রাজা-প্রজার সম্পর্ক আর কত দিন!
আমরা প্রচারসর্বস্ব আর্থিক পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তিত। আসল সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে চললে দেশের পক্ষে ক্ষতি হয়, দেশের মানুষকে অন্ধকারে রাখা হয়। প্যাকেজে ঘোষিত কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার ঠিক কতটা মানুষের হাতে আসবে, বোঝা যাচ্ছে না। সরকার তো বলতেই পারত ধারদেনা বাবদ এক মাসের ইএমআই নাগরিক এবং রাজ্যগুলোর কাউকেই কোনও দিন দিতে হবে না। মানুষের রোজগারের ভবিষ্যৎ না থাকলে শুধু আজকে খরচ করার টাকা জুগিয়ে মানুষকে স্তোক দেওয়া হল।
এক সরকার যদি টাকা ছাপাতে পারে, তবে অন্য সরকারও যেন সেটা পারে— এই দাবি তোলা দরকার। কেন্দ্রের সরকার তাদের রাজকোষ ঘাটতি ‘মানিটাইজ়’ করতে পারবে, অর্থাৎ ঘাটতি মেটাতে পারবে নতুন টাকা ছাপিয়ে নিয়ে। কিন্তু রাজ্য সরকারগুলো তা পারবে না। কিছু দিন আগে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সঞ্চিত আয় থেকে বেশ কিছু টাকা কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে। নিয়মমাফিকই নিয়েছে এবং অকারণে আরবিআই-এর ভান্ডারে অনেক টাকা পড়ে থাকারও প্রয়োজন নেই— যদিও, সেই টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের ঝুঁকির পরিমাণ ঠিক ভাবে হিসেব কষা হয়েছিল কি না, সেই প্রশ্ন অনেকে করেছিলেন। এখন বড় প্রশ্ন, কেন শুধু কেন্দ্রীয় সরকারই এটা পারবে, রাজ্যগুলো কেন পারবে না।
যখন দেশে বিভিন্ন ধরনের মহাদুর্যোগের কারণে টাকা ছাপানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে, রাজ্যগুলো সরাসরি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে ধার করে নতুন টাকা পেতে পারবে, এমন নিয়ম হওয়া অতি জরুরি। টাকা ছাপানোর অধিকার কিছুতেই একতরফা হতে পারে না। নিশ্চয় কেউ কেউ বলবেন ‘এই’ রাজ্য বা ‘সেই’ রাজ্যকে দিলে ‘দেশটা উচ্ছন্নে যাবে’। কিন্তু মনে রাখবেন, রাজ্যের নাগরিক দেশেরও নাগরিক। আর রাজ্যের নাগরিকদের বাদ দিলে দেশটার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। প্রয়োজনে রাজ্যগুলোর কেন্দ্রের মতো খরচ করার সমান অধিকারও থাকা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এই দাবি নিয়ে আগামী দিনে সংঘাত অনিবার্য।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফরেন ট্রেড;
অর্থনীতি বিভাগ, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy