—প্রতীকী চিত্র।
ভারতীয় সংবিধান এক মূল্যবান দলিল। তাকে বুঝতে হলে যেমন আবেগের প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন যুক্তিভিত্তিক ভাবনা-চিন্তারও। আবেগই হয়তো সংবিধানের মূল ভিত্তি তৈরি করেছিল। তবে যুক্তির মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠার পরই সংবিধান তার বর্তমান আকার নিয়েছে।
সংবিধান সভা কিন্তু ভারতীয়েরা তৈরি করেননি। ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের সংবিধান সভা গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ভারতীয় সংবিধান অনেকাংশে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের কাছে ঋণী। অন্তত ২৫০টি ধারা ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন থেকে গৃহীত। জরুরি ব্যবস্থার আইনের কয়েকটি ১৯৩৫ ভারত শাসন আইন থেকে নেওয়া।
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার মার্কিন সংবিধানের প্রস্তাবনার সঙ্গে বিশেষ মিল আছে। কিন্তু একে শুধুমাত্র বিদেশি সংবিধানের প্রতিচ্ছবি ভাবাটা ভুল। ১৯২৮ সালের মতিলাল নেহরু কমিটি প্রণীত সংবিধান এবং ১৯৪৫-য়ে সপ্রু কমিটির সংবিধানের খসড়াও একে প্রভাবিত করে।
দার্শনিক ভাবে যে উদারনৈতিক নীতিবোধ আমাদের সংবিধান প্রণেতাদের বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে, তাতে বিদেশি সংবিধানের প্রভাব বিশেষ ভাবে থাকতেই পারে। ১৯৫০ সালের সংবিধানের খসড়া (ড্রাফট) তৈরি করেন স্যর বেনেগাল নরসিংহম রাও। সংবিধানের খসড়া কমিটির সভাপতি ছিলেন বাবাসাহেব অম্বেডকর। সেই কমিটিতে আরও সদস্য ছিলেন। যে খসড়া নিয়ে সংবিধান সভায় আলোচনা হয় সেটা কিন্তু শ্রীরাওয়ের তৈরি খসড়া। কিছু সভ্যদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল, দামোদর স্বরূপ শেঠ বলেন, আমাদের সংবিধান ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণ। গাঁধীবাদীদের মনে হয়, গাঁধীর ধ্যানধারণা গুরুত্ব পায়নি এই সংবিধানে। বাংলা থেকে নির্বাচিত, গাঁধীবাদী অরুণ গুহ বলেন যে, অম্বেডকর গাঁধীজির কাছ থেকে কিছুই শেখেননি।
সংবিধান সভার ইতিহাসটা জানা জরুির। প্রাদেশিক নির্বাচিত সভার নির্বাচন হয় ১৯৪৬ সালে। সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল পরোক্ষ ভাবে। অর্থাৎ যাঁরা প্রাদেশিক সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরাই নির্বাচিত করেন সংবিধান সভার সদস্যদের। সে যুগে প্রাপ্তবয়স্কের সর্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না। প্রাদেশিক সভায় নির্বাচন হত ‘রেস্ট্রিক্টেড ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি’-র মাধ্যমে। অর্থাৎ আজ যে অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচন বুঝি, সেই অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ছিল না। অর্থাৎ যাঁরা সংবিধান প্রণেতা তাঁরা কিন্তু সেই অর্থে সকল ভারতবাসীর নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন না। সমাজের বহু সংখ্যক মানুষ এই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। অম্বেডকর মনে করিয়ে দেন যে, আমেরিকার সংবিধানও তৈরি হয়েছিল অল্প সংখ্যক মানুষের সাহায্যে। অম্বেডকর আরও বলেন যে, পরবর্তী কালের নাগরিক যদি মনে করেন সংবিধানের ধারা পরিবর্তন করে তাকে যুগোপযোগী করা উচিত, তা তাঁরা করতে পারেন।
আমাদের সংবিধান এখনও পর্যন্ত ১০০ বারেরও বেশি সংশোধন হয়েছে। এমনকি প্রস্তাবনা যা সংবিধানের মূল ধারা ঠিক করে দিয়েছে, সেখানেও সংশোধনের দ্বারা নতুন শব্দের মাধ্যমে নতুন ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য ২৪তম সংবিধান সংশোধন, যা ১৯৭১ সালে চালু হয়েছিল। তার মাধ্যমে রাষ্ট্র আমাদের মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে— এমন বলা ছিল। বহু প্রতিবাদ হয়। কিন্তু এই সংবিধান সংশোধন যা কিনা আইনে পরিবর্তন হয়েছিল তা পরিবর্তন করার জন্য আবার সংসদকে নতুন সংশোধন করতে হল, যা ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংশোধন বলে পরিচিত।
অর্থাৎ আমাদের সংবিধান সংশোধনযোগ্য। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আদেশ বলে আমরা ‘মূল কাঠামো’র একটা তত্ত্ব পেয়েছি। তার মাধ্যমে সংবিধানের কিছু বিশেষ মৌলিক জায়গায় কোনও ভাবেই বদল আনতে পারে না রাষ্ট্র। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রথম আলোকপাত করে ১৯৬৪ সালের সজ্জন সিংহ বনাম রাজস্থান মামলায়। উল্লেখযোগ্য, ১৯৬৭ সালের গোলকনাথ মামলা ও ১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলাও। এই শেষ মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট কিছু নির্দেশিকা জারি করে যা মূল কাঠামোর ভাবনা অনেকখানি স্পষ্ট করে।
ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতাদের সংবিধান গ্রহণ করার জন্য বেগ পেতে হয়নি, কেননা বেশির ভাগ সভ্যই ছিলেন কংগ্রেস সদস্য। কিছু গাঁধীবাদী ও অন্য আদর্শে অনুপ্রাণিত সদস্যেরা অন্য মত পোষণ করতেন— ঐতিহাসিক দলিল থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা সংখ্যালঘুর নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন, এই যুক্তি সঠিক।
তবে যে হেতু সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি সাংবিধানিক, তাকে অবজ্ঞা করা অসাংবিধানিক। ১৯৭৬ সালে ১৯৭১ সালের আইন সাংবিধানিক পদ্ধতিতে আমরা বদলেছি। তেমন পরিস্থিতিতে সংসদীয় প্রণালীতে ভারতীয় নাগরিকেরা আবার সংবিধানে বদল আনতেই পারি। তাতে কোনও বাধা নেই। অরাজকতা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। আমরা সাত যুগেরও বেশি এই ভাবে চলেছি। এখন এমন কোনও পরিস্থিতি হয়নি যে গণতন্ত্র জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল বক্তব্য বা, মূল কাঠামোর মূল দর্শন আমরা ভুলে যেতে পারি না।
উপাচার্য, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy