গত বছরের শেষ দিকে চিনের উহান প্রদেশে এক অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকে মারা যাচ্ছিলেন। এই জ্বরের কারণ তখন গোটা বিশ্বের কাছে ছিল অজানা। পরে জানা যায়, এর মূলে রয়েছে নতুন করোনাভাইরাস— ‘কোভিড ১৯’। এই চার মাসের মধ্যে গোটা বিশ্বে এই ভাইরাস ভয়ানক ত্রাস সৃষ্টি করেছে। আমেরিকা, ইটালি, স্পেন, ব্রিটেন— বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলির অসংখ্য মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত। পরিসংখ্যান বলছে, গোটা বিশ্বে এখনও ১৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত। মারা গিয়েছেন প্রায় আশি হাজারেরও বেশি মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (WHO) এই অসুখকে ‘অতিমারি’ (প্যানডেমিক) বলে ঘোষণা করেছে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, এই পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্ব বিরাট প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে। প্রশ্ন উঠছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যনীতি-সহ অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ে।
বিজ্ঞানীদের দাবি, যেহেতু এখনও এই ভাইরাসের কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, তাই নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই সংক্রমণ রোখার একমাত্র পথ। এরই সঙ্গে সঙ্গে সাবান, স্যানিটাইজ়ার দিয়ে হাত ধোওয়ার মতো বিধি পালনের কথা বলা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে গোটা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে সবাইকে তা মেনে চলতে বসা হয়েছে। গোটা দেশের মানুষ এখন কার্যত গৃহবন্দি। কবে এই বন্দিত্বের অবসান ঘটবে তা আমরা কেউই জানি না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তা, সংক্রমণের ভয়ের পাশাপাশি, দেখা দিচ্ছে অন্য এক সমস্যাও। যে সমস্যা থেকে এত দিন আমরা মুখ ফিরিয়ে থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছি।
লকডাউন শুরু হওয়ার পরে বেশ কিছু শহুরে মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছিল, তাঁরা গৃহ পরিচারিকাদের কাজে আসতে বারণ করেছিলেন। ভয় একটাই, কোনও ভাবে ওরা সংক্রমিত হলে বিপদে পড়বেন তাঁরাও। অনেকে মাস শেষ হতে ফোনে বলেছিলেন, ‘‘ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নম্বর পাঠাও। মাইনে পাঠিয়ে দেব।’’ কিন্তু তারই সঙ্গে দেখা দিল একটি সমস্যা। সময়মতো টাকা তার অ্যাকাউন্টে ঢুকলেও তা তোলা হবে কী ভাবে? ব্যাঙ্ক কি ঘরের দোরগোড়ায়? এক পরিচিত গৃহ পরিচারিকার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁর বাড়ির কাছে কোনও ব্যাঙ্ক নেই। টাকা তুলতে গেলে আসতে হয় অনেকটা পথ উজিয়ে। তাঁর এক ছেলে গ্যারেজে কাজ করে। গ্যারেজ বন্ধ হওয়ায় কাজ নেই। এক ছেলে গুজরাটের কারখানায় ছিল। লকডাউনের আগে ফিরে এসেছে। আবার কবে যেতে পারবে জানে না। গেলেও যে কাজ পাবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। দু’টি ছোট ঘরে পাঁচ জনের বাস। শৌচালয় থেকেও নেই। জল আনতে ছুটতে হয় পুকুরঘাটে। তাঁর প্রশ্ন, এই অবস্থায় কি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব? কত দিনই বা ত্রাণশিবির বা কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সহায়তা করবে? বস্তুত এই প্রশ্নটা কিন্তু সকলেরই? এলাকার কাছে ব্যাঙ্ক না থাকা, স্বল্প পরিসরে বহুজনে ঠাসাঠাসি করে বসবাস করা, জল আনতে যাওয়ার এই সমস্যার ছবি যে কোনও মফস্সলে গেলেই মিলবে। প্রশ্ন উঠছে কেন এত দিন এই জায়গাগুলিতে নজর পড়েনি?
হতাশার ছবি শহরের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও। আর কিছু দিন পরেই পয়লা বৈশাখ। অন্য বছর এই সময়টা জামাকাপড়, বিছানার চাদর, পর্দার কাপড়ের পসরা নিয়ে চৈত্র সেলে বসেন ছোট ব্যবসায়ীরা। গ্রামগঞ্জ থেকেও মানুষজন আসতেন শহরের বাজারে। কয়েক জন হকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বছরের এই সময়টায় ব্যবসা করে তাঁরা যে অর্থ পান তা দিয়েই সারা বছরের খরচ চলে। বাড়ির নানা অনুষ্ঠানের খরচও এই সময়ে উঠে আসে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব পাল্টে দিয়েছে। প্রায় এক মাস এই ব্যবসায়ীরা ঘরে বসে। মাথায় হাত রিকশ, অটো, টোটো চালকদেরও। বাস, ট্রাক-সহ নানা পণ্যবাহী গাড়ির ড্রাইভার, খালাসিদের মুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ। প্রত্যেকেরই প্রশ্ন, এই দমবন্ধ পরিস্থিতি কবে শেষ হবে?
রাজ্য ছেড়ে যাঁরা অন্যত্র পাড়ি দিয়েছিলেন সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা সবথেকে খারাপ। এঁদের অনেকেই যেনতেন প্রকারেণ ঘরে ফিরছেন। দিল্লিতে আন্তঃরাজ্য পরিবহণে কাতারে কাতারে মানুষের দাঁড়িয়ে থাকার ছবি দেখে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে অর্থনীতিবিদদের কপালে। দুই বর্ধমানের বহু পরিযায়ী শ্রমিকও ফিরে এসেছেন। দাবি উঠছে তাঁদের আইসোলেশনে রেখে স্বাস্থ্যপরীক্ষার। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে কী ভাবে? পূর্বেই বলা হয়েছে এক পরিচারিকার পরিবার ও তাঁর সমাজের কথা, সেখানকার স্থান সঙ্কুলানের অভাবের কথা। তাঁদের একটি এলাকাতেই সীমাবদ্ধ রাখা হলেও, সেখানে সংক্রমণ ছড়াবে না তার নিশ্চয়তা রয়েছে কি? প্রশ্ন উঠছে জেলার আদিবাসী পাড়াগুলির অবস্থা নিয়েও। তাঁদের খাবারের সরবরাহের পাশাপাশি চিন্তা উঠছে সেই জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা নিয়েও। এমন বহু পাড়ায় পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থাও নেই।
আরও একটি ক্ষেত্রের কথা বলা যাক। এখন বোরো ধান চাষের মরসুম চলছে। ধান কাটা শুরু হলে অন্য বছরগুলিতে ভিন্ রাজ্য বা জেলা থেকে বহু কৃষি-শ্রমিকেরা সপরিবারে এসে ধান কাটার কাজে যোগ দিতেন। গবেষকদের আশঙ্কা, লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে এক দিকে যেমন বোরো ধান কাটা এবং তা বাজারজাত করায় সঙ্কট দেবে, তেমনই মার খাবে সেই সব আন্তঃজেলা পরিযায়ী শ্রমিকদের রুটিরুজিও। হয়তো যে গ্রামে বোরো ধান চাষ হয়েছে শেষ পর্যন্ত অভাবের তাড়নায় সেই গ্রামের মানুষজনই এই কাজে হাত দেবেন। কিন্তু প্রশ্ন থাকছে, এই কাজের সময়ে কি স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হবে? তবে শেষ পর্যন্ত অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা নিয়েই তাঁরা আগামী দিনের খাদ্যভাণ্ডার সুরক্ষিত করার কাজে ঝাঁপাবেন। কিন্তু থেকে যাবে উৎপাদিত শস্যের ঠিকঠাক দাম না পাওয়া এবং লকডাউন মিটলেই জীবন ও জীবিকার তাগিদে অন্যত্র ছোটার ঘটনা পরম্পরা।
পরিসংখ্যান পরিষ্কারই বলে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সবার আগে বিপদে পড়েন সমাজের আর্থিক দিক থেকে প্রান্তিক মানুষেরা। তাঁদের কাজের নিরাপত্তা, খাবারের সহজলভ্যতা, স্বাস্থ্যের সুরক্ষা, শিক্ষার ব্যবস্থা, স্বচ্ছ জল সরবরাহ ও পরিচ্ছন্নতা— সব কিছুই অনিশ্চিত। অথচ বর্তমানের প্রেক্ষিতে এগুলিকে মৌলিক অধিকারই বলা উচিত। ভাবতে অবাক লাগে, এই মৌলিক অধিকারগুলি যাতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষেরা যাতে পান সে বিষয়ে সে ভাবে কোনও পরিকল্পনাই আমরা করে উঠতে পারিনি। এই সন্ধিক্ষণে এসে এটা অন্তত বোঝা গেল, সমাজের দরিদ্রতম স্তরের মানুষেরা যাতে সারা বছর এই পরিষেবাগুলি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পান সে দিকে তাকিয়েই নীতি প্রণয়ন করা দরকার। তা না হলে, রোগের হাত ধরে আসবে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্কটও।
কাজী নজরুল মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy