সোমবার দুপুরের পর থেকে ‘র্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল’ (আরসিটি) কথাটা নির্ঘাত বসার ঘরে ঢুকে পড়েছে। অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ায় এই পদ্ধতি বিশেষ পুরনো নয়, বড় জোর কুড়ি বছরের। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যদিও বহু দিন ধরে আরসিটি ব্যবহার করা হয়। ব্যাপারটা আসলে খুব জটিল কিছু নয়। ধরুন, কোনও একটা নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হল। সেই ওষুধ ব্যবহার করলে রোগীর ঠিক কতখানি উন্নতি হবে, সেটা মাপার জন্য শুধু ওষুধ খাওয়ালেই তো চলবে না। কারণ, রোগীর শরীরে সেই ওষুধ ছাড়াও প্রভাব পড়তে পারে আরও অনেক কিছুর। ফলে, এক দল রোগীর মধ্যে অর্ধেক লোককে বেছে নিতে হবে সেই নতুন ওষুধ খাওয়ানোর জন্য, আর অন্য দলটিকে রেখে দিতে হবে আগের অবস্থাতেই। প্রথম দলটাকে বলা হবে ট্রিটমেন্ট গ্রুপ, আর দ্বিতীয়টাকে কন্ট্রোল গ্রুপ। আর, এই বাছাইয়ের কাজটা যে পদ্ধতিতে হবে, তার নাম র্যান্ডম সিলেকশন। অর্থাৎ, কোন রোগী কোন দলে যাবে, তা কোনও পূর্বশর্ত এবং কোনও বিশেষ পছন্দ-অপছন্দ ছাড়াই বেছে নেওয়া হবে। এই ভাবে দুটো দল তৈরি করে নিলে সুবিধে হল, দল দুটো তুলনীয়— তাদের মধ্যে একমাত্র ফারাক শুধু ওষুধ প্রয়োগ করা আর না-করায়। অতএব, কিছু দিন ওষুধ ব্যবহার করার পর দু’দলের রোগীদের অবস্থার মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার করলেই বোঝা যায়, ওষুধ ঠিক কতখানি কাজ করল।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়রা এই পদ্ধতিটিকেই নিয়ে এসেছেন অর্থশাস্ত্রের চর্চায়। কেন, তার কারণ আছে। উন্নয়নের অর্থনীতির সঙ্গে চিকিৎসাবিদ্যার তুলনা টানা যেতে পারে— অর্থনীতির হরেক রোগ, যেমন স্বাস্থ্যখাতে দুর্বলতা, শিক্ষায় ঘাটতি এবং সব মিলিয়ে গরিব মানুষের গরিবই থেকে যাওয়া, এগুলোর কার্য-কারণ খোঁজা এবং সমাধান বার করা আধুনিক উন্নয়নের অর্থনীতির একটা বড় অংশ। সেই চিকিৎসা হয় বিভিন্ন নীতির মাধ্যমে। যেমন, টিকা নিলে অনেক প্রাণঘাতী রোগের প্রকোপে পড়তে হয় না, তবুও বহু গরিব মানুষ সন্তানকে টিকা দেওয়ান না— এই রোগটার চিকিৎসা হবে কোন ওষুধে? পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বা চিকিৎসাশাস্ত্রের মতো বিষয়ের মস্ত সুবিধা হল, তার পরীক্ষানিরীক্ষার বেশির ভাগটাই সেরে ফেলা যায় ল্যাবরেটরিতে। অর্থনীতির সেই সুবিধা নেই— তার কারবার রক্তমাংসের মানুষকে নিয়ে। ফলে, কী করলে মানুষ সন্তানকে টিকা দেওয়াতে নিয়ে আসবেন, সেটা বোঝার জন্য পরীক্ষা করতে হবে বাস্তবের জমিতেই। আরসিটি সেই পরীক্ষার পথ খুলে দেয়। তার জন্য বেছে নিতে হয় একই রকম আর্থ-সামাজিক পরিবেশের বেশ কিছু জনপদ। সেগুলোকে দুটো দলে— ট্রিটমেন্ট গ্রুপ আর কন্ট্রোল গ্রুপ— ভাগ করে নিতে হয়। ট্রিটমেন্ট গ্রুপে প্রয়োগ করা হয় নতুন কোনও নীতি, আর কন্ট্রোল গ্রুপ চলতে থাকে আগের মতোই। কিছু দিন পরে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা হয়, ট্রিটমেন্ট গ্রুপের অবস্থা বদলাল কি না। বদলালে, কতখানি? সেই ফলাফলই বলে দেয় নতুন পদ্ধতি সফল হল কি না।
টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রেই অভিজিৎদের পরীক্ষায় দারুণ ফল পাওয়া গিয়েছিল। রাজস্থানের উদয়পুরের কিছু গ্রামে সেবা মন্দির নামে এক অসরকারি সংস্থার সঙ্গে একটা নতুন প্রকল্প চালু করেন তাঁরা। সন্তানকে প্রতি বার টিকা দিতে নিয়ে এলে বাবা-মাকে দেওয়া হল এক কেজি ডাল, আর সব ক’টা টিকা নিলে দেওয়া হল স্টেনলেস স্টিলের থালার একটা সেট। প্রশ্ন উঠেছিল, এক কেজি ডালের দাম যেখানে এক জন অদক্ষ শ্রমিকের এক দিনের মজুরির অর্ধেকেরও কম, সেটুকুর লোভে কি তাঁরা ছেলেমেয়েকে টিকা দিতে নিয়ে আসবেন? দেখা গেল, শুধু এটুকু পরিবর্তনেই টিকাকরণের হার বেড়ে গেল পাঁচ গুণ।
আবার, কোন ওষুধে রোগ সারে না, সেই উত্তরও আরসিটি দিয়েছে। মাইক্রোফিন্যান্স বা ক্ষুদ্র ঋণ কি সত্যিই দারিদ্র কমায়? হায়দরাবাদে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন অভিজিৎ বিনায়ক, এস্থার ও তাঁদের সহকর্মীরা। ১০৪টি বস্তি বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা। সেগুলির অর্ধেক, অর্থাৎ ৫২টিতে এক ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার সহযোগিতায় খুলেছিলেন ঋণ দেওয়ার শাখা, আর বাকি ৫২টি ছিল পূর্ববৎ। মোট প্রায় ৭,০০০ পরিবার এসেছিল এই সমীক্ষার আওতায়। পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার আগে এই বস্তিগুলোর মধ্যে বিশেষ ফারাক ছিল না— বকেয়া ধার, মাথাপিছু ব্যবসার পরিমাণ, মাথাপিছু খরচ, সবই কার্যত এক রকম ছিল দু’দিকের বস্তিতেই। ৫২টি বস্তিতে ঋণ দেওয়া হল। তার ফলাফল বিচার করতে বসে দেখা গেল, যে ব্যবসাগুলো আগে থেকেই ছিল, তাতে লগ্নির পরিমাণ বেড়েছে, লাভের পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু, পরিবারগুলোতে মাথাপিছু ভোগব্যয় বাড়েনি; শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা নারীদের ক্ষমতায়নেরও উন্নতি হয়নি। বরং, কনজ়িউমার ডিউরেব্লস যাকে বলে, সেই গোত্রের পণ্যের পিছনে ব্যয় বেড়েছে। অন্যান্য দেশে হওয়া সমীক্ষার ফলাফলও এর কাছাকাছি কথা বলল। বোঝা গেল, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করলেই দারিদ্র কমবে, উন্নয়ন হবে— এমন নিশ্চয়তা নেই।
এর আগে কি কেউ ক্ষুদ্র ঋণের ফলাফল নিয়ে গবেষণা করেননি? অথবা দেখতে চাননি, কী ভাবে বাড়ানো যায় টিকাকরণের হার? অবশ্যই করেছেন। অভিজিৎ বিনায়কদের গবেষণা অন্যদের থেকে আলাদা শুধু একটা জায়গাতেই— যে হেতু এই নীতিগুলোর প্রয়োগে কোনও সঠিক ভাবে নির্বাচিত কন্ট্রোল গ্রুপ ছিল না, তাই পরোক্ষ ভাবে অন্য উপাদানগুলোর প্রভাব সরিয়ে দেখতে হত আলোচ্য নীতির প্রভাব কতটা। ফলে, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের
ফলে দারিদ্র কমছে কি না, তা দেখতে গিয়ে সংশয়াতীত ভাবে বোঝার উপায় ছিল না যে সেটা শুধু প্রকল্পের ফলেই কমছে, না কি অন্য কোনও প্রভাবও পড়ছে তার ওপর। অভিজিৎ বিনায়করা এই খামতি পূরণ করেছেন।
তাঁদের পদ্ধতির একটা লক্ষ্যের কথা আলাদা করে না বললেই নয়— তাঁরা মূলত ফাঁক ভরাট করতে চান। গরিব মানুষ যদি শুধু তথ্যের অভাবে কোনও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন, তবে তাঁরা সেই তথ্য তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পথ খোঁজেন। কোথাও তৈরি করে দেন প্রণোদনা, যাতে গরিবের পক্ষে ঠিক সিদ্ধান্ত করা সহজতর হয়। দারিদ্রের অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে মইগুলো আছে, সেগুলো যাতে গরিব মানুষের নাগালে আসে, সেটাই তাঁদের চেষ্টা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আরসিটি কি মূলধারার উন্নয়ন অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খায়? এই ধারা মূলত অর্থব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার কথা আলোচনা করে এসেছে— কৃষি থেকে শিল্প ও পরিষেবার দিকে যাত্রা; অথবা কিসে জাতীয় আয়ে এই ক্ষেত্রগুলির আপেক্ষিক গুরুত্ব বাড়ে-কমে, সেই আলোচনা। শুধু উৎপাদনের উপাদানের ক্ষেত্র পরিবর্তন নয়, প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের আখ্যানও বটে। কী ভাবে ব্যক্তিগত লেনদেনের সম্পর্ক ক্রমে চুক্তিভিত্তিক বিনিময়ে পৌঁছয়, বাজার অর্থনীতি কী ভাবে কাজ করে, তার সঙ্গে সামাজিক নিয়মের কী পরিবর্তন ঘটে, এই সব। সাইমন কুজ়নেটস বা আর্থার লুইস— অর্থনীতির নোবেলের আদি যুগের দুই বিজয়ী যে সব বিষয় নিয়ে চর্চা করতেন।
সংক্ষেপে বললে, আরসিটি মূলত ছোট মাপের পরীক্ষানিরীক্ষা করে— কোনও সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে উন্নয়নের মাপকাঠিতে কী প্রভাব পড়ে, র্যান্ডমাইজ়ড ট্রায়ালের মাধ্যমে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। এখন বেশ বড় মাপেও আরসিটি হচ্ছে— এমনকি, গোটা রাজ্য জুড়েও। কিন্তু, বিশ্লেষণের কোনও পদ্ধতি দিয়েই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যায় না। আরসিটি দিয়েও নয়। তবে, এখন কোনও প্রকল্পের মূল্যায়ন ছাড়াও অন্য ক্ষেত্রে আরসিটির ব্যবহার হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে জমি ও বর্গা, ঋণ, শ্রম ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে আরসিটিতে কাজ হচ্ছে। এই বিষয়গুলিতে আগে যে গবেষণা হয়েছিল, তার বেশ কিছু খামতি এই নতুন পদ্ধতিতে শুধরে নেওয়া যাচ্ছে। খুব বড় এলাকা জুড়ে হওয়া কাজে আরসিটি ব্যবহার করা যাবে না, সেটা সত্যি। কিন্তু, এই পদ্ধতির দিগন্ত যে প্রসারিত হচ্ছে, সেটাও একই রকম সত্যি। যেমন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও পল গার্টলারের সঙ্গে বর্তমান লেখকদের এক জনের অপারেশন বর্গা সংক্রান্ত গবেষণার কাজের সূত্র ধরে ভাগচাষ ও উৎপাদনশীলতা নিয়ে সম্প্রতি নতুন গবেষণা হয়েছে আরসিটি ব্যবহার করে।
সব নতুন গবেষণা-পদ্ধতির মতো আরসিটিরও সমালোচনা হয়েছে বেশ। প্রশ্ন উঠেছে, এত ছোট নমুনার ওপর পরীক্ষা হয় যে একটি জনগোষ্ঠীতে গবেষণার যে ফল পাওয়া গিয়েছে, অন্য জনগোষ্ঠীতেও তা পাওয়া যাবে, তেমন নিশ্চয়তা নেই। কেউ প্রশ্ন করেছেন, যেটায় সুফল পাওয়া গেল, অন্য কোনও পদ্ধতিতে যে তার চেয়েও বেশি ভাল ফল পাওয়া যাবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়? কেউ বলেছেন, আরসিটি বলতে পারে না, ফল পাওয়া গেলেও তা পাওয়া গেল কেন। সমালোচনাগুলো উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কিন্তু, তাতে এই গবেষণা-পদ্ধতির তাৎপর্যও কমে না। বরং আরও নতুন পথে এবং তত্ত্ব ও তথ্যের সৃষ্টিশীল সমন্বয়ে এই পদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাই প্রমাণিত হয়।
শ্রীঘটক লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস-এ অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy