Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

ছাঁচ বদল?

তবে বিদ্যালয়ের এই ভাবনা-বদলের প্রয়াসের সমর্থন সমাজের অন্যত্রও থাকিতে হইবে।

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:১৯
Share: Save:

ডাক্তার অপারেশন করিতেছেন, রোগী শুইয়া আছে। রোগী ডাক্তারের পুত্র, কিন্তু ডাক্তার রোগীর পিতা নহেন। কেমন করিয়া হইল? উত্তরটি সহজ, কিন্তু অত সহজ নহে। উত্তর হইল, ডাক্তার ছেলেটির মাতা। যে হেতু এক নারীকে কেহ চট করিয়া ডাক্তারের ভূমিকায় ভাবিতে অভ্যস্ত নহেন, এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে উত্তরটি মাথায় আসা কঠিন। সমাজ জুড়িয়া নারী ও পুরুষ সম্পর্কে কিছু প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধাঁচ রহিয়াছে, যাহা প্রশ্রয় পায়, লালিত হয় ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। শিশু বিদ্যালয়ে যাইয়াও, তাহার পাঠ্যপুস্তকে ও অন্যান্য বিদ্যালয়-ক্রিয়াকলাপে এই ছাঁচেরই প্রতিফলন দেখিলে, তাহার হৃদয় ওই বয়স হইতে লিঙ্গবৈষম্যে অভ্যস্ত হইয়া যাইবে। স্কুল প্রাঙ্গণে ও স্কুল পাঠ্যক্রমে লিঙ্গ-পক্ষপাত লইয়া এক আলোচনা-সভা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হইল কলিকাতায়। প্রশ্ন উঠিল, স্কুলে ফুটবল মানেই কেন ছেলেদের খেলা, মেয়েরা কেবল স্কিপিং কেন করিবে? স্কুলে সরস্বতীপূজা হইলে আলপনা আঁকা কেন মেয়েদের কাজ ও বাজার করা ছেলেদের? কেন পাঠ্যবইয়ে আঁকা থাকিবে, প্রাতরাশের সময়ে পিতা সংবাদপত্র পড়িতেছেন ও মাতা খাদ্য পরিবেশন করিতেছেন, বা পিতা অফিস যাইতেছেন ও মাতা রান্নায় ব্যস্ত? এই আখ্যান উঠিয়া আসিল, উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জে এক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক বহু প্রতিকূলতা সহ্য করিয়া, ছাত্রীদের একটি ফুটবল দল তৈরি করিয়াছিলেন। সেই স্কুলের এক অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছবি আঁকিয়াছে, মেয়েরা ফুটবল খেলিতেছে এবং ছেলেরা হাততালি দিতেছে। তাহার অর্থ, পরিবেশে লিঙ্গসাম্য থাকিলে, শিশু তাহাই স্বাভাবিক ভাবিতে শিখে।

তবে বিদ্যালয়ের এই ভাবনা-বদলের প্রয়াসের সমর্থন সমাজের অন্যত্রও থাকিতে হইবে। নতুবা বিদ্যালয় হইয়া যাইবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, যেখানে আদর্শ মানিয়া কিছু অবাস্তব বিষয়ে জ্ঞান বিতরণ করা হয়। বিদ্যালয় হইতে ফিরিয়া শিশু থাকিবে আয়া-মাসির তত্ত্বাবধানে। লিঙ্গসাম্যের ফলেই, তাহার মাতা ও পিতা দুই জনেই অফিস গিয়াছেন। আয়া সমগ্র দ্বিপ্রহর টিভি খুলিয়া সিরিয়াল দেখিল, খেলিবার ফাঁকে ফাঁকে শিশুও তাহা অবিরাম বা সবিরাম দেখিল। সেই সিরিয়ালে নারীর সশঙ্ক, সঙ্কুচিত, সঙ্কীর্ণ, গৃহবন্দি ছাঁচকে এমন মহিমান্বিত করা হইল যে পাঠ্যপুস্তকের অপেক্ষাকৃত নীরস চিত্র কোথায় ভাসিয়া যাইল। বইয়ে যদি বহু বার অঙ্কিত হয় মাতা কম্পিউটারে কাজ করিতেছেন ও পিতা আলু ভাজিয়া সম্মুখে ধরিতেছেন, আর তাহা যদি একটি দিনের জন্যও বাস্তব সংসারে শিশু দেখিতে না পায়, বিপরীতটিই তাহার পরিবারে দাপটের সহিত দাবি করা হইতে থাকে, তাহা হইলে প্রতি দিন ভাবসম্প্রসারণ লিখিয়াও সে লিঙ্গসাম্যে দীক্ষিত হইবে না। কুইজ়ের বইয়ে প্রথম মহিলা মহাকাশচারীর নাম মুখস্থ করিলেও, কেহ যদি সারা জীবনে এক জন মহিলা ট্যাক্সিচালককেও না দেখে, তবে মহিলাকে চালকের আসনে সে বসাইতে দ্বিধা করিবেই। অতি আধুনিক ও সুশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা কলেজে, পার্কে, পথে নারীর লজ্জাবতী ও নির্ভরশীলা মূর্তিটিকেই অধিক পছন্দ করিলে, সেই ভাবনার আঁচ আসিয়া কিশোর-কিশোরী ছাত্রছাত্রীর মনেও সদৃশ আকর্ষণ গড়িয়া তুলিবে। ফলে বাস্তব যত দিন অনড় চিন্তাধাঁচকে উদ্‌যাপন করিতেছে, বিদ্যালয়ের প্রচেষ্টা ও অভিযান সাধুবাদযোগ্য হইলেও উহার প্রভাব সম্ভবত বিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ।

অন্য বিষয়গুলি:

Gender Inequality Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy